ফেসবুকে এখন ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ডস-এর এলিট ফোর্স কুদস ফোর্স বাহিনীর প্রধান কাসেম সোলাইমানির ছবি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পরই তার নাম জানতে পেরেছেন। এরপর শোক জানাচ্ছেন। কেউ ইসলামের দৃষ্টিতে বিচারের চেষ্টা করছেন। হঠাৎ করে তার জন্য আবেগ উথলে উঠেছে। এজন্যই আমার এ লেখাটা। সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের দেশের মানুষ ইসলাম শুনলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেটা কী দীন ইসলাম নাকি কোন ব্যক্তি নূর ইসলাম সেটা বুঝতে পারেননা। সমস্যাটা এখানেই। সোলাইমানির জন্য শোক জানাবেন না চুপ থেকে পর্যবেক্ষণ করবেন সেটা বুঝতে হলে, দুইটা বিষয় বুঝতে হবে। এক হলো শিয়া ও সুন্নী সম্পর্ক। আরেকটি হলো ইরাক-ইরান ও আরবের আঞ্চলিক রাজনীতি। বিশ্লেষণ করতে হবে- ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং তার পরবর্তী ইরাকের শাসনামল।
প্রথমে আমি শিয়া ও সুন্নীদের বিষয়ে একটা ধারণা দিতে চাই। আমরা বাংলাদেশে বেশিরভাগ সুন্নী। শিয়াও কিছু আছে। তবে এদেশে তারা সংখ্যায় খুব কম। পুরাতন ঢাকায় হোসনি দালানকে কেন্দ্র করে তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে। আর মোহাম্মদপুরে বিহারী ক্যাম্পে কিছু আছে। স্বল্প এসব মানুষের কী যে জ্বালাতন তা ওই এলাকার লোকজন বুঝতে পারেন। একারণে বেশ কয়েকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় মানুষ বিরক্ত হয়ে তাদের ওপর হামলা করেছে। যাই হোক, তাদের সংখ্যাটা বেশি হলে- শিয়া কী জিনিস তা এদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেতেন। আসলে শিয়া কী? শিয়া অর্থ অনুসারী বা দল। এদের মধ্যে এত দল আর উপদল আছে, তা চিন্তাও করা যায়না। প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। এজন্যই তাদের শিয়া বলা হয়। শিয়াদের সাথে সুন্নীদের মুল পার্থক্য দুইভাবে। এক. সুন্নীরা মনে করে আমাদের ইজতেহাদ করার ক্ষমতা শেষ। ইজতেহাদ মানে মাসয়ালা উদ্ভাবন করার ক্ষমতা। এটা সাহাবী তাবেয়ী আর তাবে তাবেয়ীর যুগ পর্যন্ত ছিল। আমরা সুন্নীরা এজন্য মাজহাব মানি। মাজহাবের প্রবর্তকগণ তাবেয়ী বা তাবে তাবেয়ী ছিলেন। তারা যে মাসয়ালা দিয়ে গেছেন সেগুলো অনুসরণ করি। অথবা কেয়াস করি। অন্যদিকে শিয়ারা যেহেতু এখনো ইজতেহাদ করেন, সেজন্য তারা একজন জীবিত ইমামকে মানেন। যতজন ইমাম তত পথ। তত মতবাদ। শিয়াদের ইমামরা প্রভাবশালী। সাদ্দাম পরবর্তী একজন ইমাম বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন ইরাকে। তার নাম মুকতাদা আল সদর। তার পিতাও ছিলেন ইমাম। তাকে সাদ্দাম হোসেন হত্যা করেছিলো। যাই হোক, আরেকটি পার্থক্য হলো- এদের আকীদা বা মতবাদ। আগেই বলেছি, তারা বহুদলে বিভক্ত। সবচেয়ে