তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি সম্ভবত। শীতের সোনালি সকাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি স্থানীয় বাজারের দিকে। রিকশায় গেলে কুড়ি পচিশ মিনিটের পথ। এই সময়ে সাধারনত দু-একটি রিক্সা ছাড়া রাস্তায় আর কোন যানবাহন চোখে পড়েনা।
আজ রিক্সাও নেই। তাই পায়ে হেটে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। শীতের সকালে হাটার একটা আলাদা মজা আছে। কিছুপথ হাটলে আর ঠান্ডা লাগেনা।
এত সকালবেলা বাজারের দিকে যাওয়ার কারন অবশ্য আছে। সেখানে গণিত স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ি। সামনে পরীক্ষা তাই পড়াশোনার চাপও একটু বেশি।
একেতো রাস্তায় রিকশা নেই তার উপর দেরি করে বের হয়েছি, তাই একটু দ্রুতপদে হাটার চেষ্টা করছি। শীতের রাস্তা ধুলোময়লায় ঝাপসা হলেও রোদটা ভারি মিষ্টি। বেলা আটটা বিশ বাজে। দশ মিনিটে কোনভাবেই বোধহয় পৌছতে পারবো না। এইপ্রথম আবিষ্কার করলাম- স্কুলব্যাগ কাদে নিয়ে চাইলেও দ্রুত হাটা যায়না। একামনে এসব ভাবছি আর হাটছি, হঠাৎ পেছন একটি রিকশার বেল শুনে ঘুরে থাকাই। বয়সের ভারে ন্যুব্জ রিকশাওয়ালা কোন রাখডাক ছাড়াই বলে-'উঠো বাবা'।
আমি খানিকটা বিষ্মিত হই। একি? সাধারনত বলে কয়ে রিকশাওয়ালাদের রাজি করানো যায়না, আর এই ব্যাটা গন্তব্য না জেনে নিজেই অফার করছে! আমার সময় কম হওয়ায় আগপিছ না ভেবেই উঠে পড়ি রিকশায়। রিকশা এগুচ্ছে আধাপাকা রাস্তা ধরে। বেচারা রিকশাচালক জানতে চান কিসে পড়ি। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর শুরু হয় তার কথার পৃষ্ঠে কথা।
- 'ভালো করে পড়োরে বাবা, মানুষের মত মানুষ অইতে অইবো। এই দেশটারে তোমরাউ গড়বায়।'
এরপর খানিকটা নীরব। আবার চাঁপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু হয় তার কথা-
- 'জীবনডা হুদাই খুয়াইলাম। হালার পুয়াইনতে লুঠিয়া খাইবো জানলে কি আর মউতোর সামনে বারবার পড়তাম! আইজ দেশোর মা বাফ তারা হইছে।'
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বুড়ো রিকশাওয়ালা। আমি তাঁর কথার আপাদমস্তক কিছু বুঝিনা, বুঝতে পারিনা। শুধু এইটুকু বুঝি তাঁর ভিতরে অনেক কষ্ট, অনেক যাতনা...
আমার নীরবতা দেখে প্রশ্ন করেন -'কি বাবা, কিচ্ছু কও না দেখি?'
আমি দ্রুত না না সব ঠিক আছে , আমি আপনার কথা শুনছি- এই বলে পরিস্থিতি সামলাই। তাঁর 'বাবা' সম্বোধনের মাঝে যে কি সম্মোহন তা আমি অনুভবের চেষ্টা করি।
আমার দিক থেকে সাড়া পেয়ে শুরু হয় কথার ফুলঝরি। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, সরকার, বিরোধীদল, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃংখলা ইত্যাদি তাবত বিষয় নিয়ে চলে বক্তৃতা। এইবার আমি ভেতরে ভেতরে খানিকটা বিরক্ত হই, যদিও মুখে প্রকাশ করিনা। লোকটা পাগল-টাগল নয়তো?
দেশের সব শ্রেণী, পেশা, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সকলের মুন্ডুপাত করে যাচ্ছে, কিন্তু কেন! ইচ্ছে করে প্রশ্ন করি, জানতে চাই। নতুন ঝামেলায় পড়বো ভেবে প্রশ্নটা আর করিনা। এমনিতেই যার কথা ফুরাচ্ছে না তাঁকে নতুন করে প্রশ্ন করলে উপায় থাকবে?
একসময় বাজারে পৌছাই। লোকটার কাছ থেকে এবার নিষ্কৃতি পেলাম ভেবে নিজেকে আশ্বস্ত করি। স্কুলব্যাগ থেকে ভাড়া বের করে দেই। এইবার হলো নতুন বিপদ! বেচারা বৃদ্ধ রিকশাচালক সরাসরি ভাড়া নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পাল্টা বক্তৃতা শুরু হয়-
- 'না না, কিতা যে কও বাবা। তোমরা ছাত্র মানুষ, তোমাতানোর খাছ থাকি যে হালার পোয়ায় টেকা নেয় ইগো কুনো মানুষের বাইচ্ছা নায়!'
