somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই বিদায়ে

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চলে যাওয়ায় স্পর্শ আছে, দু;এক আউন্স ভালোবাসা থাকলেও থাকতে পারে।

সেই ভালোবাসাটা মাঝেমধ্যে অনুভব করার চেষ্টা করেন আহমেদ ছফা। বাল্যকালে তাদের খড়ের ঘর ছিলো। খড়ের ছাদ বেয়ে শীতের জোছনা ঘরে ঢুকে যেত ভীষণ। লাল লেপের উপর সাদা কাভারের নিচে বুদ হয়ে থাকা দাদুর কাছ থেকে বৃটিশ শাসনামলের ইংরেজ বাবুদের গল্প শুনতেন। দারুন ভরাট কণ্ঠে দাদুর গল্প বলা সেই আমলটাতে নিয়ে যেত আহমেদ ছফাকে। কোন কোন রাতে গল্প শুনতে শুনতে ঘুম চলে এলে টের পেতেন দাদুর মৃদু কণ্ঠস্বরের বাইরে একটা জমজমাট নিস্তব্ধতা আছে। সেই নিস্তব্ধটা প্রায়ই অনুভব করতে চান তিনি।

তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ। অর্থনীতির ছাত্র ভাস্কর চৌধুরি ক্যাম্পাসের পিছনে বসে একটানা সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। মুখে উস্কো-খুশকো দাড়ি, ফুলহাতা শার্টে একহাত ফোল্ড করানো। মৃদুল শেখ ক্যাম্পাসের বড় ভাই।
‘এই ছেলে, এদিকে আয়। কি নাম রে তোর?’
‘ভাস্কর’। হালকা একটু থেমে আবার বললো ‘ভাস্কর চৌধুরি’।
‘ফার্স্ট ইয়ারেই এই অবস্থা কেন? এতো অগোছালো’?
‘আপনি জানেন কতোটা আমাকে? ভিতরটা কেমন তা পোষাকেই নির্ধারন করে দিলেন?’

সেদিনের সাহসী উত্তরে ভাস্করকে কাছে টেনেছিলো মৃদুল শেখ। একজন না প্রেমিক, না বিপ্লবী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ বর্ষে পাশ করে সার্টিফিকেট তুলে ক্যাম্পাসে ছেড়েছিলো মৃদুল। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রেমিকা’র বিয়ের দিনটাতে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ পরীক্ষা ছিলো। মৃদুল শেখ সেদিন ঘরে বসে দুই প্যাকেট হলিউড টেনেছিলো।
যাওয়ার দিন ভাস্করকে ডেকে বলেছিলো- 'চললাম রে, পাশটাশ করিস ঠিকমত। এদেশে বিপ্লব হবেনা। শুয়রদের কাজে প্রতিবাদ করা মানুষ হয়ে মানায় না!’
‘এমন ভাবে বলছো যেন আর দেখা হবেনা! বিপ্লব থেমে যাবেনা দাদা, বিপ্লব চলবে'
- লাল লাল চোখে বড় করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো ভাস্কর।

‘বিপ্লব থেমে গেছে, চাকরী না করলে চলছে না, সংসারে বড় অভাব, আর বরদাস্ত করা যাচ্ছে না; এ'মন সাতপাঁচ মিশিয়ে কিছু একটা বলেছিল মৃদুল শেখ। মৃদুল’দার সঙ্গে সেই শেষ দেখা ছিলো ভাস্করের।
আজ ভাস্কর চৌধুরি ক্যাম্পাস ছাড়ছে, শহরও ছাড়ছে স্বতঃসিদ্ধের মতো। তাকে বিদায় দিতে আসছে প্রিয় অনুজ সত্যজিত।
‘দেখ সত্যজিত, পরীক্ষাগুলো দিস। আমাদের জন্য বিপ্লব নয়। টান-পোড়েনের সংসারে জন্মে যেখানে ক্ষুদা মিটেনা, সেখানে বিপ্লব অসম্ভব।'

