somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এবারের বাবা দিবসে আমার লেখা: বাবার কাফনে হয় পুত্রের দাফন

০১ লা জুলাই, ২০২১ রাত ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.০
বাবারা চলে যান৷ চিরদিন কারো বাবা থাকেনা৷ বাবা থাকতেও বুঝা যায়না৷বাবার সাথে মন খুলেও কথা বলা হয়না৷বাবা যতদিন বাঁচেন পুত্র ততদিন বাঁচেন৷ এই সত্যটি বাবা চলে গেলেই পুত্ররা বুঝতে পারেন৷ বুঝতে পারেন কী হারিয়েছেন। বাবা থাকতে পুত্ররা প্রাপ্তবয়স্ক হয়না। বাবা চলে গেলেই পুত্রের উড়নচন্ডী স্বভাব চলে যায়। কয়েকদিন আগে ভারতীয় অভিনেতা পিযুষ ত্রিপাঠির একটি হিন্দী কবিতা শুনলাম। চমৎকার করে বলেছেন৷ আমি ভাবানুবাদ করেছি এরকম।

মাকে নিয়ে পুত্রের বহু লেখালেখি, বাবাকে নিয়ে নয়,
মা সহজেই সবসময় বলেন- ভালোবাসি, বাবা নির্দয়।
মা বহু দিন পুত্রকে গর্ভে ধরেন তার কষ্টটা দেখা যায়,
বাবাও সন্তান চিরদিন বয়ে চলেন, মাথায়; নির্দ্বিধায়।
বাবা মারা গেলে কবরে রাখা হয় মুড়িয়ে সাদা কাফন
বাবার দেহ নয়, কাফনের ভেতরে হয় পুত্রের দাফন৷
পুত্রের ভেতরে ধীরে ধীরে খোদিত হয় বাবার শরীর
পুত্র নিজেকে হারিয়ে বাবার চেহারায় হয় ধীরস্থির।

যাই হোক পিতার সাথে পুত্রের সম্পর্কটা আত্মিক৷ পারষ্পরিক প্রয়োজনের। শৈশবে পুত্রের কাছে পিতা ভীষণ প্রয়োজনের। সিগমন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘আমি শৈশবের কোন প্রয়োজন পিতার প্রয়োজনের মতো এত শক্তিশালী ভাবতে পারিনা।’ আসলেই ছোটবেলায় বিপদে পড়লেই মনে হতো পিতাই বাঁচাতে পারবেন। মজার কথা হলো- বয়স বাড়লে সেই পিতার সাথেই মতপার্থক্য তৈরি হয়। পিতার কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যান পুত্র।

পিতারা চান পুত্র তার মতো হোক। চিন্তায় চেতনায়। পরম্পরায়। অথচ পুত্র বড় হলে তার জগতে পিতার প্রভাব কমতে থাকে। আর এদিকে দুজনে দূরে সরে যেতে থাকেন। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট বলেছিলেন, আমি বেঁচে থাকার জন্য পিতার কাছে ঋণী। তবে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য শিক্ষকের কাছে ঋণী। তবে কী আলেকজান্ডারও পিতার আদর্শ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। তিনি তার পিতাকে ভুলতেই পারেন। কারণ তার শিক্ষক ছিলেন দার্শনিক এরিস্টেটল৷ তার প্রভাব ফেলনা নয়। পিতা পুত্রের মধ্যে সম্পর্কের এ কঠিন দিকটা স্বীকার করেছিলেন সালমান রুশদিও। আমার বেলায় কী আর হতে পারে! আমার সাথেও আব্বার চিন্তা চেতনার বিস্তর ফারাক ছিল। তিনি ট্রাডিশনাল৷ আমি আধুনিক৷ তবে দুজনেই সুফিবাদি৷ আমি নিশ্চিত এই পার্থক্যের কারণ বিশ্বায়ন৷ তবে সবাই এমন হয়না। যেমন আইরিশ অভিনেতা স্পাইক মিলিগান। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পিতা আমার উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি পাগল ছিলেন।’ যাক পিতার পাগলামি পুত্রের উপর ভর করেছিলো বলে পুত্র বিশ্বের সেরা একজন অভিনেতা হতে পেরেছিলেন। কজনেরই এমন ভাগ্য হয়। তবে আমার মনে হয় বেশিরভাগই এমন। বাপ কা বেটা।

