আমার এক সহপাঠী। ইউরোপের মেয়ে। ঘুরতে পছন্দ করে। তাকে বললাম, বাংলাদেশে বেড়াতে যেতে পারো। তার পাল্টা প্রশ্ন, সেখানে কী মেয়েরা নিরাপদ। কী বলবো। আমতা আমতা করছিলাম। বললাম, ক্ষমতার যে দিকে তাকাবে নারীদেরকেই দেখতে পাবে। সে শুনে গুগল সার্চ দিলো। একগাদা ভিডিও হাজির। নারী শিশু ধর্ষণ নিয়ে এসব ভিডিও। আমার মুখটা দেখার মতো হয়ে গেলো। আমার ধারণা- এরপর সে বাংলাদেশের কোন ছেলের সাথে কথা বলতে একবার চিন্তা করবে। দিল্লীতে ধর্ষণের পর ভারতের অনেক ছাত্রের স্কলারশিপ বাতিল করেছিল বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। স্কলারশিপগুলোর বেশিরভাগ নির্ধারণ করেন অধ্যাপকরা। যেদেশে এত ধর্ষণ, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এত মারামারি সেদেশ বা সেরকম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের ঝুঁকি নিয়ে তারা ছাত্র কেন আনতে যাবেন।
দক্ষিণ কোরিয়াতে ভর্তি হওয়ার পর সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বিষয়ে একটা মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থাপন করা হয়, কোরিয়াতে কোন ধর্ষণ নেই। জাপানেও একই অবস্থা। কোন ধর্ষণ নেই। এরপরেই তথ্য উপস্থান করা হয়, শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্ট দেশের। এরপর বলা হয়, কোরিয়ার মেয়েদের সাথে এগুলো করা যাবেনা। আগের বেশ কিছু সত্য ঘটনা অবলম্বনে ভিডিও নাট্যও দেখানো হয়। লজ্জায় মাথা এমনিতেই নিচু হয়ে যায়। দেশে ধর্ষিত হলে তা সীমানার মধ্যে রাখার দিন শেষ। আমাদের দেশের তথ্য দেখে আমি অবাক। এত ধর্ষণের মামলা। আমি ডিফেন্ড করে বললাম, বেশিরভােগর ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক চলছিল। পরে সম্পর্কের অবনতি হলে মেয়ে ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে দিয়েছে। আমাদের আইন এভাবে ধর্ষণের মামলা বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তবে মেয়ে শিশু ধর্ষণের ব্যাপারটা ডিফেন্ড কীভাবে করবো। কোন যুক্তি নেই। বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজে কোন দেশে একজনের গায়ে বেআইনী একটা আঘাত, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এসব সংঘটিত হওয়ার অর্থ হলো- বিশ্বের কোন একটা সূচকে দেশের একধাপ নিচে নেমে যাওয়া। এটা অন্য কোন দেশে যেতে গেলে সেদেশের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার পাসপোর্ট হাতে নেয়ার দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়।
এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারির বিষয়ে। বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সার্চ দিলে ভালো কোন আবিস্কার বা গবেষণার খবর পাওয়া যায়না। মারামারির বিভৎস চিত্র ভেসে ওঠে। বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত হাতুড়ি পেটা থেকে শুরু করে পৈশাচিক সব ধরণের বিবরণ দিয়ে মারামারি আর খুনের তথ্যে ভরা রিপোর্টগুলো পাওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথম পা রেখেছিলাম, অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। আমি তখন রেজিস্ট্রার ভবনে ভর্তির টাকা জমা দিয়ে ফিরছিলাম। মলচত্বরে লাল্টু পিন্টু গ্রুপের তুমুল গুলিবর্ষণ শুরু হলো। আধঘন্টা ধরে চলেছে গোলাগুলি। ফলাফল দুইজন স্পট মার্ডার। শিক্ষা ব্যবস্থার কথা কী বলবো। না পড়লেও চলতো। পরীক্ষার একমাস আগে পুরানো কিছু বাংলা নোট। দেখেই পরীক্ষার হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হতে পারে ধরেই নিতে হবে তাদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা আছে। একারণে তাদের না পড়লেও চলে। শুধু পরীক্ষার আগে পড়ে সহজেই পার পেয়ে যায়। এখন হয়ত সেমিস্টার সিস্টেম চালু হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে বলে মনে হয়না। আমার মতে, দেশের বিশইবদ্যালয়ের চিত্র মুহূর্তে তুড়ি মেরে পাল্টে দেয়া সম্ভব। এজন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবেনা। কোন শাস্তি বৃদ্ধির দরকার নেই। শুধু আন্তর্জাতিক মানটা লেখাপড়ায় এনে দিতে হবে। ব্যস। কীভাবে?
