সাংবাদিকতায় সম্পাদকের টেবিল থেকে চিফ রিপোর্টারের টেবিলের সামনে যাওয়ার অনেক গল্প আছে৷ এর আগে একটা লিখেছিলাম৷ ফের বলছি৷ চিফ রিপোর্টার নব নিযুক্ত রিপোর্টারকে জিজ্ঞাসা করেন, কোথায় পড়েছেন? কোন সাবজেক্ট পড়েছেন? নব নিযুক্ত রিপোর্টার উত্তরে জানান, সাংবাদিকতা পড়েছেন৷ চিফ রিপোর্টার তখন বলেন, যেখানে পড়েছেন; যত বছরই যা পড়েছেন সব ভুলে যান৷ এবার আপনার টেবিলে গিয়ে বসুন৷ আজ থেকে রিপোর্টিং শিখতে শুরু করে দিন৷ সাংবাদিকতা এমনই৷ গুরু বিদ্যা৷ প্রতিটি লাইনের একটা ডিমান্ড থাকে৷ এগুলো হয় তথ্য না হয় বক্তব্য৷
এবার চিফ রিপোর্টার আর নব নিযুক্ত রিপোর্টারের আরেকটা গল্প শোনাই৷ চিফ রিপোর্টার তার নতুন সহকর্মীকে বাস্তবতা বোঝান৷ কোথায় বিপদ৷ কোথায় গেলে সমস্যায় পড়তে হবেনা৷ ঢাকার কাওরান বাজার ও তার আশাপাশ মিডিয়া পাড়া হিসেবে মোটামুটি ভিত্তি পেয়েছে৷ ওই পাড়ায় একজন নূতন রিপোর্টার যখন চিফ রিপোর্টারের সামনে যান, চিফ রিপোর্টার তাকে একটা বিষয় জানাতে ভুলেননা৷ যেটা আমাকেও বলেছেন৷ আমিও নূতনদের বলেছিলাম৷ সেটা হলো, সাংবাদিকতায় আসছেন ভালো কথা, তবে উত্তর পাড়া আর দক্ষিণ পাড়ার দিকে তাকাবেন না৷ এই দুই দিকে যত কম তাকাবেন তত ভালো থাকবেন৷ উত্তর পাড়া কী সেটা মনে হয় বলার দরকার নেই৷ কাওরান বাজার থেকে যে রাস্তাটা সোজা উত্তরে চলে গেছে সেখানে গিয়ে যে গেট পাওয়া যায় সেটাই উত্তর পাড়া৷ দক্ষিণ পাড়াটা অনেকেই না বললে বুঝবেন না৷ সেটা আদালত পাড়া৷ তাহলে বাকী থাকলো কী! প্রশাসন আর পুলিশ৷ কিছু জনপ্রতিনিধিদের নিয়েও সংবাদ দেখা যায়৷ তবে পুলিশ আর রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে লেখার বিষয়ে সাংবাদিক সহকর্মীরাই বাস্তবতা ভালো বলতে পারবেন৷ প্রশাসনের বিরুদ্ধে যতই লেখেন, তাতে ভিত্তি থাকুক বা না থাকুক কোন সমস্যা নাই৷ পত্রিকার পাতায় এ কারণে সহজেই এদের নিয়ে গরম গরম খবর ছাপা হয়৷ আমার মতো পাঠকরা তা গোগ্রাসে গলধকরণ করি৷
আমি সাংবাদিকতা করেছি,অবাধ তথ্যের পক্ষেই আমার নীতিগত অবস্থান৷ সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক হয় বিশ্বাস করি৷ তবে যেটা মঙ্গলজনক হয়না, সেটা প্রকাশযোগ্য বলে মনে করিনা৷ তবে প্রকাশের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য থাকা আরো বেশি প্রয়োজন বলে বিশ্বাস করি৷ পর্যাপ্ত তথ্য না থাকলে সেটা প্রকাশযোগ্য মনে করিনা৷ আমার আজকের লেখাটা এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই৷