২.০
পৃথিবীতে সম্ভবত এমন কেউ নেই যে বাবাকে নিয়ে কিছু বলেনি। চাণক্য সেনের দুটি উপন্যাস পড়েছিলাম। ‘পুত্র পিতাকে’ আর ‘পিতা পুত্রকে’। বলা যায়, পুত্রের কাছে পিতার আর পিতাকে বলা পুত্রের অসাধারণ চিঠি। অধ্যাপক পিতা তার পুত্রের নাম রেখেছিলেন শ্বেতকেতু। উপনিষদ থেকে নামটা ধার করে রাখা হয়েছিল। সেই বাবা তার পুত্রের বন্ধু হতে চেয়েছিলেন। তবে গল্পটা পড়ে মনে হবে দুজনের কাছ থেকে দুজনের বিচ্ছিন্নতার গল্প এটি। অথচ ভেতরে টের পাওয়া যায় অসম বয়সী দুই প্রজন্মের অটুট বন্ধন। শেকড়ে ফেরার কাহিনী। কখনো উচ্চারণে আবার কখনো নিরবতায়। পাঠকের তা পড়তে একটুও কষ্ট হয়না। রবীন্দ্রনাথের গল্পে পিতা পুত্রের চিন্তা, চেতনা, রুচি, আদর্শ ও ভাবনার পার্থক্য দেখা যায়। ‘দেনাপাওনা’ গল্পে রায় বাহাদুরের সাথে তার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ফুটে উঠে। এ যেন প্রজন্মের সাথে প্রজন্মের ব্যবধান। পিতা পুত্রের এই বিরোধ দেখতে পাই তার ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পে। এ গল্পে সম্পত্তি নিয়ে পুত্রের প্রতারণা ফাঁস করে দিয়ে পিতা নিজের জীবন দেন। পিতা তার আদর্শ ধরে রাখেন। আবার ‘যজ্ঞেশ্বরের গল্পে’ উল্টাটা দেখা যায়। পিতার কুটিলতা পুত্রের মহানুভবতার কাছে হার মানে। ‘হালদার গোষ্ঠি’ গল্পে তো পিতা পুত্রের দ্বন্দ্ব গোষ্ঠিগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ছেড়ে পুত্রের চাকরির খোঁজে রওয়ানা দেয়ার দৃশ্য এ গল্পে অনেক বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলেছে।

এটা শুধু কী বাঙালি পিতা পুত্রের আখ্যান। দেখে আসি বিশ্ব সাহিত্যে। নোবেলজয়ী জাপানি বংশোদ্ভত বৃটিশ লেখক কাজু্‌ও ইশিগুরোর ১৯৮৩ সালে লেখা ‘এ ফ্যামিলি সাপার’ গল্পটা পড়ে আসি। গল্পে দেখা যায়, দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানের পর পুত্র জাপানে ফেরে। বাড়িতে ফিরে দেখে তার মা ফগু মাছ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। অন্যদিকে তার পিতার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। ঠিক এমন একটি সময়ে পিতার সাথে পুত্রের সাক্ষাত হয়। কথা হয়। তবে পিতার সাথে পুত্রের সম্পর্কের যে সুতা তা যেন কোথাও ছিড়ে গেছে। পিতা চান তার পুত্র জাপানি ঐতিহ্যে ফিরে আসুক। তার কাছে থাকুক। কিন্তু বলতে পারেন না। কোথায় যেন আটকে যান। মা নেই। পুত্র চলে গেলে পিতাও হয়ত তার মায়ের মতো আত্মহত্যা করবেন। গল্পে পিতা পূত্রের এমন অবস্থান একটা ট্রাজেডির মতো। পুত্রের নির্লিপ্ত অবস্থানে পাঠকের মন ভেঙ্গে যাবে। লেখক হয়তো এটা চেয়েছিলেন। পাঠক পিতা পুত্রের সম্পর্কের সুতা ছেড়ার কষ্ট বুকে ধারণ করবেন। পিতা পুত্রের মধ্যে প্রতিযোগিতাও আছে। শাহনামা মহাকাব্যের সোহরাব রুস্তম পড়ে কত চোখের পানি ফেলেছি। বীর রুস্তুম জানতেননা সোহরাব তারই পুত্র। এক পর্যায়ে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। পিতা পুত্র সমানে সমান। কেউ কাউকে হারাতে পারেন না। একপর্যায়ে পিতা প্রতারণা করে পুত্রকে হারিয়ে তাকে তরবারিতে বিদ্ধ করেন। মৃত্যুর আগে সোহরাব জানতে পারেন, রুস্তুমই তার পিতা। পিতার পরিচয় জেনে মরণেও খুশী হন সোহরাব। আরবীতে একটি প্রবাদ রয়েছে, কুল্লু শাইয়িন ইয়ারজিও ইলা আসলিহি। প্রত্যেক জিনিস তার মূলে ফিরে যায়। নিজের পরিচয়ের মূলটাই পিতা। মূলের পরিচয় পেলে মরণেও শান্তি মেলে।

