বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা যেকোন বিষয়কে ধর্মীয় ফ্লেভার দিয়ে উপস্থাপন করে৷ ইসলামের সাথে কতটুকু সম্পৃক্ততা তার ভিত্তিতে কনভারজেন্স নির্ধারিত হয়৷ বাঙালি মুসলমানরা এক্ষেত্রে এক কাঠি ওপরে৷ পক্ষ বিপক্ষ বেছে নেবে তাতেও ধর্মীয় ন্যারেটিভ তৈরি করবে৷ এমনকি ফুটবল খেলাতেও দল বাছাই করবে ধর্মের ভিত্তিতে৷ ফুটবল বিশ্বকাপ এলে কোন দেশে মুসলমানরা নির্যাতিত সেটার ভিত্তিতে কোনো দেশের পক্ষে বিপক্ষে প্রচারণা চালানো হয়৷
এতে কী হয়! আসল বিষয়টা চাপা পড়ে যায়৷ মুসলমানরা যখন ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোন কিছু নিয়ে প্রচারণা চালায় তখন তা কম প্রচারিত হয়৷ বিষয়টি সাম্প্রদায়িক হয়ে যায়৷ ফলে মুসলমান নয় এমন লোকজন কনফিউজ হয়ে যায়৷ তারা বিভিন্ন ইস্যুতে চুপ থাকে৷ এতে অনেকের অধিকার লঙ্ঘিত হয়৷
মুসলমানদের এই ন্যারেটিভের বড় উদাহরণ হচ্ছে প্যালেস্টাইন ইসরায়েল দ্বন্দ্ব৷ ফেসবুকে হাজার হাজার স্টাটাস দেখেছি৷ বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা এই সংঘাতকে ইহুদি বনাম মুসলমানের যুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করেছে৷ বিশ্বব্যাপী ওই সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে৷
আসলে ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিন্তিনে যে যুদ্ধ চলছে তা একটি জাতির স্বাধীকার অর্জনের যুদ্ধ৷ একটি দেশ থেকে তার ভূমিপুত্রদের উচ্ছেদ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদী ধর্মের লোকজনকে এনে বসতি স্থাপন করে একটি দেশের ভেতরে অন্য একটি দেশ সৃষ্টি করা হয়েছে৷ যার ভিত্তি কথিত আবেগ৷ শক্তি প্রয়োগ করে কয়েক হাজার বছর আগের 'প্রতিশ্রুত ভূমি' ধারণার উপর এমন একটি দেশ তৈরি করা হয়েছে৷ যাদের সেখানে জড়ো করা হয়েছে তাদের সংস্কৃতি আলাদা৷ ভাষা আলাদা৷ এমনকি পাশের দেশ ভারত থেকেও ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে দুই হাজার তিন'শ ইহুদী ইসরায়েলের নাগরিকত্ব নিয়েছে৷ শুধু বিশেষ জিনের লোকজন নাগরিকত্ব পেয়েছে দেশটিতে৷ এই জিন ইহুদীদের কীনা তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী পরীক্ষা নীরিক্ষা করা হয়েছে৷
ভারতে পূর্বাঞ্চলের মিয়ানমার সীমান্তে মনিপুর রাজ্যে ইহুদীদের হারিয়ে যাওয়া বনেই মেনাশে (Bnei Menashe) বংশ সনাক্ত হয়েছে বলে জানা গেছে৷ যাদের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। এরা মূলত কুকী। যাদের ধর্ম খ্রীস্টান। তবে বনেই মেনাশে বংশ হিসেবে সনাক্ত হওয়ার পর তাদের ইহুদী ধর্ম গ্রহণ বাড়ছে। বলা হচ্ছে, দুই হাজার লোক ইতোমধ্যে ইহুদী হয়েছে। ইসরাইলের মাথাপিছু জিডিপি ৫৮ হাজার ডালারেরও বেশি। এরা কেন ভারতে পড়ে থাকতে চাইবে। এরা দ্রুত ইসরাইল ফিরে যেতে চায়। এমনকি হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশ নিতে চায়।
