দুর্গাপূজার দিন অর্থ্যাৎ দশমীর দিনে ও পরেরদিনে সুলতানগঞ্জ-বনানী হাটে ও মাদলাতে মেলা বসে । একটাসময় বিশাল মেলা বসতো‚ সময়ের পরিক্রমায় এখন ছোট হয়ে গেছে । দহপাড়া দিয়ে লিচুতলার সেই পুরোনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে ছোটবেলায় দলবেঁধে মেলায় যেতাম । কত বাহারি রকমের খাবার‚ মিঠাই‚ মাছ‚ খেলনা‚ চুড়িফিতা‚ গাছ‚ তৈজসপত্র‚ পান-সুপারি আরও কত কি । মানুষের কত ভীড় হতো । মেলার জন্য টিফিনের টাকা জমাতাম । সব বন্ধুবান্ধব একত্রে আড্ডা‚ খাইদাই হতো । মেলা থেকে মাটির ব্যাংক কিনে আনতাম মা’র জন্য ।
আশেপাশের প্রতিমাগুলোকে করতোয়াতেই বিসর্জন দেয়া হয় । মাদলা‚ দহপাড়া‚ বেজোড়াঘাট । যেহেতু আমাদের পাশের পাড়াতেই হিন্দু ধর্মের মানুষদের বাস । স্কুল-কলেজ জীবনেও হিন্দু সহপাঠীরা ছিলো । হিন্দু স্যার ছিলো । সৌহার্দ্যের কোনো কমতি ছিলোনা । দাওয়াত দিতো অনেকেই‚ যেতাম । নানারকম নাড়ুর সমাহার‚ ফলমূল থাকতো‚ মিষ্টান্নের আয়োজন থাকতো ।
যেগুলো আমাদের খেতে দেয়া হতো সেগুলো বাড়িতে বানানো হতো । দেবতাদের উদ্দেশ্যে যেগুলো উৎসর্গ করা হতো সেগুলো কখনোই আমাদের খেতে দেওয়া হতোনা । মূলত পূজাকালীন সময়ে যে প্রসাদ দেওয়া হয় সেগুলো তখনই বিলিয়ে দেওয়া হয়‚ আর সেটা হাতে নিয়ে তখনই খেয়ে ফেলেন সেখানকার পূজা পালনকারীরা । কোনো হিন্দুকে দাওয়াত করলে আমরাও কিন্তু বাজার থেকে খাসি কিংবা মুরগি কিনে আনি । গরুর গোশত কিন্তু তাঁর পাতে দিইনা । কারণ আমরা তাঁর ধর্মকে সম্মান করি‚ তাঁরাও সম্মান করেই বাড়িতে বানানো খাবারগুলোই পরিবেশন করেন; দেবতার নামে উৎসর্গ করা খাবার পাতে দেননা । কারণ তাঁরাও সম্মান দিতে জানে ।
দেখতাম যখন প্রতিমাগুলোকে বিসর্জনের জন্য ট্রাকে তোলা হতো বা নিয়ে যাওয়া হতো তখন কত মধ্যবয়স্ক‚ বৃদ্ধা নারীরা কান্নাকাটি করতেন । মুখে নানারকম প্রলাপ করতেন । ক্ষণিক একটা সময়ের জন্য প্রতিমাগুলো এসে মানুষের হৃদয়কে কতটা নাড়িয়ে দিয়ে যায়‚ যাঁর কারণে মানুষ অশ্রু ঝরায় । কতটা মায়ায় কতটা ভালোবাসে বলে আবেগাপ্লুত হয়ে যায় । আবার পৃথিবীর সকল মানুষের শান্তি কামনায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতেন ঠাকুরের পায়ের নিচে । কেউ তো ঠাকুরকে অশান্তি‚ হানাহানি বাঁধানোর জন্য আর্জি জানায়না । সবাই শান্তির জন্যই ভক্তি করে ।
শুধু আমার সাথেই নয় এখানে প্রায় সকলের সাথে অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে মেলাবন্ধন আছে । শিক্ষাজীবনে আছে‚ স্থানীয় সূত্রে আছে‚ চাকরিসূত্রে আছে‚ বাজার-হাটসূত্রে আছে । জীবনের কোনো না কোনো অংশে অন্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্পর্ক আছেই ।
ফ্রেন্ডলিস্টের অনেকেই আছে যাঁরা ব্লাড ডোনেট করে । কোন জাত-ধর্ম বিবেচনা করে ব্লাড ডোনেট করতে অপারগতা দেখায়না । আমিও করিনা‚ আমার ছোটভাইও করেনা । রাস্তায় কেউ এক্সিডেন্ট করলে তাঁর প্যান্ট খুলে চেক করার প্রয়োজন মনে করিনা যে সে হিন্দু নাকি মুসলমান । মুসলমান হলে হসপিটালে নিয়ে যাবো আর হিন্দু হলে নিয়ে যাবোনা । এরকম ধারণা কখনোই আমার মনে আসেনা ।
