জাপানে লেখাপড়া করেছেন এমন একজনের কাছে গল্পটা শোনা৷ তিনি জাপানে মাস্টার্স করেছিলেন৷ এ কারণে তার অনেক জাপানিজ বন্ধু-বান্ধব জুটে যায়৷ জাপান থেকে চলে আসার পরেও জাপানি বন্ধুদের সাথে তার যোগাযোগ থাকে৷ অনেকদিন পর তিনি একটা প্রশিক্ষণে আবারো জাপান যাওয়ার সুযোগ পান৷ এবার জাপানিজ বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করেন৷ তিনি জাপান যাচ্ছেন শুনে জাপানিজ বন্ধুরা খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে৷ তারা জানান যে তাকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে থাকবেন৷ এর মধ্যেই ঘটে হলি আর্টিজানের ঘটনা৷ ওই সন্ত্রাসী হামলায় ৭ জাপানি নাগরিক নিহত হয়৷ এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই তিনি জাপানে গিয়েছিলেন৷ গিয়ে বিমানবন্দরে কোন জাপানি বন্ধুকে পাননি৷ তার জাপানি বন্ধুরা ইমেইলেরও উত্তর দেন নি৷ কারণ হলি আর্টিজানের ঘটনা জাপানিদের মনে এতটাই আঘাত করেছিলো যে কোন বাংলাদেশিকে রিসিভ করার কথা ভাবতে পারেন নি৷
এই ছিল হলি আর্টিজানের পর সাধারণ জাপানি মানুষের প্রতিক্রিয়া৷ তবে তখনকার জাপানি প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে বাংলাদেশের পাশে থেকেছেন৷ হামলায় যে সাতজন জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছিলো তাদের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্পের পরামর্শক৷ ওই সময় সিনজো আবের একটা নির্বাচনী সফরে যাওয়ার কথা ছিল৷ তিনি তা বাতিল করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেছিলেন৷
জাপানের প্রধানমন্ত্রী যদি সাধারণ জাপানিদের আবেগকে প্রাধান্য দিতেন তাহলে মেট্রোরেল প্রকল্পও পদ্মাসেতুর মতো বিরাট চ্যালেঞ্জে পড়তো৷ পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে যখন বিশ্বব্যাংকসহ সকল দাতা সংস্থা একে একে সরে পড়েছিলো ঠিক তার পরেই জাপান ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে সহায়তায় এগিয়ে আসে৷ এই মেট্রোরেল প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা৷ এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসাবে জাপানই দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা৷ মেট্রোরেল জাপানি কারিগরি সহায়তায় তৈরি হচ্ছে৷ এর মান নিয়ে শত্রুও কোন কথা বলেনা৷ ইতোমধ্যে মেট্রোরেল চালু হয়েছে।৷ এটা সম্ভব হয়েছে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবের আন্তরিকতায়৷ জাপান বাংলাদের স্বার্থহীন বন্ধু৷ শিল্প মন্ত্রণালয়ে থাকার সময় দেখেছি, জাপানের সহায়তার কোন মারপ্যাচ নেই৷ কোন অসম্মানজনক শর্ত নেই৷ কোনে ধান্ধা নেই। যেটা অন্যান্য অনেক দাতা সংস্থার সহায়তায় রয়েছে৷
জাপানে থাকাকালে বাংলাদেশ সম্পর্কে সাধারণ জাপানিদের ভাবনা বুঝার চেষ্টা করতাম৷ দেখতাম সাধারণ জাপানিরাও বাংলাদেশকে চেনেন৷ এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখেছি৷ শিক্ষিত জাপানিজরা বাংলাদেশ চেনেন ড. রাধা বিনোদ পালের কারণে৷ কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণকারী রাধা বিনোদ পাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷ এসময় জাপানের বিরুদ্ধে চীনা নাগরিকদের হত্যার অভিযোগে নানচিং গণহত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল৷ রাধা বিনোদ পাল ছিলেন সেই আদালতের