গোঁড়া মত হলো- জিবরাইল ভুল করেছিলেন, আসলে ওহী দেয়ার কথা আলী রা. এর কাছে। ভুল করে তিনি হযরত মুহাম্মদ দ. এর কাছে গিয়ে ওহী নাযিল করেছেন। আর আমাদের কাছাকাছি বা নরম মতবাদ হলো- মহানবীর ইন্তেকালের পর খলিফা হওয়ার হকদার ছিলেন আলী রা.। তাকে খেলাফত না দিয়ে তিনজন খলিফা হযরত আবু বকর রা., হযরত ওমর রা. ও হযরত ওসমান রা. বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এজন্য শিয়ারা যখন হজ্জ্ব করতে যান, তারা মহানবীর রওজা জেয়ারেতর পর তিনজন খলীফার মাজারের দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন। হযরত আলী রা. এর রওজাই তারা সম্মানের সাথে জেয়ারত করেন। এদের নামাজ রোজাও একেক ইমামের অনুসারীরা একেক রকমের করে। বলতে গেলে দিন শেষ হয়ে যাবে। এই হলো বেসিক পার্থক্য শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে। যারা সুন্নী দাবি করছেন, তাদের দলও অনেক। মতভেদের অন্ত নেই। এদেশেই কেউ একদিন আগে রোজা, ঈদ পালন করে। কেউ বিড়ি খাওয়া ভালো কাজ মনে করে। আবার কেউ বলেন হারাম। কেউ মাজারের পক্ষে। কেউ বিপক্ষে। কেউ জামাতি। কেউ ওহাবি। কেউ সুফিবাদী। মাজারের ভক্ত। যাদেরকেই আমার সঠিক বলে মনে হয়। এরা ইতিহাসে কখেনোই ইসলামের নামে কোন উগ্র কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো না। এগ্রুপের সবাই নিজেদের সুন্নী দাবি করেন। তবে যেখানে সংখ্যায় বেশি শিয়া সুন্নী আছেন, সেখানে হানাহানি লেগেই আছে। দুদল ই দুদলের মসজিদে বোমা হামলা করে বহু মানুষ খুন করারও রেকর্ড আছে। থাক সেদিকটা।
আমি এবার ইরাকের রাজনীতির দিকে যাবো। ইরাকে ৬৪-৬৮ শতাংশ শিয়া মুসলমান। আর সুন্নী মুসলমান হলো ৩০-৩৪ শতাংশ। ইরাকের সাদ্দাম হোসনে ছিলেন সুন্নী। তার আমলে ইরাকে তিনটি গ্রুপ ছিল। ইরাকীদের মধ্যে একটি সুন্নী আরেকটি শিয়া গ্রুপ। আরেকটি কুর্দী গ্রুপ। কুর্দীদের সংখ্যা ২০ শতাংশ। এর পর আছে ইরাকি তুর্কী জনগণ। এবার তাহলে বুঝে নিন, মাত্র ২০-২৫ ভাগ মানুষের সাপোর্ট নিয়ে সাদ্দাম হোসেন কীভাবে রাজত্ব করেছেন? হিসাবটা সহজ। শাসন করতে গিয়ে যা দরকার তা করেছেন। কুর্দীরা সুন্নী হলেও ক্ষমতার লড়াইয়ে তাদের ইরাকি আরবীভাষী জনগণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। এই কুর্দী জাতির ইতিহাস পড়লে কান্না আসে। একটি জাতিকে ইরাক ইরান তুরস্কে বসবাস করতে হচ্ছে। তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ ভাগ কুর্দী। তারা নিজেদের রক্ষায় পিকেকে গঠন করেও সুবিধা করতে পারেনি। কালে কালে জীবন দিয়ে সংখ্যাই বাড়িয়েছেন। স্বাধীন জাতি হতে পারেনি। সাদ্দাম হোসেন ১৯৮৮ সালে উত্তরপূর্ব ইরাকের হালাবজা শহরে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে ৫ হাজারেরও বেশি কুর্দি নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেন। এতে