পিতা পুত্রের মধ্যে এ ধরণের যোগাযোগহীনতার উদাহরণ দেখতে পাই গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকে। এই নাটকে দেখা যায়, থিবস নগরের রাজা লাস তার পুত্র ইডিপাসকে হত্যা করতে উদ্যোগী হন। কারণ তিনি জানতে পারেন, তার পুত্র ইডিপাস তাকে হত্যা করবেন এবং তার স্ত্রীকে অর্থাৎ ইডিপাস তার মাকে বিয়ে করবে। এটা জানতে পেরে লাস এক রাখালকে শিশু ইডিপাসকে হত্যার দায়িত্ব দেন। তবে রাখাল ইডিপাসকে বাঁচিয়ে রাখে। শিশুটিকে তুলে দেয় আরেক দেশের রাখালের হাতে। সেই রাখাল তাকে কোরিন্থ নগরের নিঃসন্তান রাজা পলিবাসের হাতে তুলে দেয়। ইডিপাস বড় হয়ে জানতে পারেন, তিনি তার পিতাকে হত্যা করে মায়ের শয্যাসঙ্গী হবেন। এটা তিনি মানতে পারেননা। রাজা পলিবাস ও রাণি মেরোপির স্নেহ থেকে পালিয়ে যান। ইডিপাস জানতেন তারাই আসেল পিতামাতা। তাদের থেকে পালিয়ে গিয়ে ভাগ্যকে এড়াতে চেয়েছিলেন। অথচ পালিয়ে এসেছিলেন থিবসে। এরপর ঘটনাক্রমে নিজের পিতাকেই হত্যা করেন। প্রথা অনুযায়ী পরাজিতের স্ত্রী অর্থাৎ নিজের মাকে বিয়ে করেন৷ পরবর্তীতে ইডিপাস সবকিছু জানতে পেরে জামার সেফটি পিন দিয়ে নিজের চোখ নষ্ট করে দিয়ে পিতৃ হত্যার প্রায়শ্চিত্য করেন৷

পিতৃহত্যাকে ইংরেজিতে বলে প্যাট্রিসাইড। উইকিপিডিয়াতে পুত্রের হাতে নিহত ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকা রয়েছে। সিংহাসনের জন্য আওরঙ্গজেব তার পিতা শাহজাহানকে বন্দী করেছিলেন। বন্দী অবস্থাতেই পিতার মৃত্যু হয়েছিলো। এ ঘটনা আমরা জানি। জীবনানন্দ দাস তার কবিতায় বিম্বিসারের কথা বলেছিলেন। বিম্বিসার ছিলেন মগধের রাজা। তার পুত্রের নাম অজাতশত্রু। সেই অজাতশত্রু নিজের বাবা বিম্বিসারকে আটকে রেখে সিংহাসন দখল করেছিলেন। নিজের যাতে আর কোন শত্রু না থাকে তা নিশ্চিত করতে বাবাকেই হত্যা করেন। ইতিহাস দিয়ে কী করবো। পত্রিকা খুললে পিতার হাতে পুত্র অথবা পুত্রের হাতে পিতা নিহত এরকম খবর হরহামেশাই দেখা যায়। এতে এতটুকুও কমেনি পিতাপুত্রের আপত্য স্নেহের বজ্রকঠিন বন্ধন। যুগ যুগান্তর চলে গেলেও পিতাপুত্রের সম্পর্কের বন্ধন এতটুকুও পুরানো হয়না। নির্ভেজাল সত্য সম্পর্ক।

৩.০
একজন উর্দু কবি বলেছিলেন, জিস তারাহ কি জিন্দেগি গুজারি ম্যায় খোদ গুজার নেহি সেকতা, কর্যদার হো বাপ কা আপনে আওর ইয়ে কর্য ম্যায় উতার নেহি সেকতা। ‘যেভাবে জীবন পার করেছি সেভাবে পার করার কথা নয়, পিতার কাছে আমি চিরঋণী আর এই ঋণ পরিশোধ হওয়ার নয়।’ আসলেই পিতার ঋণ শোধ হয়না। পিতা পুত্রের সম্পর্কে পিতা নিজের সবটুকু নিঃশেষ করে নীরবে দিয়ে দেন। এমন কী জীবনটাও দিতে পারেন। পুত্রেরা দিতে গেলে হয় উল্টা। সেক্সসপিয়ার বলেছিলেন, হোয়েন অ্যা ফাদার গিভস টু হিজ সান, বোথ লাফ; হোয়েন অ্যা সান গিভস টু হিজ ফাদার বোথ ক্রাই। বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য সব পুত্রের হয়না। যাই হোক মোগল সাম্রাজ্যে চলে যাই। কবি গোলাম মোস্তফা ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায় তুলে ধরেছেন মোগল সম্রাট বাবর আর তার পুত্রের এমনই এক আপত্য স্নেহের গল্প। ভারতের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ দি মুঘলস অব ইন্ডিয়া বইয়ের লেখক হারবানস মুখিয়াও এটি ঐতিহাসিক সত্য বলেছেন। যাক গল্পটা সংক্ষেপে শুনে আসি।