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে প্রস্থান করে লোকটি। আমি ভাড়ার টাকাটি হাতে নিয়ে পেছন থেকে তাঁর রিকশার দিকে থাকিয়ে থাকি- লোকটি কে? কি তার পরিচয়? সে কি শুধুই একজন রিকশাচালক? বেচারা বেশি কথা বলে ঠিকই , কিন্তু তাঁর কথাগুলো অমূলক নয়। একেতো কোচিং ক্লাসে দেরি, তার উপর রিকশাচালকের দীর্ঘ বক্তৃতার প্রভাব মাথাজুড়ে। আমি আমার মত ছুটে চলি...
ঐ ঘটনার মাসখানেক পর লোকটির সাথে আবারও দেখা। দেখেই চিনে ফেলেন।
- 'বাজান, ভালা আছোনি?'
কি মধু তাঁর কথায় অথচ আমি তাঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি! ভালমন্দ জানতে চাঁয় বেচারা। আমি স্বভাবসূলভ অল্পকথায় উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি। তারপর প্রথমদিনের মতো শুরু হয় কথার পীঠে কথা! তাঁর বিশদ কথাগুলো ছেচে নির্যাস বের করলে যা দাড়ায় তা- নিছক নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ছাড়া কিছুনা। আর প্রত্যেকটি কথাকে আপাত অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও এর রয়েছে তাত্ত্বিক দিক। আমি বুঝতে পারি গালমন্দগুলো তাঁর ভেতরে জমে থাকা রাগ ও আভিমান ঝেড়ে ফেলার পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু না। একনাগাড়ে কথা বলে একসময় হাঁপাতে থাকেন তিনি। এবার আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে চাঁপা দীর্ঘশ্বাস...
প্রাত্যেহিক জীবনে অনেক ঘটানার মুখোমুখি হই আমরা। অসংখ্য ঘটনার ভীড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ভুলে যাই। ঠিক ভুলি না, বলা যায় স্মৃতির অতলে লুকিয়ে রাখি ঘটনাগুলো ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। সেরকমই আমার পড়ালেখার নিত্য চাপে বুড়ো রিকশাচালকের কথা স্মৃতির অতলে চলে যায়। মাঝেমাঝে মনে পড়লেও স্টাডির রেসে ঐ ব্যাপারটা পেছনে পড়ে যায়।
এসএসসি পরীক্ষার পর কোন একদিন বাড়িতে কথাচ্ছলে মনে পড়ে রিকশাচালককে। লোকটির কথা বাবাকে জানাই। বাবা তাঁর সম্পর্কে যে তথ্য দিলেন তা শুনে শুধু অবাকই হলাম না, রীতিমত অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো দেহমনে।
লোকটির নাম 'নিতু পাগলা'। আতাউর রাঃমান নিতু। পাগল নয় কিন্তু বেশি কথা বলে এ জন্য সবাই পাগলা ডাকে। তাঁকে 'নিতু পাগলা' নামে ডাকলে রাগ করেনা বরং খুশিই হয়। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি- 'এই দুনিয়ায় সবাই পাগল, পাগল বলছো কারে রে মন।'
নিঃসন্তান এই মানুষটির সবচেয়ে বড় পরিচয় সে রণাঙ্গনের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৭১'সালে বেশ কয়েকবার সম্মুখ সমরে সে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছে। শত্রুর স্প্রীন্টারের আঘাতের চিহ্ন তার সারা দেহজুড়ে...
বাবার কথা শুনে আমি চমকে উঠি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকটি? এজন্যই বুঝি সেইদিন বলেছিল- ''-জীবনডা হুদাই খুয়াইলাম"?
কথাগুলো মিলে যাচ্ছে। লোকটি এত কথা বলে কিন্তু সরাসরি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা কেন বলেনি? নাকি আমাদের রাজনীতিবিদদের মত দেশপ্রেমের ফিরিস্তি গেয়ে ফিরা তাঁর পছন্দ না? আমার ভিতরে একধরনের অনুশোচনা কাজ করে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা দেইনি! আমার বুকের ভেতরে চাপা কান্না ঘোর পাঁকায় কিন্তু চোখে নয়। কি কষ্টময় জীবনযাপন করছে লোকটি! স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁকে এই প্রতিদান দিলো?