অন্যতম বিচারপতি৷ তিনি ৮০০ পৃষ্ঠার বিচক্ষণ রায় দিয়ে জাপানকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন৷ এর পর থেকে জাপানিজরা বাঙালিদের সম্মান করতে শুরু করে৷ রাধা বিনোদ পালের নামে জাপানের টোকিও শহরে জাদুঘর, সড়ক ও স্ট্যাচু রয়েছে৷ জাপান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা রিসার্চ সেন্টারকেও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে৷ রাধা বিনোদ পাল ছাড়াও নেতাজি সুবাস বসুও জাপানের সাথে বাঙালিদের সম্পর্ক স্থাপনে কাজ করেছিলেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রক্কালে তিনি জাপানের সহযোগিতায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন৷ জাপানকে বৃটিশদের হটিয়ে বাংলার নিয়ন্ত্রণ নিতে আহবান জানিয়েছিলেন৷ তার আহবানে জাপান সাড়াও দিয়েছিলো৷ জাপানিরা চট্টগ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছিলো৷ বৃটিশরা ওই ফ্রন্টে হারের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলো৷ ইতিহাস বলে বৃটেন কখনোই কোন যুদ্ধে হারেনি৷ শেষ মূহূর্তে বৃটিশরা জাপানিদের না হারালে বাংলার ইতিহাসকে অন্যভাবে লিখতে হতো৷
অন্যদিকে সাধারণ জাপানিরা কেন বাংলাদেশকে চেনে তার কারণ কাকতালিয়৷ বাংলাদেশ বিভিন্ন কারণে জাপানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িয়ে গিয়েছিলো৷ হলি আর্টিজানের বিষয়টা তো বললামই৷ আরেকটা ঘটনা উল্লেখ করছি৷ ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর৷ হঠাৎ জাপানের বামপন্থী সশস্ত্র সংগঠন রেড আর্মি জাপান এয়ার লাইন্সের একটি যাত্রীবাহী ফ্লাইট অপহরণ করতে সক্ষম হয়৷ বিমানটি ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে জাপানের হানেদা বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল৷ পথে মুম্বাই বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করে৷ মুম্বাই থেকে বিমানটি উড্ডয়নের পরপরই বিমানটি রেড আর্মির সদস্যরা অস্ত্রের মুখে নিয়ন্ত্রণে নেয়৷ তারা বিমানটি ঢাকার দিকে চালাতে আদেশ দেয়৷ পরে বিমানটি ঢাকার তেঁজগাও বিমানবন্দরে এসে নামে৷ বিদ্রোহীরা যাত্রীদের জিম্মী করে এবং তৎকালীন ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দাবি করে৷ এছাড়াও জাপানে কারারুদ্ধ তাদের দলের ছয় সদস্যের মুক্তিও দাবি করে৷ এঘটনায় বাংলাদেশ সরকার মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছিল৷ সরকার চারদিন ধরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে সব ধরণের বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেয়৷ আর বিমাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে পুরা বিমানবন্দর ঘিরে রাখে৷ পরবর্তীতে বাংলাদেশের মধ্যস্থতায় জাপান এয়ারলাইন্সের একটি চার্টার্ড বিমান দাবিকৃত ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও মুক্ত ছয়জন রেড আর্মির সদস্যকে নিয়ে জাপান থেকে ঢাকায় আসে৷ পরে জিম্মি যাত্রীদের ১১৮ জনকে ঢাকায় মুক্তি দেয়া হয়৷ এরমধ্যেই বিমানবন্দরে নিয়োজিত বিমান বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে৷ সেই বিমানবাহিনীর বিদ্রোহে সৃষ্ট গোলাগুলিকে বিদ্রোহীরা তাদের প্রতি আক্রমণ মনে করে৷ তারাও পাল্টা গুলি করে৷ সে অন্য কাহিনী৷ এতে বেশ কিছু বিমান বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলো৷ তবে এ ঘটনায় বেশ কিছু দিন ধরে বাংলাদেশ ছিল জাপানের সংবাদের শিরোনামে৷ এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে জাপানের তৎকালিন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই নিহঙ্গ ভাষায় একটি বহুল প্রচারিত বইও লিখেছিলেন৷ জাপান সরকার বিনা রক্তপাতে জাপানি জিম্মি উদ্ধারের সফলতার কারণে তৎকালীন বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর প্রধানকে দুইটি রাজকীয় পুরস্কার প্রদান করে৷ বাংলাদেশের নাম একটু বয়স্ক সাধারণ জাপানিরা এ কারণেই জানেন৷ অনেকেই আমার সাথে এটি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন৷ জাপানে কেউ ঘুরতে গেলে সেটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হবে৷ তবে চাকরির ক্ষেত্রে ওদের মধ্যে গ্রুপিং দেখেছি৷ সেক্ষেত্রে জাপানিরা নিজের সুবিধায় অনেক কঠোর ও অমানবিক৷ এমনটাও দেখেছি৷
বাংলাদেশের মানুষও জাপানকে পছন্দ করে৷ কোন জাপানির মৃত্যু সংবাদে কাউকে কখনো খারাপ মন্তব্য করতে দেখিনি৷ জাপানি বন্ধুদের বলেছি হলি আর্টিজানে বাংলাদেশি নাগরিকও নিহত হয়েছিল৷ দেশের মানুষ তাদের জন্য যতটা শোক প্রকাশ করেছে তার চেয়ে বেশি শোক প্রকাশ করেছে নিহত জাপানিদের জন্য৷ নিহত জাপানিদের নামে মেট্রোরেল স্টেশনের নামকরণের দাবি উঠেছিল। জাপানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের আস্থা রক্ষার এ সময়টিতে সিনজো আবে ভূমিকা রেখেছিলেন৷ এ কারণে সিনজো আবেকে বাংলাদেশের মানুষও ভুলবেনা৷ তার হত্যাকান্ডে এদেশের সাধারণ মানুষ অনেক শোকাগ্রস্থ হয়েছিলো।
হলি আর্টিজানের ঘটনার দুই বছর পরে আমি জাপানে গিয়েছিলাম৷ তখনো প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে৷ ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন৷ তবে জাপানিদের মধ্যে তাকে নিয়ে সমালোচনাও দেখেছি৷ জাপানিরা দ্রুতই হলি আর্টিজান ভুলে গেছে৷ জাপান থাকাকালে তাদের যে আন্তরিকতা পেয়েছিলাম তা কখনো ভুলতে পারবোনা৷ আমার যতো বিদেশ ভ্রমণ জাপান তার মধ্যে সেরা৷ দক্ষিণ কোরিয়ার দেড় বছরের বেশি ছিলাম৷ আর কখনোই কোরিয়ায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই৷ ক্লাসে কোরিয়ান প্রফেসররা জাপানের নিষ্ঠুরতার কথা বলতেন৷ জাপান কোরিয়ার নারীদের যৌন দাসী বানিয়েছিলো সেটা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হতেন৷ সিনজো আবে যে এজন্য মাফ চেয়েছেন সেটা বলার পরেও বলতেন কোরিয়ার মানুষ কখনো জাপানকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারবেনা৷ আর এদিকে আমার অবস্থা ভিন্ন৷ জাপান নিয়ে এত বদনাম শুনেও সেসব আমার ভালোবাসা এতটুকুও কমাতে পারেনি৷ আমি সুযোগ পেলে আবারো জাপানে যেতে চাই৷
জাপান আমাদের মেট্রোরেল দিয়েছে। সেই মেট্রোরেল পেয়ে আমরা উচ্ছ্বসিত। অথচ এই মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য এসে ছয়জন জাপানি জীবন দিয়েছেন। তাদের নামে মেট্রোরেল স্টেশনের নামকরণ করা হয়নি। নামকরণটা স্খানের সাথে করা হয়েছে। তবে মেট্রোরেলের স্টেশনেের কোনো একটি তলা তাদের নামে নামকরণ করা যায়। এটা না পারলেও মেট্রোরেলের কোনো একটি স্থানে তাদের ছবি প্রদর্শন করা যায়। এতে বন্ধু বৎসল জাপানিরা বাংলাদেশের প্রতি আরো আন্তরিক হবেন। বাংলাদেশ নিহত জাপানিজদের স্মরণ করলে আখেরে এদেশের লাভ হবে।