সম্প্রতি এ কে খন্দকারের লেখা ‘ভেতরে বাইরে’ বইটা পড়ে শেষ করলাম। বইটিতে লেখক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা সম্পর্কে তার বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে উইং কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ভারতে পালিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় উপ-প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই অনেক ভেতরের খবর জানতেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কে কেন্দ্র করে মার্চের শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্যদের বাংলাদেশে জড়ো করার বিষয়টা তিনি টের পেয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামি নেতৃবৃন্দকে গোপনে জানিয়েছেনও। কিন্তু আওয়ামি নেতৃবৃন্দ তখনো রাজনৈতিক সমাধানের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। লেখকের আক্ষেপ, যদি আওয়ামি নেতৃবৃন্দ আগে থেকেই সতর্ক হয়ে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতো, তাহলে ২৫ শে মার্চের কালো রাতের ক্ষতি অনেকাংশে এড়ানো যেত।
’ভেতরে বাইরে’ বইটিতে লেখক পুরো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে যে দাবি বর্তমানে ব্যাপক প্রচলিত, লেখক সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলা যায়না। কারন, ৭ই মার্চের ভাষনে বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলে বক্তব্য শেষ করেছিলেন। তাছাড়া ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং শেখের সাথে আলোচনা শুরু করেন। ৭ই মার্চ যদি স্বাধীনতার ঘোষনাই দিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় আবার আলোচনায় বসতেননা। লেখকের মতে ২৫ শে মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা সম্পর্কে কোন ঘোষণা দিয়ে যাননি বা কাউকে ঘোষণা দিতে বলেও যাননি। বরং উল্টো বক্তব্য পাওয়া যায়। সেদিন তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার একটি লিখিত বার্তা রেকর্ড করার জন্য অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, “আমার বার্তা প্রচার হলে এবং পাকিস্তানিরা তা শুনলে তারা আমাকে দেশদ্রোহী বলবে।” বঙ্গবন্ধু তখনো আশায় ছিলেন একটা রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হবে।
লেখক বলেন, পাকিস্তানের বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত অসংখ্য বাংলাদেশি কর্ম কর্তা এবং সাধারন সৈন্য কেবল একটা রাজনৈতিক নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। আওয়ামি লীগ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পেলেই ওনারা একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ করতে পারতেন। ইপিআর, পুলিশ এবং অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাকর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় সাধন করে আগেভাগে প্রস্তুত হয়ে থাকতে পারতেন।
লেখকের বক্তব্য, “২৫শে মার্চ রাতে হাজার হাজার মানুষ বেচেঁ যেত, যদি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঠিক সময়ে যুদ্ধ শুরু করতে পারতাম।”
লেখক জিয়াউর রহমানকেও স্বাধীনতার ঘোষক মানতে নারাজ। সেনাবাহিনীর একজন মেজর কি করে স্বাধীনতার ঘোষক হয়? অবশ্য এটা অকপটে স্বীকার করেছেন যে, মেজর জিয়ার ঘোষণা শুনে সারা দেশ জুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেন, সত্যিই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
লেখকের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, স্বাধীনতার ঘোষণা বলতে আমরা যা বুঝি- নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন আর পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এমনটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেনাই। বরং অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে ঘোষণা দিযেছিলেন। তাই স্বাধীনতার ঘোষক আসলে কে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।