আমি অনুজ এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে বলি, কাউকে শাস্তি দিতে হলে রাগ বিরাগের বাইরে গিয়ে আইনে প্রদত্ত পন্থা অনুসরণ করে কাউকে শাস্তি দিতে হয়৷ একটা মুরগির মাংস খেতে হলেও পায়ের নিচে পা দিয়ে মেরে খাওয়া অন্তত ইসলামে বিধিসম্মত নয়৷ সেজন্য মুরগিকে এমন শক্তি ব্যবহার করে ধরতে হয় যাতে বেশি শক্তি প্রয়োগ না হয়৷ যাতে ব্যথা না পায়৷ তবে পালিয়ে যেতে যাতে না পারে ততটুকু জোরে ধরতে হয়৷ তারপর পশ্চিমে ফিরে আল্লাহু আকবর বলতে হয়৷ তারপর দুইটা রগ কাটতে হয়৷ বেশিও না কমও না৷ এর মধ্যে আবার কোন জবাই মাকরুহ হয়৷ কোনটা হারামও হয়ে যেতে পারে৷ এজন্য বিধি বিধানের সর্বোচ্চ যথাযথ প্রয়োগ দরকার৷
কথা বলছিলাম সাংবাদিকতা নিয়ে৷ কারো বিরুদ্ধে সংবাদ হলে সেই অভিযোগটা কে করলো তার বক্তব্য থাকতে হয়৷ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার বক্তব্য থাকতে হয়৷ তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে হয়৷ অথবা তার পক্ষে কারো বক্তব্য থাকা দরকার৷ অথচ বাস্তবে কী দেখি!
একটা নিউজ ঘুরছে ফেসবুকে৷ কোন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে স্যার না বলায় মোবাইল কোর্টের আইন শৃঙ্থলা বাহিনী অভিযুক্তকে পিটিয়েছে৷ রসালো সংবাদ৷ হেডিং দেখেই আমার মতো সাধারণ পাঠক ঝাপিয়ে পড়ার মতো সংবাদ৷ সরকারি কর্মকর্তাকে স্যার বলা যাবেনা- এটা জনপ্রিয় আইটেম৷ আমার কথা হলো এ ধরণের ঘটনা হলে সংবাদ ছাপবেন অবশ্যই৷ তবে সেই সংবাদের শর্তপূরণ তরে তো ছাপানো দরকার৷ এবার সেই সংবাদের দূর্বলতাগুলো কোথায় রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়ে যাক৷
খবরটা বেশ কয়েকটি পত্রিকা অনলাইনে পড়লাম৷ হেডিংয়ে রয়েছে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে স্যার না ডাকায় মারা হয়েছে৷ নিউজের বডিতে প্রমাণ নেই৷ খুজে পেলাম না, উক্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে স্যার না ডাকায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পেটাতে বলেছেন৷ সংবাদটা পড়ে বিশ্লষণ করলে যা দাড়ায় তা হলো- মারধর স্পষ্ট নয়৷ স্যার না ডাকায় মারধর তা আরো অস্পষ্ট৷ মারধর হলেও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মারধর হয়েছে কী না তা উল্লেখ নেই৷ কোন সংবাদে কারণটা পাই নি৷ ঘটনা অস্পষ্ট৷ এরপরেও সংবাদ ছাপা হয়েছে৷ যদিও অামার পরিচিত কয়েকজন বার্তা সম্পাদক এসব ত্রুটির কারণে নিউজটা আটকে দিয়েছেন৷
