somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অব্যবহিত অগ্রজ ...

০৫ ই মে, ২০১৮ রাত ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একদিন আমার খুব জ্বর এলো। তখন সবে মাত্র ১.১ টার্মে পড়ি। ঢাকা ছেড়ে খুলনা যেয়ে ভালোমত খুলনার পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়েও নিতে পারিনি। নিজের ব্যাচমেট আর ডিসিপ্লিনের কয়েকজন বড় ভাই ছাড়া আর কাউকেই চিনিনা এ শহরের। আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ কখনো এ শহরে পা রেখেছেন কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে! এমন অচেনা শহরে বছর না যেতেই আমার এমন অসুখ! আমি তখন খান জাহান আলী হলের পূর্ব পাশ্বে ‘মায়ের স্বপ্ন’ নামে একটি দ্বিতল ভবনের ২য় তলায় মেস নিয়ে থাকতাম। আমার সাথে ব্যাচমেট-বন্ধু আরো ক’জন নন-ডিসিপ্লিনের।

প্রচন্ড জ্বরের ঘোরে যখন আমি জ্ঞ্যান হারাই তখন আমার পাশে কে ছিলো, কি হয়েছে তা মনে নেই। আমার শুধু মনে আছে আমার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন রাত আড়াইটার মত হবে, আমার পাশে আমার তিন বন্ধু বসা। সোহাগ মাথায় পানি ঢালছে, মাহমুদ সালাম ভাইয়ের দোকান থেকে পেপের জুস এনে বসে আছে, রুদ্র মাথাটা মুছে দিচ্ছে। প্রচন্ড অসুস্থতার মধ্যেও আমাকে উঠে বসানো হলো। পেপের জুস ৫০মিলিও খেতে পারিনি, তিতা হয়ে আসছিলো মুখ। ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেদিনের মতন।
গল্পটা আমার রুমমেট মাহফুজ আর মাহমুদের কাছ থেকে শোনা। আগের দিন আমার যখন জ্বর এলো তখন আমার রুমে নাকি অনেক সিনিয়ার এসেছিলেন। আমার খোঁজ নিতে। যারা আসতে পারেননি তারা ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। ’০৮ থেকে ’১০ ব্যাচের অন্তত ৩০ জন সিনিয়ার নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। এমন অসুস্থতার মধ্যে কেমন যেন একটা ভালো লাগা কাজ করছিলো। এই অচেনা শহরেও আমার এতো আপনজন!

আমি যে গল্পটা লিখতে বসেছি-সেটা আমার সিনিয়ারদের নিয়ে গল্প। আমি আমার জীবনে কতোটা ভালো সিনিয়ার হতে পেরেছি জানিনা, কিন্তু কিছু অমায়িক আর বন্ধুর মতো সিনিয়ার পেয়েছিলাম ক্যাম্পাসে। যাদের জন্যে পুরো ক্যাম্পাস লাইফটা দারুন কেটেছে। সত্য কথা বলতে ইমিডিয়েট সিনিয়ারদের নিয়ে যদি গর্ব করার মতো কোন ব্যাপার যদি কখনো থাকে, সেটা ইসিই’১০ কে নিয়ে আমরা করতে পারি।
র‍্যাগিং পিরিয়ডে সিনিয়াররা সবসময় বলতো- সিনিয়াররা নাকি বন্ধুর মতো হয়ে যায়! কে বিশ্বাস করবে এ কথা! কী সব আজে-বাজে কথাবার্তা আর সাথে বাজে ব্যাবহার! সত্য কথা বলতে, প্রথম বর্ষে কখনো মনেই হয়নি- সিনিয়ার কখনো বন্ধু হতে পারে। কিন্তু বছর না ঘুরাতেই আমি কথার সত্যতা পেলাম। ‘অপ্রিয়’ মুখগুলোই সবচেয়ে ‘প্রিয়’র তালিকায় নাম লেখালো। সিনিয়াররা কেমন বন্ধুর মতো আচরণ করতে লাগলো। ক্যাম্পাস জীবনটাকে চমৎকার উপভোগ্য করতে এর বেশী কিছু প্রয়োজন ছিলোনা কখনো।

দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে এসে কিছু ব্যাক্তিগত ঝামেলায় নিজেকে নিজের মধ্যে পুঞ্জিভূত করে রাখার ইচ্ছে হলো। ‘একটা ব্যাক্তিগত জিরো আওয়ার’ এর সান্নিধ্যে থাকতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ-পাশ ছেড়ে নিরালার দিকে বাসা নিয়ে একাকী থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিই। দু’একদিন বাসাও খুঁজতে থাকি। আমি যে ক্যাম্পাস এরিয়া ছেড়ে চলে যাবো কাউকে শেয়ার করিনি কখনো কিন্তু নিরালাতে বাসার খোঁজ করছিলাম, একা একটা বাসা। এর মধ্যে একদিন এক সিনিয়ার ফোন দিলো-
‘সাঈফ তুই কই?’
‘ভাই, আমিতো ক্যাম্পাসে নাই,বাইরে’
‘এক্ষুনি ক্যাম্পাসে এসে দেখা করবি!’
আমি ক্যাম্পাসে ফিরে সে ভাইয়ের সাথে দেখা করি। ওনি আমাকে অনেক ঝাড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলেই কি ভালো থাকা হবে?’
আমি অবাক হই! ভাই কি করে জানলো এ কথা। ভাই জানিয়ে দিলো তুই এক্ষুনি তোর বেড-পত্র নিয়ে হলে উঠবি, আমার রুমে।
আমি বললাম- ভাই, আমার সিট নেই।
‘আমার সিটে উঠবি, প্রয়োজনে আমার সাথে বেড শেয়ার করবি’!
আমি উঠতে চাইনি। আমি সত্যিই একটু একা থাকতে চেয়েছিলাম। কিছুটা একঘেয়েমি আর স্বংকীর্ণতা ভর করেছিলো জীবনে। ২য় বর্ষের শেষের দিকে ক্যাম্পাস জীবনের বয়ঃপ্রাপ্তিতে অনেকেই এ সমস্যা ফেস করেন বলে শুনেছিলাম, আমিও করলাম!
আমি হলে উঠলাম। আহারে হল লাইফ! হলের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শেষ হলে দ্বিতীয়বার তা আর কেনার প্রয়োজন বোধ করতাম না।সাবান, মাথার শেম্পু, টুথ-পেস্ট, সেভিং ক্রিম, জুতা,খাতা, কলম, টিশার্ট সব (খালি ওই ছোট্ট জিনিসটা বাদে) শেয়ারে। আহসানউল্লাহ হলের ২২৩ এ থাকার সময় রুমে রিয়াদ ভাইয়ের একটা ব্যাক্তিগত সুগন্ধি ছিলো।আমি সহ আমরা মানে সুমন ভাই, শেখর দা, পাশের রুম থেকে রিপন, তাহমিদ আরও অনেকেই পড়াতে যাবার সময় বা ব্যাক্তিগত কাজে যাবার সময় ঐটার সাক্ষাৎ নিয়ে যাইতো!
৩১৩ নাম্বার রুমের নাম ছিলো টেমসট। তন্ময়, আহমেদ, মাহমুদ, সজীব ও তূর্য্য নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে এ নাম তৈরী। টেমস্ট এর বাসিন্দাদের একটাই রুলস ছিলো- সকলকে একসাথে ঘুমাতে যেতে হবে। যত টায়ার্ডই থাকি, গার্লফ্রেন্ডের সাথে যত ব্রেকাপ আর অভিমানই হোকনা ক্যানো রুমে আসলে সকলকে ভুলে যেতে হতো সেসব। কেউ যদি আগে ঘুমানোর পাঁয়তারা করতো সাথে সাথে রুমে চলতো ‘ইন্সটেন্ট মেটাল উৎসব’। এসি/ডিসি, আইরন মেইডেন, বুলেট ফর মাই ভ্যালেন্টাইন কিংবা এক্সোডাজ এর গান চলতো সর্বোচ্চ ভলিউমে। একসময় সুদীর্ঘ মেটাল সংগীতও মেলোডিয়াস মনে হতে লাগলো। ফলে ঘুমাতে অসুবিধে হতোনা। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই! প্রচন্ড শীতের দিনে কেউ আগে ঘুমিয়ে গেলে বিছানায় পানি পর্যন্ত ঢেলে দেয়ার ব্যাবস্থা ছিলো! আমি এ নিয়মের সবচে বড় ভুক্তভোগী!
এইরকমই ছিলো হলের জীবনধারা। কোন কিছুর শেষ নেই এখানে, একটা শেষ হলে আর একটা টপিক তৈরি হয়ে যেতো কোথা থেকে জানি। গর্বিত আমি,এই চাক্রিক জীবনের বাসিন্দা হতে পেরে। অস্থায়ী এই আবাসকে এতোটা আপন ভেবেছিলাম জানি না স্থায়ী হলে যে কি করতাম!
যাইহোক,একটা সময় একে একে সিনিয়ার ব্যাচগুলো বিদায় নিতে থাকলো। সবশেষে আমাদেরকে সিংহাসনে বসিয়ে যখন ’১০ ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলো সেদিন সত্যিই অভিভাবক শুন্য হয়ে পড়েছিলাম। ভাইদের বিদায় দিয়ে এসে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। অনুভূতি প্রকাশে লিখেছিলাম কিছু কথা-

‘কি বলার আছে এখন আর কিইবা করার আছে
যাবার বেলায় তাই চোখ বুজে রাখি ঠোট ঢেকে রাখি’


শেষ বর্ষের ক্রাউন নিয়ে প্রচন্ড ব্যাস্ততায় কেটে গেলো ৪র্থ বর্ষটাও। একদিন আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম। সময় এলো আমাদের। খুলনা ছেড়ে আবার চলে এলাম ঢাকায়। আমাদের সম্পর্কগুলো টিকে আছে আগের মতো, কিংবা এরচে আরো তীব্র ভাবে।

।। লেখাটা ইসিই ডিসিপ্লিনের বিশ বছর পূর্তিতে আয়োজিত রি-ইউনিয়নের সুভ্যেনিরে প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৮ রাত ১০:৪৩
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×