তবে এই কুকীদের নিয়ে ইহুদী লবিস্টদের এই অঞ্চলে বড় ধরণের পরিকল্পনা রয়েছে। তারা কুকীদের সাপোর্ট দিচ্ছে। মনিপুরের জনসংখ্যার ৫৩ ভাগের বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতেই সম্প্রদায়ের। তাদের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে কুকীদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলো। কুকীরা সংখ্যায় ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে মেইতেইদের রুখে দাড়িয়েছে; জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে; তা এককথায় অবিশ্বাস্য। তারা হিন্দুদের চোখের সামনে গরু জবাই করে খায়। হিন্দুরা কিছু বলার সাহস পায়না। ইসরাইলের সাপোর্ট ছাড়া এটা সম্ভব নয়। ইসরাইলের গণমাধ্যমে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। দাবী করেছে, হিন্দুরা ইহুদীদের নির্যাতন করছে। আসলে তারা খ্রীস্টান কুকীদের ইসরাইলে নিতে চায়না। বরং এখানে কুকীদের নেতৃত্বে একটি খ্রীস্টান রাষ্ট্রের পত্তন করতে চাইছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি এ দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এদের তৎপরতায় ভারতের মনিপুর আর বাংলাদেশের বান্দরবান ও তৎসংলগ্ন মিয়ানমার অস্থির হয়ে উঠেছে। বান্দরবানে হাতে গোনা কিছুসংখ্যক কুকীর বসবাস। অথচ তারা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। তার মানে ইসরাইলের খেলা এই অঞ্চলেও শুরু হয়ে গেছে। অথচ কিছু সংখ্যক বোকা ইন্ডিয়ান ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের হামলায় উল্লাস করছে।
যাই হোক, আমার দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট কোন ধর্মের ভিত্তিতে কোন দেশের জন্ম হলে তা একটি জঘন্য ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রে পরিনত হয়৷ পাকিস্তানের উদাহরণ দেয়া যায়৷ ইসরায়েল এর পক্ষে বড় প্রমাণ৷ শুধু ধর্মের ভিত্তিতে দেশ সৃষ্টি করতে গিয়ে লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে৷
ইসরায়েল দেশটির কারণে আরব জাতিকে উৎখাত করা হয়েছে৷ উৎখাতকৃতদের মধ্যে মুসলমানরাই নয়৷ খৃস্টানরাও রয়েছে৷ বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক এডওয়ার্ড সাইদ খৃস্টান হয়েও নিজের দেশ প্যালেস্টাইনের পক্ষে কলম ধরেছেন৷ এটি যে আরব জাতির নিজের ভূমিতে ফেরার একটা অধিকারের যুদ্ধ তা নিয়ে একটি ন্যারেটিভ দেয়ার চেষ্টা করেছেন৷ তবে এ ন্যারেটিভ কাজে লেগেছে। আজ উন্নত বিশ্বে ফিলিস্তিনের পক্ষে যে জনমত গড়ে ওঠেছে সেটা অ্যাডওয়ার্ড সাইদ বা ফরিদ জাকারিয়াদের ন্যারিটিভেরই ফল। মুসলমানদের বিক্ষোভের কারণে পশ্চিমারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলছেন- এমন ভেবে থাকলে বোকার স্বর্গে বাস করবেন।
ফিলিস্তিন বনাম ইসরায়েলের যুদ্ধ মোটেও ধর্মযুদ্ধ নয়৷ তাহলে ফিলিস্তিনের লোকজন কেন ধর্মীয় শ্লোগান দিচ্ছে! এটি আসলে তাদের সংস্কৃতি৷ ইসরায়েল- ফিলিস্তিন যুদ্ধ একটি বিতাড়িত নিপিড়িত জাতির অধিকার আদায়ের যুদ্ধ৷ এর পক্ষে পৃথিবীর যে কোন বিবেকবান ও ন্যায়বান মানুষের কথা বলতে হবে৷ একে সার্বজনীন মানবতার মুক্তির পথ হিসেবে চিহ্ণিত করা দরকার৷ অথচ মুসলমানরা করছে উল্টা৷ একটি জাতির অধিকারের আন্দোলনকে দেশপ্রেমের জন্য জীবনদানকে সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছে৷ এতে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের আন্দোলন অন্য জাতি-ধর্মে তেমন প্রসারিত হয়নি৷ তারাও এটিকে মুসলমান বনাম ইহুদীদের লড়াই হিসেবে দেখছে৷ এতে ক্ষতিটা হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের৷ আমি এ কারণেই ফিলিস্তিনের মানুষের অধিকার আদায়ে ফাতাহ আন্দোলনের সমর্থক৷ ফাতাহ যত শক্তিশালী হবে, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ন্যায্যতা ততটা প্রসারিত হবে৷ আমি কোন মিলিট্যান্টের পক্ষে নই৷ হামাসকে এ কারণেই সমর্থন করিনা৷
