somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবার হলো দেখা

১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি বরাবরই ভাবতাম একটা ছা-পোষা নাগরিক হবো দেশের।
একটা সরকারি চাকরি থাকবে, পোষ্টিং হবে দূরে। অচেনা কোন শহরে।

হলোও তাই। সাত বছর আগে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়া হলো। পোষ্টিং হলো আহসানগঞ্জ। বাংলার এই নীরব অঞ্চলে মানিয়ে নিতে প্রথম প্রথম সমস্যা হচ্ছিলো বেশ তবুও তীব্র অভিযোজন ক্ষমতার কারণে কোনভাবে টিকে গেছি সেইবার। বিশেষ করে বিয়ের পর নতুন বউ, নতুন সংসার, নতুন শহর- সমষ্ঠিগত নতুন মিলে চমৎকার হয়ে উঠলো সময়টা। আত্রাই পাড় হয়ে উঠলো অনিন্দ্যসুন্দর।

মাস ছয়েক হলো আমাকে বদলি করা হয়েছে আক্কেলপুরে। আক্কেলপুর উপজেলা সদর আহসানগঞ্জ থেকে খুব বেশী দূরে নয়। তাছাড়া প্রতিদিন তিনটা মেইল ট্রেনের ব্যাবস্থা আছে। যাতায়াতে খুব একটা অসুবিধে হয়না বলে পরিবার নিয়ে আমি আহসানগঞ্জেই থেকে গেলাম। তাছাড়া গত সাত বছরে নিজের একটা পরিচয় জুটেছে এখানে। একটা ব্যাক্তিগত পরিপার্শ্ব হয়েছে।

প্রতিদিন অফিস ফেরতা ট্রেনটুকুতে আমার বসে থাকতে হয় চল্লিশ মিনিটের মতো। আর সেখান থেকে নেমে পায়ে হেটে মিনিট সাতেকের সফরে পৌঁছে যাই বাড়ির দোরগোড়ায়। নভেম্বরে এই অঞ্চলে সূর্য্যিজেঠুর ডিউটি আওয়ারস নেহাতই কম। পাঁচটা বাজল কি বাজল না, আলো-টালো গুটিয়ে নিয়ে সে দিনের মত বিদায় নেওয়ার যোগাড়যন্ত্র করে। গুঁড়ি গুঁড়ি সন্ধ্যারা চুপিসাড়ে নেমে এসে ঘাসের ডগায় অপেক্ষা করছে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার। আলোর বিন্দুগুলো আর একটু তেজ হারালেই, আর একটু ম্রিয়মাণ হলেই তাদের জায়গাজমি দখল করে নেবে অন্ধকার কণারা। আমার তিন বছরের কন্যার আধো আধো গলা শোনার ইচ্ছায় তখন মনের মধ্যে কাঠবিড়ালির পিড়িক পিড়িক। ট্রেন ছাড়ার একটু আগে আমার উল্টোদিকে এসে যে আসন গ্রহণ করল সে একটি মধ্যবয়স্কা মহিলা।
মহিলাটিকে বেশ উদ্বিগ্ন ও বিচলিত দেখাচ্ছিলো। আমি বেশ বেখেয়ালেই মহিলাটাকি একবার খেয়াল করে ফেললাম বেশ ভালো করে। আমিতো ওকে চিনি!
'মাফ করবেন, আপনি ঝুমুর না?'-জিজ্ঞেস করে ফেললাম কোন প্রস্তুতি ছাড়াই।

মহিলাটি আমার দিকে তাকালো। বেশ বিরক্তি নিয়েই তাকালো। কোন উত্তর করলো না। আমার আবার উচ্চ শব্দ করে জিজ্ঞেস করলাম-
'আপনার নাম কি ঝুমুর?'
মহিলাটি উঠে চলে গেলো। আমিও অবাক হলাম, বিরক্ত করলাম বোধহয়। একটা বিচলিত বোধ নিয়েই আমার ঝুমুরের কথা মনে পরতে লাগলো। ঝুমুর আর আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় একবার পুলিশ আমাকে পিটিয়ে টেনে গাড়িতে তুলছিলো। ঝুমুর পুলিশের গাড়ির সামনে গিয়ে হাত মেলে দাঁড়িয়ে বলেছিলো-
'খবরদার ওকে গাড়িতে তুলবি না! তোদের সবক'টাকে আমি খুন করবো তাহলে।'
সেদিন ঝুমুরসহ আমাদের তের জনকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলো পুলিশ। সারারাত একটি রুমের মধ্যে একা ছিলো মেয়েটি।
খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো আমাদের। একদম রক্ষনশীল একটা পরিবারে ঝুমুরের বেড়ে উঠা। ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে চাইনি ওর বাবা। সেই অভিমানে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো মেয়েটি। চির অভিমানী, সাহসী ও প্রচন্ড মেধাবি এই মেয়েটির সাথে সম্পর্ক ছিলো রাহুল শেখ নামের বাম সংগঠনের এক ছাত্রনেতার। কিন্তু ছেলেটি তাকে ঠকিয়েছিলো। তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার পর ছেলেটি বলেছিলো, সে তাকে বিয়ে করবে না। প্রচলিত বিয়েতে আগ্রহ নেই তার! পরে এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে ঝুমুর ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। গ্রেজুয়েশন করেনি আর। আমি ওর ঠিকানা জানতাম না। ও চলে যাওয়ার পর ওকে ভীষণ মনে পড়তে থাকে আমার।

এর মধ্যেই ট্রেনে শোরগোল শুরু হলো। চলন্ত ট্রেন থেকে নাকি একটা মহিলা ঝাপ দিয়েছি। কথাটা শুনেই আমার ঝুমুরের কথা মনে পরতে লাগলো। আমি সেদিন বাসায় যেয়ে আর ঘুমাতে পারিনি আর।

পরেরদিন অফিসে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে সারা বাংলাতে সেই আত্মহত্যার খবরটা পেলাম। নাম পরিচয় দেখে আঁতকে উঠলো বুকটা। সাদিয়াতুল জান্নাত ঝুমুর। স্বামী সংসারে ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে , একসময়ের খুব সাহসী প্রচন্ড জেদী মেয়েটি!
টের পেলাম, চশমাটা ভিজে যাচ্ছে আমার।

অনেককাল আগে একটা চিঠি লিখেছিলাম। থানা থেকে ছাড়া পাবার পরদিন। কিন্তু রাহুলের সাথে সম্পর্কের কথা জেনে চিঠিটা আর ওকে দেয়া হয়নি কখনো! ঐটাই আমার জীবনের প্রথম পত্র ছিলো, কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
নিস্তরঙ্গ সেই চিঠিটা এখন কোথায় ফেলে রেখেছি জানিনা কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমার হাতে তার প্রাপকের সংবাদ। চিরন্তন চলে যাওয়ার সংবাদ!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:১২
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×