পঙ্গু হয়েছিল দশ হাজার কুর্দি। সুন্নী হলেও কুর্দীরা ইরাক ইরানের যুদ্ধের সময় ইরানের শিয়াদের মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল। এ কারণেই তাদের দমন করেছিলেন সাদ্দাম হোসেন। যাই হোক, সাদ্দামের পতনের পর ইরাকে ৭০ টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা নিহত কুর্দিদের। সাদ্দামের পতনের পর আমেরিকা বিপাকে পড়ে যায়। কার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। শিয়ারা সংখ্যায় বেশি। কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়া হলে প্রকারান্তরে ইরানকে এনে বসিয়ে দেয়ার নামান্তর হবে। এটা আমেরিকা চাইতে পারেনা। এসময় কুর্দীদের জন্য দরদ উঠে আমেরিকানদের। কুর্দী হত্যাকে সামনে এনে মিডিয়া দিয়ে শোরগোল করা হয়। কুর্দীদের হত্যার বিচার সামনে চলে আসে। একারণেই নন আরব জালাল তালাবনিকে ক্ষমতায় বসায় তারা। জালাল তালাবানী একদিকে কুর্দী। সুন্নী মুসলমান। অন্যদিকে সাদ্দামের হাতে গণহত্যার শিকার কুর্দি জনগোষ্ঠির ক্ষোভ কাজে লাগাতে তাকে প্রয়োজন ছিল। এই অভিযোগেই সাদ্দামকে ফাঁসি দেয়া হয়। সাদ্দামের ফাসির পর জালাল তালাবানিরও চাহিদা ফুরিয়ে যায়। সংখ্যাগুরু শিয়া জনগণ জেগে উঠে। একসময় ক্ষমতা চলে যায়-নুরী আল মালিকীর হাতে। এই নুরী কামেল মালিকী শিয়া সম্প্রদায়ের। তার ক্ষমতা লাভের পর শিয়াদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ইরানের প্রভাব পড়ে ইরাকে। আমেরিকা দেখে হায়, এ কী করলাম! সাদ্দামকে হটিয়ে ইরানকে ক্ষমতাবান করে দিলাম। ইরাকের রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের কাছে চলে যায় বলে আমেরিকার প্রভাব কমতে থাকে। আমেরিকা একসময় ইরাক ছাড়তে বাধ্য হয়। তবে আমেরিকা প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়ে।
এদিকে সুন্নীদের একটি অংশ বৈষম্য আর ক্ষমতা হারানোর বেদনায় ক্ষুব্ধ ছিলো। আমেরিকা তাদেরকেই কাজে লাগাতে সিদ্ধান্ত নেয়। এটা এখন ওপেন সিক্রেট, যে আমেরিকার মদদেই গঠিত হয় দায়েস বা আইএস। তারা সুন্নী নামধারী একটা গ্রুপ। তবে ক্ষমতা দখলের পরপরই একটা মাজার ভেঙ্গে ফেলায় আমি নিশ্চিত হয়ে যাই তারা আর যাই হোক আমাদের মতো সুন্নী না। ওহাবী আর লামাজহাবীদের খিচুরি একটা গ্রুপ। তারা শিয়াদের হটিয়ে ইরাকের কিছু অংশ দখলও করে নেয়। আইএস ইরাক ও সিরিয়ার একটি অংশ দখলের পর অনেক গ্রুপ এখানে সম্পৃক্ত হয়। ফলে কয়েকমুখী দ্বন্দ্ব আর সংঘাত লাগে। কে কাকে যে আক্রমণ করে তা ঠিক করাই কঠিন ছিল। আমি নিজে ফলো করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। তবে একটি ছিল আসাদের পক্ষে আরেকটি আসাদের বিপক্ষে। এভাবে ধরে নিলে ইকুয়েশন করতে সুবিধা হয়। এখানে ধর্ম উদ্দেশ্য ছিলনা, সবই যার