মোঘল সাম্যাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের জীবন ছিল সংগ্রামী। খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে নিশ্চিন্তে ভারতে বসবাসের জন্য সম্রাট বাবর কাবুল দুর্গ থেকে তার পরিবারকে আগ্রা নিয়ে আসেন। এর তিন মাস পরেই পেটের অসুখে পুত্র আলোয়ার মির্জা মারা যান। মুঘল পরিবার শোকে হতভম্ব হয়ে পড়ে। বাবর ধোলপুরে চলে যান। তবে সেখানে গিয়ে দিল্লি থেকে মাওলানা মুহাম্মদ ফারঘালির একটি পত্র পান। পত্রে আরেক পুত্র হুমায়ুনের অসুস্থতার খবর পান। বাবর ভেবে রেখেছিলেন, হুমায়ুন তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন। বিজয়ী হয়েছেন। হুমায়ুনই হবেন ভারতের পরবর্তী অধীশ্বর। মোগলদের রাজধানী তখন আগ্রায়। হুমায়ুনকে রাজধানী আগ্রায় নিয়ে আসতে বললেন। বাবর হুমায়ুনের মা মাহাম বেগমকে সাথে নিয়ে আগ্রায় ফিরে আসেন।

হুমায়ুনের শরীর দূর্বল হতে থাকে। মাহাম বেগম পুত্রের জন্য বিলাপ করতে থাকেন। অন্যদিকে পুত্রস্নেহে দূর্বল হতে থাকেন বাবর। তার কাছে ভারতের মতো এত বড় সাম্রাজ্য অর্থহীন মনে হতে থাকে। একপর্যায়ে হুমায়ুনের চিকিৎসা নিয়ে প্রখ্যাত চিকিৎসকরা হতাশ হয়ে পড়েন। তারা হুমায়ুনের জীবনের আশা ছেড়ে দেন। ভারতে তখন খাজা বাবা মইনুদ্দীন চিশতির সুফিবাদে উজ্জ্বল ইসলামের ভাবধারা। অগণিত দরবেশ দিল্লি ও আগ্রার পথ ছাড়িয়ে সুফিবাদের ধারা বিকাশে ছাড়িয়ে পড়েছে পুরো ইরান থেকে আরকান পর্যন্ত। সেই আলোকে মোগল সম্রাটও আলোকিত। বাবর তার প্রিয় একজন দরবেশের কাছে গেলেন। দরবেশের দরবারে মস্তক বিনীত হলেন মোগল সম্রাট ভারতের মহান অধিপতি। একমাত্র আশা আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় যদি সুস্থ হয়ে ওঠে প্রিয় পুত্র। দরবেশ জানালেন, আল্লাহর কাছে নিজের প্রিয় জিনিসকে খাস দিলে কোরবানী দিলে আল্লাহ পুত্রকে সুস্থ করে দিতে পারেন। বাবর ফিরে এসে ভাবতে থাকেন কী তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। নিজের আত্মজীবনী বাবরনামার লেখাগুলো পড়তে শুরু করেন। দেখলেন, নিজের জীবনের উত্থান-পতনসহ নিজেকেই বইতে তুলে ধরেছেন। নিজের জীবনের চেয়ে বড় কিছুই আর নেই। সাথে সাথেই তিনি পুত্র হুমায়ুনের শয্যাপাশে চলে যান। তার শরীর ছুঁয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে আল্লাহ যেন পুত্রের জীবন ভিক্ষা দেন। পিতার দোয়া না কী বৃথা যায়না। দোয়া কবুল হয়। শাহজাদা হুমায়ুন কিছুদিনের মধ্যে অলৌকিকভাবে সুস্থ হতে শুরু করেন। আর পিতা সম্রাট বাবর ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি দুর্বল হয়ে যেতে লাগলেন। সম্রাট বাবর বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। বাকী একটি কাজ শেষ করতে দরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ডাকলেন। ১৫৩০ সালের ২২ ডিসেম্বর, আগ্রার পুরাতন দুর্গে নিজের শারীরিক দুর্বল অবস্থা নিয়েই সম্রাট বাবর রাজ দরবারে এলেন৷ অনেক কষ্টে সিংহাসনে বসে বললেন, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে ও আপনাদের সমর্থনে আমি জীবনে অনেক কিছু অর্জন করেছি। এবার আমার মৃত্যুর আগে আমি মুঘল সিংহাসনে হুমায়ুনকে বসিয়ে যেতে চাই। আমি আশা করবো, আমার প্রতি আপনারা যেমন অনুগত ছিলেন, বাদশাহ হিসেবে আপনারা হুমায়ুনের প্রতিও ঠিক তেমনই অনুগত থাকবেন। তার সকল কাজকে সমর্থন জানাবেন। আমি আশা করছি, মহান আল্লাহর দয়ায় হুমায়ুন সফলভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে।’ সবশেষে সম্রাট বাবর হুমায়ুনকে বললেন, ‘হুমায়ুন, প্রিয় পুত্র আমার, আমি তোমাকে, তোমার ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন ও তোমার প্রজাদের আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে যাচ্ছি।‘ তিন দিন মারা গেলেন বিশাল মোগল সাম্যাজ্যের অধিপতি সম্রাট বাবর। কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায়, ‘মরিল বাবর – না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়?/ মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,/ পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়!’