আমি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছি, পরে আবার রেক্টরের পিএসও ছিলাম। সেখানে ২৫-২৬টি ক্যাডারের অফিসাররা প্রশিক্ষণ নেয়। এদেরকে এক মুহূর্তও বেকার থাকতে দেয়া হয়না। একটু ফ্রি থাকলে ইউনিভার্সিটির মতো ক্যাডারে ক্যাডারে মারামারি হতো। পাস করতে হলে অন্য চিন্তা করার সুযোগ সেখানে দেয়া হয়না। এই কোরিয়াতে যেখানে পড়ছি, স্টুডেন্টদের শুধু পড়তেই দেখা যায়। আড্ডা দেয়ার সময় কোথায়? আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিক্স বিষয়ে অনার্স আর মাস্টার্সে যা পড়ানো হয়, আমার এখানে তিন মাসে তা শেষ করেছে। বুঝতেই পারছেন। মাথার ওপরে জোনাক জ্বলে। তার ওপর পচিশভাগের বেশি এ গ্রেড দিতে পারেন না প্রফেসর। সিস্টেম গ্রহণ করেনা। এজন্য প্রশ্ন যত কঠিন করা যায়- প্রফেসর তা করেন। আমাদের দেশে সহজেই মাস্টার্স পাস করা যায়, কোন থিসিস ছাড়া, গবেষণা ছাড়া। উচ্চ শিক্ষা এভাবে নিম্নশিক্ষার মতো সহজ করার সাইড অ্যাফেক্ট হচ্ছে এসব মারামারি। তেল আর ঘি এক দাম হওয়ার ফলাফল এসব।
এমআইটি বা হার্ভার্ডের কোর্স কারিকুলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করে দিন, সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা চালু করুন। প্রকাশযোগ্য গবেষণা নিশ্চিত করুন। দুই তিনবারের বেশি টাইম ফেল করলে আটোমেটিক সিস্টেম থেকে নাম বাদ যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন, কিছু লাগবেনা। অটৈামেটিক সব ঠিক হয়ে যাবে। মারামারি কেন ছেলেমেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকাতেও সময় পাবেনা। গ্যারান্টি। শিক্ষকরা শিক্ষা ক্ষেত্রে পারদর্শী। একজন আমলা সাত জন্ম নিলেও একজন প্রফেসরের মতো হতে পারবেননা। আবার একজন শিক্ষককে আমলার পদে দেয়ার জ্বালা দেশের মানুষ বাংলাদেশে ব্যাংকের ঘটনায় কেয়ামত পর্যন্ত মনে রাখবে। কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্ব মডেল হিসেবে একজন আমলাকে দিয়ে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে প্রশাসনে এসেছেন, আজীবন প্রথম হয়েছেন, এমন অফিসারও প্রশাসনে আছেন। তাদের একজনকে কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দিয়ে দেখা যেতে পারে। পরিবর্তনটা তখনই চোখে পড়বে। আর তা হলো- এটা বাংলাদেশে করা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত মেধাবি।
সাউথ কোরিয়া
২৩ ডিসেম্বর ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:৪৫