যার স্বার্থে আইএস এর পক্ষে বিপক্ষে যোগ দেয়। আইএসকে দিয়ে দুটি কাজ করার উদ্দেশ্য ছিল। একটি হলো ইসলাম ধর্মের শান্তি ভাবমুর্তিতে আঘাত করা। দ্বিতীয় হচ্ছে, শিয়াদের শায়েস্তা ও আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা। আমেরিকা আইএসকে একটা সুযোগ হিসেবে নেয়। তারা ভাবে আইএস ব্যবহার করে নিজ দেশের বিরোধী লোকজনকে দিয়েই আসাদকে ক্ষমতা থেকে হটানো যাবে। পরে আইএস দমনের নামে ইরাকে আবার আক্রমণ করা যাবে। কিন্তু তার আগেই আইএসের বিরুদ্ধে কয়েকমুখী যুদ্ধ শুরু হয়। যোগ দেয় ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়া। এখানে আর উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারেনি আমেরিকা। কারণ হলো ইরান। আর এখানেই দেখা মিলবে সোলায়মানির। সোলায়মানি ইরানের অফিসার। আইএস বিরোধি যুদ্ধে তিনি পড়ে থাকতেন ইরাকে আর সিরিয়ায়। সেলায়মানির কৌশলের কাছে আইএস যেমন ধরা খেয়েছে, তেমনি আমেরিকার কৌশলও কোন কাজে আসেনি। আইএস বিরোধী যুদ্ধ থেকে কম ফায়দাই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সিরিয়ার বাশারকে ক্ষমতা থেকে নামানো যায়নি। সব ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে সোলায়মানির উপরে। এজন্য ইরাকেই মারা হয়েছে তাকে।
এবার আসি সোলায়মানি কী করেছেন। তিনি লেবাননে হিজবুল্লাহ তৈরি করেছেন। হিজবুল্লাহ শিয়াদের সংগঠন। হামাস গঠনেও তার ভূমিকা আছে। দুটি সংগঠনই মুসলমানদের কোন উপকার করতে পারেনি। উল্টো তাদের কারণে অগণিত মুসলমানদের রক্তক্ষয় হয়েছে। হামাসতো ফিলিস্তনকে দ্বিখন্ডিত করে শক্তি কমিয়েছে ফিলিস্তিনি অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক সংগ্রামকে। ইয়ামেনের যুদ্ধে হুতিদের পেছনেও আছেন তিনি। সেখানে সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরছে। আইএস দমনের নাম করে ইরাক সিরিয়ায় অনেক সুন্নী মুসলমানের রক্তের দাগ আছে তার হাতে।
কথা হলো- শিয়ারা জিতলে সুন্নীদের লাভ কী! আসলে কোন লাভই নেই। আমার কাছে সোলাইমানির ব্যাপারটার সাথে ধর্মের কোন যোগসূত্রই নেই। আছে রাজনীতির যোগসূত্র। দেশের স্বার্থ। শিয়াদের স্বার্থ। এ অবস্থায় সোলায়মানি হত্যাকান্ডে আমরা কী নিন্দা জানাবো না কী চুপ থাকবো! আমার মতে, যেহেতু ইসলাম ধর্মের কোন বিষয় না, যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াদের প্রভাব বাড়ানোর একটি মিশনে যুক্ত ছিলেন সোলাইমানি, সেহেতু সুন্নী মুসলমান হিসেবে আমাদের আগ বাড়িয়ে শোক দেখানোর কিছু নেই। আমার মতে, আমরা যেখানে সংশ্লিষ্ট নই সেখানে আমাদের চুপ থাকাটাই শ্রেয়। না জেনে শুধু শুধু ইসলামকে টেনে আনার মানসিকতা সবার জন্য ক্ষতিকর।
দক্ষিণ কোরিয়া,
৪ জানুয়ারি ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:৫২