বাবারা এমনই। পিতৃস্নেহের কাছে কিছুই বড় নয়। সেখানে মরণের পরজয় তো নিশ্চিত ও অবধারিত। অথচ ভাগ্যের কত নির্মম পরিহাস। সেই বাবাকেই ভালোবাসি কথাটা কম বলা হয়৷ কবিতায় লিখেছি-

পিতা একটা ছায়া, পিতা একটা ঘর,
পিতা একটা শক্তি; আদি, অবিনশ্বর।
পিতা সন্তানের দুমুঠো খাবারের আশ্বাস,
পিতা অবিরাম সাহস; পিতা দৃঢ় বিশ্বাস।
বিশাল খোলা প্রান্তর পিতার উদার বুক,
পিতাই নমস্য- পিতার আশ্রয়ে স্বর্গসুখ।

৪.০
এবার আমার বাবার কাছে ফিরে আসি। না ফিরে উপায় কী! এটাই তো আমার মূল। তিনি কী ছিলেন সেটা বড় কিছু নয়। তিনি আমার বাবা সেটাই আমার কাছে ধ্রুব সত্য। পিতারা পেশায় কী করেন তা জিজ্ঞাসা করতে নেই। পিতারা জান্নাত।
‘তুম মুহাব্বত কি নজর সে উনহে দেখো ইয়ারো,
উনকো মুছকুরা আহট মে জান্নাত কা ওয়াদা মিলতি হ্যায়।
চান্দ সিক্কো মে কাহা তুম কো ওয়াফা মিলতি হ্যায়,
বাপ কি হাত ভি চুম লো তো দোয়া মিলতি হ্যায়।’
বাবার হাত দোয়ার, আশ্রয়ের, ভরসার। আমি কত হতভাগা। আমি কার হাত ধরে দোয়া চাইতে পারি! সেই হাতটাই তো হারিয়ে ফেলেছি। সূতার বন্ধনটা চিরদিনের জন্য ছিঁড়ে গেছে। আর কখনো দেখা হবেনা। মরণে তার পাশে ছিলাম না। বিদায়ের বেলাতেও থাকতে পারিনি। বিপর্যস্ত আমি এখন তার কবরের পাশে গিয়ে দাড়াই। ফাতেহা পাঠ করি। চোখের পানি টের পাই। আমি নিজেই বুঝতে পারি, বাবা চলে গেছেন। মওলানা রুমী বলেছিলেন, ‘মিরাছে মনদেহ্ আসত জাহাঁ আজ হেজারে কেরন/ চুনে সুদ বেহ জিরে খাক পিদরে সুদ পিছরে পিদর।’ ‘হাজার বছরে বিশ্ব পেয়েছে অমোঘ উত্তরাধিকার সূত্র, একজন বাবা মারা যাওয়ার পর বাবা হয় তাঁর পুত্র।’ আমার বাবার কবর জানিয়ে দেয় এটাই তার শেষ ঠিকানা। তাকে কাফনে জড়িয়ে এখানে শুয়ে রাখা হয়েছে। যারা তাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন তারা জানতেন না, আসলে কাফনের ভেতরে তিনি ছিলেন না। আমি ছিলাম।

কাজী সায়েমুজ্জামান
২১ জুন ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২১ রাত ১২:০৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×