আমলারা সহজ শিকার৷ বলতে পারেনা৷ লিখতে পারেনা৷ প্রতিবাদ লিপিও দিতে পারেনা৷ একটা ভুল সংবাদেই তার দফারফা৷ আমার কথা হলো, চিফ রিপোর্টাররা কী একটা নিউজ ছেড়ে দেয়ার আগে পড়ে দেখেন না৷ না কী সোসাল মিডিয়ার সেনসেটাইজেশনও তাদের পেয়ে বসেছে৷ লাইক কমেন্ট কামাতে হবে৷ বেশি প্রচার দরকার৷ তাতে সংবাদের ভেতরে যাই থাকুকনা কেন৷
কোন ঘটনায় আদালত থেকে তদন্ত করতে পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়৷ পুলিশ সে অনুযায়ী অভিযুক্তকে প্রমাণে ব্যর্থ হলে পিআরবির ২৭৫ প্রবিধান অনুযায়ী চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে৷ এ রিপোর্টগুলো পাঁচ ধরণের হয়৷ এগুলো হলো-ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু বা এফআরটি, ফাইনাল রিপোর্ট ফলস বা এফআরএফ, ফাইনাল রিপোর্ট মিসটেক অব ফ্যাক্টস বা এফআরএমএফ, ফাইনাল রিপোর্ট মিসটেক অব ল বা এফআরএমএল ও ফাইনাল রিপোর্ট নন কগ বা এফআরএনসি৷
এফআরটি হলো, ঘটনা যথাস্থানে ঘটেছে৷ তবে অভিযুক্ত যে করেছেন তার অকাট্য প্রমাণ নেই৷ এফআরএফ হলো- ঘটনাই মিথ্যা৷ এধরণের ঘটনাই হয়নি৷ এফআরএমএফ হলো ঘটনা ঘটলেও ব্যাপারটা অন্য৷ যেমন মেয়ে যে ধর্ষণের অভিযোগ করেছে সেখানে শারিরীক সম্পর্ক হয়েছে ঠিকই তবে ঘটনার অাগে তাদের বিয়ে হয়েছিলো৷ এফআরএমএল হলো- ঘটনা ঠিক আছে৷ তবে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ নয়৷ যে আইনে তাকে তাকে সাজা দেয়ার জন্য আরজি করা হয়েছে তা এর আওতায় পড়েনা৷ দুজনের সম্মতিতেই তারা শারিরীক সম্পর্ক করেছে৷ অথচ নারী শিশু নির্যাতন আইনে অভিযোগ করা হয়েছে৷ সর্বশেষ এফআরএনসি হলো যে অপরাধ করলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেনা৷ সেই অপরাধ হয়েছে৷ ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছে৷ অথচ মামলা করা হয়েছে গ্রেভিয়াস আঘাতের৷ একটা দন্ডবিধির ৩২৩ ধারায় আরেকটা ৩২৬ ধারায়৷
আদালত ইচ্ছা করলে এই ধরণের চূড়ান্ত রিপোর্ট গ্রহণ করে মামলা শেষ করে দিতে পারে৷ অথবা পিআরবির ২৭৬ প্রবিধিতে পুনরায় তদন্তের আদেশ দিতে পারেন৷
এত কিছু বলার উদ্দেশ্য হলো- দেশের বিচার ব্যবস্খায় পুরাপুরি প্রমাণ না থাকলে একজন ব্যক্তিকে সাজা দেয়া যায় না৷ কারো সম্মান নষ্ট তো দূরের কথা৷ আর সেখানে সংবাদগুলো দেখে ভাবি কত সহজেই মানুষকে হেনস্থা করা যায়৷ অনেক জনপ্রিয় নিউজ খেয়াল করে দেখেছি মিসটেক অব ফ্যাক্ট থাকা সত্ত্বেও নিউজ প্রকাশ হয়েছে৷ অথচ এই মিসটেক অব ফ্যাক্টগুলো রিপোর্টারদের উদঘাটন করা দরকার৷ এতসব দূর্বলতা নিয়ে একটা নিউজ কীভাবে ছাপা হয়! আমার ভাবনাটা রেখে গেলাম৷
কাজী সায়েমুজ্জামান
১০ জুলাই ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুলাই, ২০২১ বিকাল ৪:৫৪