এই যে জীবনের একটা বড় সময় কেটে গেছে আমরা কি কখনও ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছি বা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছি? কোনো সহপাঠী কোনো বন্ধু বলতে পারবে? পারবেনা । সম্প্রীতি ছিলো বলেই তা সম্ভব হয়েছে । বা এরকম কখনও ঘটেনি যে সে অন্য ধর্মের তাই ওঁর সাথে কথা বলবোনা এরকম ঈর্ষাকাতরতাও কখনও কাজ করেনি ।
প্রাইমারী জীবনে একজন হিন্দু ম্যাম ছিলেন । হাইস্কুলে ছিলেন দু’জন হিন্দু স্যার । আমি তাঁদের সাথে মিশেছি । দেখেছি তাঁদের সততা‚ উদারতা‚ বন্ধুসুলভ আচরণ । যাঁরা ছিলেন নীতিবান মানুষ । তাঁরাও পাপ পূণ্য বোঝেন‚ মানেন । কই কখনও তো ধর্ম নিয়ে তাঁদের সাথে বিবাদে জড়াইনি আমরা । তাকে‚ তাঁর ধর্মকে গালি দেইনি । অন্য চোখে দেখিনি ।
বংশ পরম্পরায় ধর্ম পেলাম । এটি পরম সৌভাগ্য যে ইসলাম ধর্মের পরিবারে জন্মেছি‚ আল্লাহ চেয়েছেন তাই জন্মাতে পেরেছি । যদি আল্লাহ না চাইতেন তবে তো অন্য ধর্মের ঘরেও পাঠাতে পারতেন । তখন সেই ধর্মের মতাদর্শেই সারাটাজীবন কাটিয়ে দিতে হতো । কোন ধর্ম বিশ্বাসযোগ্য‚ খাঁটি‚ টেকসই সে সম্পর্কেওতো কখনও পড়াশোনা করা হয়নি । কখনও জাস্টিফাই করিনি আমরা‚ না মুসলিমরা না হিন্দুরা ।
অথচ পরম্পরায় পাওয়া এই ধর্মকে নিয়ে কত দ্বন্দ্ব কত বিভেদ । দু দিনে কয়েকজন তো মারাও গেলো । মন্দির ভাঙ্গা হলো‚ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হলো । কিন্তু তাতে করে কি পেলাম আমরা? কুমিল্লার সেই ঘটনায় হয়তোবা একজন দোষী কিংবা দুইজন দোষী । কিন্তু সেই দু-একজনকে দোষী সাব্যস্ত না করে পুরো একটা সম্প্রদায়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো কেন আমাদের? আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করে তাকে আইনের হাতে তুলে দিলেইতো হতো । কিংবা দেশের শাসনব্যবস্থাকে বলতেন যেন তাঁদের অন্ডকোষের সাথে ইট ঝুলিয়ে দেয়া হোক বা প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হোক । শাসনব্যবস্থা তো আর্জিগুলো শুনতো‚ মানতো ।
যাঁরা উগ্র তাঁরা মূলত জন্ম থেকেই উগ্র । অন্য ধর্মের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ । আর মনেপ্রাণে তীব্র ঘৃণা লালন করে থাকে । সেটা হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এরকম অনেক আছে । সৃষ্টিকর্তা সম্প্রীতির পৃথিবী দিয়েছে আমাদের । ধর্মগ্রন্থ এসেছে মানুষের শান্তির জন্য । আর আমরা আজ অশান্তির বীজ বপন করছি । ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে জোরপূর্বক ‘জয় শ্রীরাম’ পড়ানো হয়েছে আবার এদেশে হিন্দু পরিবারের উপর হামলা চালানো হচ্ছে । ধর্মের উদ্দেশ্য কি আদৌ এসব? ধর্মগ্রন্থ কখনও কি এগুলো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে বলেছে? বলেনি ।
জানিনা কবে আমরা মানুষ হতে পারবো । সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে থাকতে জানবো । কবে সভ্য হতে জানবো...কবে বলবো‚ “সবার উপরে মানুষ সত্য‚ তাঁহার উপরে নাই ।”
সাব্বির আহমেদ সাকিল
৩১ আশ্বিন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ‚ শরতকাল | ০৮ রবিউল আওয়াল ১৪৪৩ হিজরী | ১৬ অক্টোবর ২০২১ ইং | শনিবার | রাত্রি ১১ টা ১৪ মিনিট | ময়মনসিংহ
#সাব্বিরসাকিল #ধর্ম #দুর্গাপূজা #ধর্মীয়সংঘাত #মৃত্যু #দাঙ্গাহাঙ্গামা #ময়মনসিংহ