আমি বলতে না পারা একধরনের মনোকষ্ট নিয়ে থাকি। মুক্তিযোদ্ধ নিয়ে যখনই অহংকারবোধ কাজ করে তখনই 'নিতু পাগলা' ও তাঁর জীবনবোধ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার অহংকারবোধ স্থায়ী হয়না। তা চাপা পড়ে একজন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার জীবন সংগ্রামের কষ্টের কাছে, রিকশার কাছে, ঘামের কাছে! আমি মনে মনে খুঁজতে থাকি 'নিতু পাগলা'কে কোথাও পাইনা। যখন আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতাম তিনি নিজে এসে সামনে দাড়াতেন আর আজ আমি তাঁকে খুঁজছি অথচ তিনি উধাও...
এভাবে কেটে যায় দিন। বদলায় জীবন। সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই ভুলে যাই কিন্তু ভুলিনা 'নিতু পাগলা'কে। মাঝেমাঝে ভাবি সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দেই পত্রিকায়। কিন্তু লোকে হাসাহাসি করবে ভেবে, অথবা কেন সন্ধান চাই, কি লিখবো ভেবে আর বিজ্ঞাপন দেইনা।
ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্টের পর বিভিন্ন ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে দিতে যখন রীতিমত ক্লান্ত, তখন একদিন বিকেলবেলা পরিশ্রান্ত দেহ নিয়ে মেসে ফিরছি। পাড়ার মোড়ে আসতেই হঠাৎ কিছু লোকের ঝটলা চোখে পড়ে। দ্রুতপায়ে সেদিকে এগোই। ভিড় ঠেলে ভিতরে উঁকি দেই। রাস্তায় শুইয়ে রাখা হয়েছে একটি রক্তাক্ত দেহ। সমস্ত শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে। এটি বাংলাদেশের চেনা দৃশ্য! সড়ক দূর্ঘটনা এখানে হরদমই ঘটে। লোকটির নিথর দেহ দেখে মনে হয়না বেঁচে আছে। অন্যপাশ ফিরে থাকিয়ে আমি তো থো! এ যে 'নিতু পাগলা'! আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো অস্ফুট চিৎকার!
প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানালো- 'একদল সন্ত্রাসী একজন মহিলাকে জোর করে তোলে নিচ্ছিলো। রাস্তায় অনেক লোক দাড়িয়ে দেখছিলো। মহিলা চিৎকার করে তাকে রক্ষার আকুতি জানালেও কেউ এগিয়ে আসেনি। হঠাৎ গর্জন দিয়ে ছুটে আসেন ঐ বুড়ো রিকশাওয়ালা। পাঁচ পাঁচটা সন্ত্রাসীর সাথে একাই লড়ে গেলেন। দুইটাকে লাই মেরে ফেলে দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই অন্য একটা সন্ত্রাসী একপাশ থেকে ছুরি চালায় পেট বরাবর। রিকশাওয়ালা রক্তে ভাসছিলো কিন্তু ছাড়ছিল না হায়েনাগুলোকে। একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বেচারা। সন্ত্রাসিগুলোও সবার চোখের সামনে দিয়ে পালায়।'
প্রত্যক্ষদর্শীর কথা শুনে আমার চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। আমারও চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। আমি চিৎকার করতে পারিনা। গলা শুকিয়ে যায়। হে বীর- একাই লড়ে মরলে? খোদ মৃত্যু দিয়ে দেখিয়ে দিলে কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলে?
আমার অনুভুতির কথা, অনুশোচনার কথা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার কথা জানাতে পারলাম না দেশ, সমাজের জন্য সদা দিয়ে যাওয়া এই 'নিতু পাগলা'কে। দিয়ে যাওয়া যার জিনে, মনে, মস্তিষ্কে তিনি কি করে নেবেন! স্বাধীন স্বদেশে একটা সাধারণ মহিলাকে পরাধীনতার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করলেন তিনি। এদেশের সকল শ্রেণীর সকল পেশার লোকগুলোর চরম সুবিধাবাদীতা কে উপহাস করে নিতু পাগলা চলে গেলেন না ফেরার দেশে...
আজ এতোটি বছর পর মনে হচ্ছে, তাঁর জন্য কিছু করতে পারিনি- রিকশাটি অন্তত সংরক্ষণ করতে পারতাম। কিন্তু করিনি, কেউ করেওনি। কেন করবে! আমরা তো লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে চলা মানুষ। 'নিতু পাগলা' দিয়ে আমাদের আলাপ চলে- স্বার্থ চলে না, আমরা পদ পেলে দল ও দেশসেবা নিয়ে ভাববো। অর্থ পেলে ভোগ-ত্যাগের অর্থ খুঁজবো। নাহলে নিজের খেয়ে বনের মোষ পুষবো কোনদূঃখে! নিতু পাগলারা তাদের মত বাঁচুক-মরুক। এদের দেখার সময় আমাদের কই!