শীতের মৌসুম এসে পড়েছে । আমন ধানের এই মৌসুমে অনেকেই ধানের পরিবর্তে আলু লাগান । বগুড়ার গোল লাল আলু যা স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয় । ক’দিন পরেই বাজারে আসবে নতুন আলু । আর সেই আলু পোড়ানো হয় ধানগাছের অবশিষ্ট অংশ যাকে বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় ‘লাড়া’ বলা হয় সেটি দিয়ে ।
শৈশবের এটি আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্মৃতি । আমাদের এলাকায় বেশি আলু চাষ করতেন গোলাম মোস্তফা‚ প্রয়াত আলিমুদ্দিন সাকিদার‚ প্রয়াত জব্বার আলী প্রামাণিক‚ ইদ্রিস আলী সাকিদার‚ সাইদুল শাহ সহ আমার বাবা এবং বড়ব্বারা । ভিটে জমি হোক কিংবা নিচুজমি সব জমিতেই এই আলু চাষ হয় ।
কখনও নিজের জমি থেকে কখনও আবার অন্যের জমি থেকে আলু চুরি করে আলুপোড়া খেয়েছি । ধান কাটা হয়ে গেলে সেই লাড়াগুলোকে একত্র করে আগুন ধরিয়ে তাঁর মধ্যে আলু দিলেই হয়ে যেত আলুপোড়া । আমি‚ আমার মামাতো ভাই আলিম‚ শামিম জেঠাতো ভাই ইসমাইল‚ নাঈম‚ হাসান‚ ওয়াহেদসহ আরও অনেকেই ছিলো সেই দলে ।
আলু সংগ্রহ করা হতো কয়েকটি জমি থেকে যেন জমিওয়ালা বুঝতে না পারেন যে আলু চুরি হয়েছে । কলাগাছের শুকনো পাতা সংগ্রহ করা হতো আগুন লাগানোর সুবিধার্থে । সমতল কোনো জায়গায় দিয়াশলাই এর কাঠি দিয়ে ধরানো হতো আগুন । আগুনে বড় ধোঁয়া তৈরি হচ্ছিলো‚ চোখে ধোঁয়া লেগে এমন অবস্থা তৈরি হতো পরে কিছুক্ষণ আরকিছুই দেখা যেতোনা দু’চোখে । এছাড়াও কাপড়চোপড়ে ধোঁয়ার গন্ধ তো লাগতোই ।
কাপড়চোপড়ে ধোঁয়ার গন্ধপেয়ে মা অনেকসময় বকাঝকা করতেন । তারপরও কত আনন্দ কত উৎসব ছিলো আলুপোড়াকে কেন্দ্র করে । কখনও কলাগাছের বাকল(বগুড়াতে ‘ঢেঙ্গো’ বলে) দিয়ে সেটাকে মুড়িয়ে ভাটা বানাতাম । ভাটা বানানোর মূল লক্ষ্য হলো বেশি ধোঁয়া তৈরি করা । জমির আঁইলের পাশে বানানো হতো সেসব ভাটা । সেই ভাটার নিচের অংশে যেটাকে ক্লিং বলে সেটাতে দেয়া হতো আলু কিছুক্ষণ পর আলু বের করে ধোঁয়াটে সেই আলু খুব মজা করে খাওয়া হতো ।
এরকম গ্রুপ করো চলতো আমাদের অভিযান । সেই সময়গুলোকে ভীষণ মিস করি । যখন আমরা সবাই একত্রে থাকতাম‚ জাগতিক কোনো ব্যস্ততা‚ কোনো হতাশা ছিলোনা । মাঠে-মাঠে কত ঘুরেছি সকলে ।
যাঁরা বগুড়াতে বেড়ে উঠেছে যাঁরা নব্বই দশকের মানুষ তাঁদের প্রায় সবাই এই আনন্দটা উপভোগ করেছে । বগুড়াতে আলুঘাটি যেমন জনপ্রিয় তেমনি আলুপোড়াও দারুণ জনপ্রিয় । যদিও তথ্য প্রযুক্তির এই যুগের ছেলেমেয়েরা এসবের ধারেকাছেও নেই । বগুড়ার এই প্রাচীন ঐতিহ্য যে হারাতে বসেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা ।
আমাদের জীবনে সেই সময়গুলো আর কখনও ফিরে আসবেনা । তবুও এই সোনালী স্মৃতিগুলো জীবনভর থেকে যাবে‚ যাকে হৃদয় থেকে কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয় ।
⏭ সাব্বির আহমেদ সাকিল
▶০৮ অগ্রহায়ণ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ‚ হেমন্তকাল | ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৩ হিজরী | ২৩ নভেম্বর ২০২১ ইং | মঙ্গলবার | রাত্রি ১২ টা ২১ মিনিট | শেরে বাংলা নগর‚ বগুড়া
ছবি: সালাউদ্দিন সুমনের ভিডিও থেকে সংগৃহীত
#সাব্বিরসাকিল #ঐতিহ্য #আলুপোড়া #নস্টালজিয়া #শৈশব #অতীত #বগুড়া
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৩৯