বাবার যাওয়াটাও হঠাৎ। রোজ ভোরে উঠতেন, একদিন উঠলেন না। সাদা কাফনে ঢাকা বাবাকে দেখেও মনে হয়নি বাবা ঘুম থেকে উঠবেন না। আগের দিন গোটা রাত বৃষ্টি হয়েছিল। সোঁদা গন্ধে এখনও বাবার না থাকা ফেরত আসে। বার বার। আজ আবার সেই রাতের ছাদের স্তব্ধতা বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠছিল। কাউন্টারে দাড়িয়ে সিয়ামুল হোসেন ফ্রেশ ড্রিংকিং ওয়াটারের বোতলটা বের করে মুখ ধুইয়ে চোখ মুছে নিলেন ভালো করে। তাকে কেউ বিদায় জানাতে আসেনি। এ শহরে তার কেউ থাকেনা। এখন তার বাপের ভিটাটা খালি, অন্ধকার।

খাদিজা ইসলাম চোখ মুছছেন। রিক্সাটা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন ঘন্টা ধরে। আহমেদ ছফা খাদিজাকে অনুরোধ করছেন রিক্সাটা ছেড়ে দিতে। খাদিজা রিক্সা ছাড়ছেন না।
‘আমিতো বলেছি, এখনি চলে যাবো আমি, তোমার বাসটা ছাড়ুক, তারপর!’
‘বাস ছাড়তে অনেক দেড়ি। দেখছোনা, ছাড়ার সময় ১৫ মিনিট গত হলো, এখনো ড্রাইভারেরই দেখা নেই!
‘না আমি যাবো না! আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই তুমি বাঁচো, আমার জন্য তো তোমার কোন দয়া-মায়া নেই!’
‘তাহলে এতোসব মায়া কি এতোদিন সঠিক গন্তব্যে পৌছায়নি? কি বলো এসব! আমি কাকে দিলাম এতোসব প্রেম!’
- স্বভাব সুলভ ঠাট্টা করে খাদিজাকে হাসানোর চেষ্টা করলো আহমেদ।
‘তোমার তো আমার জন্য মায়া নেই, মায়া নেই! আমাকে ফেলে চলে যাও সবসময়, তুমি কেমন করে বুঝবে আমার কেমন লাগে? তুমি তো আমাকে ভালোই বাসোনা!’- বলেই কেঁদে ফেললো মেয়েটি।

আর্থ-সামাজিক-বিজ্ঞান ভুলে আহমেদ ছফা খাদিজাকে জড়িয়ে ধরলেন এই ব্যাস্ত কাউন্টারে। এমন দৃশ্যে হটাৎ পৃথিবীর কেন্দ্রের মতো গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠলো দুজন।চারপাশের সবার চোখ যেন মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তুকনার মতোই এই কেদ্রের দিকে তাকিয়ে!
খাদিজাকে জড়িয়ে ধরে সব ভুলে ব্যাস্ত নগরীতে একটা অদ্ভূত নিস্তব্ধতা পেলো আহমেদ। গাড়ির হর্ণ, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ কিংবা বাস ছাড়ার সময়-সব ভুললো নিমেষেই।
তারপর খাদিজার কপালে চুমু খেয়ে বললো- পাগলি, আবার আসবো! এইতো কটা দিন পরে।

বাস ছেড়ে দিয়েছে। খাদিজার দেয়া প্যাকেটটা খুলে একটা জবরদস্ত সাত পাতার চিঠি পেলে আহমেদ। এই চিঠিগুলো 'যেওনা প্লীজ' মার্কা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী ছিলো। পড়লে তাই খারাপ লাগবে আরো। শত চেষ্টাতেও সে'টা বের করতে পারলো না সে। কিন্তু না বের করেও যেন পারছিলো না।

খুব সাহস নিয়ে বাসের মৃদ্যু আলোতে চিঠিটা খুললো আহমেদ। পড়তে শুরু করলো পুরোটা। একটা গল্প, একটা জীবনের গল্প, সংসারের স্বপ্ন নিয়ে গল্প।

এই চিঠি আহমেদকে নিয়ে গেলো সেই পুরোনো দিনের মতো, যখন তার গল্প শুনলে কল্পনাতে আসতো।
আজও আসছে, গল্পের চরিত্রগুলো তার চেনা। হয়ত সে নিজেই!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:৪৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×