২০০৭-২০০৮ সালের ঘটনা।সেই সময় থেকে প্রায় দেড় বছর আগে আমার আম্মুর নানা মারা যায়।আমার নানা বাড়ি আর আমার আম্মুর নানাবাড়ি ছিল মাত্র ১৫ মিনিটের হাটা পথ।তাই নানা বাড়িতে গেলেই আম্মুর নানাবাড়িতে যেতাম।আম্মুর নানা ছিলেন খুবই হাসিখুশি মানুষ।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার সাথে গল্প করতেন আর ট্রানজিস্টারে অনুষ্ঠান শুনতেন।তিনি মারা যাবার পর মাঝে মাঝেই তার কথা মনে পড়ত বিশেষ করে যখন আম্মুর নানা বাড়িতে যেতাম।তাছাড়া একিবার তিনি একটা অপারেশন করতে খুলনায় এসেছিলেন সেই সময়ের কথাও মনে পড়ত।
২০০৭-২০০৮ সালের দিকে ফিরে আসা যাক।যেমনটা বলছিলাম তিনি মারা যাওয়ার প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে।আমরা খুলনায় থাকি।বিকালে বাসার নিচে ক্রিকেট খেলতাম।তখন ছিল শীতকাল।আমরা যখন খেলতাম বল মাঝে মাঝে রাস্তায় চলে যেত।যে উইকেটের পিছনে দাড়াতো সে গিয়ে বল নিয়ে আসত যেহেতু সেখান থেকে রাস্তা কাছে।আমি যখন উইকেটের পিছনে থাকতাম এবং রাস্তায় বল আনতে যেতাম তখন প্রায়ই একজন সাদা পাঞ্জাবী ও পায়জামা পড়া বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখতাম।এটা কোন বিস্ময়ের ব্যাপার নয়।অবাক করা বিষয় হলো ওই ভদ্রলোকের চেহারা,উচ্চতা,শারীরিক গঠন ছিল অবিকল আমার আম্মুর নানার মত।প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন একটা বৈদ্যুতিক শর্ক এর মত অনুভূতি হয়েছিল।আস্তে আস্তে বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিতে শুরু করি।কোথায় যেন শুনেছিলাম পৃথিবীতে ৭ জন একই চেহারার ব্যাক্তি বসবাস করে।সেরকমই হয়তো ব্যাপারটা এরকমই ভেবেছিলাম।
দিন অতিবাহিত হতে থাকল।একদিন হঠাৎ করে আমার মনে হলো এই লোকটাকে আমি প্রতিদিনই দেখছি।অবাক হবার বিষয় হলো আমি যখনই বল আনতে বাইরে যাই তার ই কোন একবার ওই লোকটা ওই রাস্তা দিয়ে যায়।প্রত্যেকদিন!!এমনও নয় যে প্রত্যেক দিন কোন নির্দিষ্ট সময় আমি উইকেটের পিছনে দাড়াই।ক্রিকেট যারা বোঝেন তারা বুঝতে পারবেন।
আমার ছোট ভাই আমার থেকে ৩ বছরের ছোট সেও খেলত ক্রিকেট।একদিন তাকে ডেকে দেখালাম।সেও অবাক হলো এবং বলল "আম্মুকে বইলো না আম্মু কষ্ট পাবে"।নানার মৃত্যুর পর আম্মু অনেক কেঁদেছিল তাই হয়তো ও এই কথা বলেছে।আমি তখন এক কাজ করলাম একদিন যখন ওনাকে দেখলাম তখন খেলা বাদ দিয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকলাম দেখব উনি কোন বাড়িতে ঢোকে।আমাদের গলিটা ছিল বাইলেন অর্থাৎ দুই দিক থেকেই রাস্তায় বের হওয়া যেত।অবাক করার বিষয় হলো ওই ব্যাক্তি আমার বাম পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে সোজা গলি পেরিয়ে অপর প্রান্তের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে গেল।পর পর ৩-৪ দিন এমনটাই দেখলাম।লোকটা বয়সের ভারে খুরিয়ে খুরিয়ে হাটত।আমার মনে হলো এই লোকটা হয়তো পায়চারি করার জন্যই আমাদের গলিটা ব্যাবহার করে আবার মনে হলো এত বয়স্ক লোক কেনই বা তা করবে?প্রায় প্রতিদিনই ভাবতাম লোকটার সাথে কথা বলব।কিন্তু আমি কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের ওনাকে কি বলে সম্বধোন করব সম্বোধন এর পরে কি বলব তাই কখনো ঠিক করে উঠতে পারতাম না।
এই ব্যাপারটা আমার কাছে একটা রহস্য হয়েই সারাজীবন থেকে যেত যদি না ওনাকে দেখার ইতিটা ওভাবে না ঘটত।ওই দিন আমার জীবনে প্রথম বুঝতে পেরেছি পৃথিবীতে অপার্থিব অপ্রাকৃতিক বলে কিছু বিষয় আসলেই আছে।
তখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়তাম।২য় সাময়িক পরীক্ষা নিকটবর্তী।বাসা থেকে যাতায়াত ও টিফিনের টাকা দিয়ে দিলেও বাসায় ফেরার রিক্সাভাড়া প্রায়ই টিফিনেই শেষ করে ফেলতাম।অগত্যা হেটে বাসায় আসতাম কারন রিক্সা ভাড়ার টাকা দিয়ে স্টিকার,কার্ড এই সব কিনেছি শুনলে আম্মু রাগ করবে।একবারে হেটে আসতে পারতাম না তাই বাসায় আসার পথে একটা ছোট পার্কের মত ছিল সেখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার হাটা শুরু করতাম।
একদিন সেরকম পার্কে বসে বসে বার্মিজ আচার খাচ্ছিলাম হঠাৎ পাশের বেঞ্চিতে চোখ পড়তে মাথার ভিতরে ঠাস করে উঠল।ওই লোকটাই বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে।আমার আম্মুর নানা আমার দিকে তাকিয়ে যেভাবে হাসত অবিকল সেরকম।আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম।আমি উঠে গিয়ে ওই লোকটার পাশে গিয়ে বসলাম।ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম "আপনি তো মারা গেছেন তাহলে আপনাকে আমি দেখছি কিভাবে"।উনি আমার দিকে তাকিয়ে সেই একই হাসি হাসতে লাগল।প্রথমে ভাবলাম আমার বাচ্চামী দেখে মনে হয় হাসছে কিন্তু পরক্ষণে আমার সেই ভুল ভেঙে গেল।সে অবিকল আমার আম্মুর নানার মত কন্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বললো "আমি মারা গেছি নানু ভাই আমার ইচ্ছা গুলো তো মরেনি আমি তোমাদের মাঝে সেই ইচ্ছা গুলোকে খুজি আমি যেমন চেয়েছিলাম কিছুই তেমন হচ্ছে না।কেউ মারা গেলে তোমরা তাদের দেখতে পাও না তারা তোমাদের দেখে কষ্ট পায়,আনন্দ পায় এটা যে কি ধরনের জ্বালাতন না মারা গেলে বুঝতে পারবা না"।আমার হঠাৎ মনে হলো ইনি তো ভূত,শুনেছি ভূতের ছায়া পড়ে না কিন্তু নিচে তাকিয়ে দেখি স্বাভাবিক ভাবে যেমন ছায়া পড়ে তেমন ছায়াই।হাতের উপরে হাত রাখলাম অবিকল মানুষের হাতে হাত রাখলে যে অনুভূতি সেই অনুভূতি।আমি যেন একদম পাথরের মত হয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলাম এখন পাথর হলে চলবে না এটাই হয়তো শেষ সুযোগ আমি বললাম "আমি একটু আসতেছি আপনি এখানে বসে থাকুন"।বলে উঠতে যাবো ওমনি তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন "যাও নানুভাই,তুমি অনেক বড় হবে"।আমি উঠে প্রায় দৌড়ে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম।প্রথম বার যখন পিছনে ফিরলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন,দ্বিতীয়বার আমার দিকে হাত দেখালেন,তৃতীয়বার অর্থাৎ শেষবার এর পরে আর পিছনে তাকালে সেই বেঞ্চিটা দেখা যাবে না দেখলাম বেঞ্চিতে কেউ নেই,ফাকা।আমি দৌড়ে গেলাম আবার বেঞ্চির দিকে আশে পাশে কোথাও নেই,এই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হওয়া ছাড়া আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই।তার পর থেকে ওনাকে আর কখনো দেখিনি।
তখন থেকে আজ প্রায় ১০ বছর।এখনো মাঝে মাঝে সেই মাথায় হাত বুলানো অনুভব করি।ক্রিকেট খেলার সময় যেখানে তাকে দেখতাম সেখানে তাকিয়ে থাকি।মাঝে মাঝে মনে হয় ওইদিন যদি দৌড়ে আম্মুকে ডাকতে না রওনা হতাম তাহলে উনি ওভাবে চলে যেতেন না।হয়তো এখনো ওনার সাথে দেখা হত মাঝে সাঝে।ওনার অনুভূতি জানতে পারতাম।অনেক কিছু শিখতে পারতাম।এখনো যখন রাস্তায় একা থাকি বা কোন বাহনে থাকি আমার অবচেতন মন খুজে বেড়ায় ওনাকে।এখন যদি কখনো দেখা হয় আমি কাউকে বলবো না সেই দেখা হবার কথা।আমি আমার নিজের নানু বা দাদুকে কখনো দেখিনি।তবে আমার আম্মুর নানা আমার বাকি জীবনে ভাবনার খোরাক হয়ে থাকবে যতটা না তার মৃত্যুর আগের তার সাথে আমি তারো থেকে বেশী মৃত্যুর পরের।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৮ রাত ১২:৪১