২.০
যুদ্ধের আগে হামাসের ওপর মাত্র ৫৮ ভাগ গাজাবাসীর সমর্থন ছিল৷ অন্যদিকে হামাসের সদস্য সংখ্যা বড়জোর ৩০ হাজার৷ অথচ গাজায় ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর বর্বরতা চলছে৷ ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর এ পর্যন্ত চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক লক্ষ। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, এই বর্বরতা নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় লেখা যায়না৷ এক্স বা সাবেক টুইটার থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতার সকল ভিডিও সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ ফেসবুকে ইসরায়েল বা ইহুদী সম্পর্কে কিছু লিখলে কমিউনিটি রুল ভঙ্গের নোটিশ দেয়া হয়৷
যা বলছিলাম, গাজায় বিদ্যুৎ পানি নাই৷ হাসপাতাল ধ্বংস করা হয়েছে। চিকিৎসা বন্ধ৷ এই আধুনিক যুগে বিশ্বের চোখের সামনে নারী শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে৷ অথচ মানবাধিকার নিয়ে কেউ কথা বলছেনা৷ যারা বলছে তাদের দমন করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলো নিজের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে কথা বলছে৷ কারো কাছ থেকে কড়া কোন প্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছেনা৷ একসময় ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশে বড় ধরণের প্রতিবাদ হতো৷ এখন তা দেখা যায়না৷ আমাদের দেশের তরুন প্রজন্মের বড় একটা অংশ মোয়ি মোয়ি নিয়ে যত ব্যস্ত ছিল; সেই তুলনায় ফিলিস্তিন তাদের ভাবনাতেই নেই!
গাজার আহত-নিরন্ন-আশ্রয়হীন মানুষগুলো দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করে রাফায় গিয়ে জড়ো হয়েছে। সেখানেও বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে হামলা চলছে। জাতিগত নিধন চলছে। ইসরাইলে হামাসের হামলার বিষয়ে প্রথম সারির নেতারাও অন্ধকারে ছিলেন। সেখানে সাধারণ মানুষের দায় কী! অথচ জীবন দিতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের। আমি আরবী বুঝি। একটা ভিডিওতে দেখলাম ফিলিস্তিনি নারীরা একটি মৃতদেহ ঘিরে হামাসকে অভিশাপ দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ কত অসহায়! হামাস কোনো পোষাকধারী বাহিনী নয়। এ কারণে কোনো হামাস সদস্য হত্যার দাবিও গ্রহণযোগ্য নয়। নিহত ব্যক্তিদের একমাত্র পরিচয় তারা ফিলিস্তিনি।
কোথাও মিলিট্যান্ট যোদ্ধাদের হামলার বিপরীতে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চরম বর্বরতা৷ রাষ্ট্র না থাকলে মিলিট্যান্ট জন্ম হবেই৷ প্যালেস্টাইন নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন করাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে৷
স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র চাই৷
#All eyes on Rafa
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:২০