মোটা দাগের কথা
সাইফুল বাতেন টিটো
জাবালে নুরের সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি শ্যামলির শিশু মেলা থেকে আবার বৈশাখীতে যাতায়াত শুরু করেছি। বাসে প্রতিদিনই কিছুনা কিছু ঘটনা ঘটে যা আমার মনে থাকে। আজ তেমন একটি ঘটনা ঘটেছে। আমি যেখান থেকে উঠি সেখান থেকে উঠে সিট পাওয়ার আশা আমার কমই থাকে। বাসে অবৈধ দাড়ানো যাত্রী হবো এটা ভেবেই রাগবির বলের মত বাসের হ্যান্ডেলটা ধরি। আজ সিটটা পেয়ে গেলাম। উঠে দেখি সামনের তিন সারী মহিলা সিটে প্রত্যেক তিন সিটের সারিতেই একটি করে সিট খালি রয়েছে। পিছনেও সিট খালি আছে। আমি পিছনের দিকে এগিয়ে গেলাম। হয়তো শনিবার বলে এত ফাঁকা সিটের সমারহ। তিন জনের সিটে দুইজন বসে আছে, আমি এগিয়ে যেতেই আমাকে তাদের মাঝখানে বসার জন্য জায়গা করে দিলো। আমি তাতে অখুশি হইনি কারন আমার শীতের কাপড় নেই। টাকা নেই বলে এখনও কিনতে পারিনি। এই দুইজনের গা থেকে যে গরম বের হবে তাতে আমার আরামই লাগবে। আমি গিয়ে বসলাম। আমি বসার পর আরো লোক উঠল। আগারগাঁও সিগনাল থেকে আঠার উনিশ বছর বয়স্ক (বেশীও হতে পারে।) এক হকার উঠলো- এর মধ্যে চেকার উঠছে নামছে, কয়েকজন নেমে গেলো। হকার তার পন্যের গুনাগুন গাওয়া শুরু করল। সে ড্রাইভারের কাছাকাছি জায়গায় দাড়িয়ে বলছে আর আমি তো পিছনের দিকে তাই আমি তার কথা শুনছি তবে বুঝতে পারছি না যে সে কি বলছে। তার পন্যটি একটি কলম কিংবা পেন্সিল। এক সময় বাস আবার ফাঁকা হয়ে গেলো। হকার ছেলেটি আছে। তার সামনে থেকে দুটি দাত ভাঙা। কায়দা করে একটু মোচও রেখেছে যা তার চেহারায় ফাজিল ফাজিল একটা লুক এনে দিয়েছে। আমি কেন, যে কেউ বলে দিতে পারবে এর জীবন যাপন। গায়ে অতি পাতলা একটি হাফ শার্ট যা এই শীতের কাছে হাস্যকর ঠেকাবে। আমারটা তো তবু ফুল শার্ট। শরীরে হাড় আর চামড়া ছাড়া যা রয়েছে তা একেবারে না থাকলেই নয়। এ হয়তো আগারগাও বিএনপি বস্তির-ই ছেলে। কিংবা ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের উল্টো দিকে যে পার্কটি রয়েছে (আমি নাম জানিনা, কেউ জানলে কমেন্টেস এ লিখে দিবেন।) সেখানে হয়তো ওর পরিবার থাকে। সে পরিবারে বাবা মা থাকলেও থাকতে পারে আবার কেউ নাও থাকতে পারে। একে কোন দিন তার মা ডিম পাওরুটি মাখন দিয়ে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে ব্রাসে পেষ্ট লাগিয়ে ঘুম ভাঙায়নি। গাড়ির হর্নেই জীবনের বেশীর ভাগ সকালে ঘুম ভেঙেছে, ঘুম থেকে উঠে লড়াই শুরু করতে হয়েছে সকালের খাবারের জন্য। কোন দিন-ই হয়তো সে স্কুলে যায়নি। এদের আয়ের ভালো মওসুম হরতাল কিংবা রাজনৈতিক অস্থির সময় গুলো। তখন গাড়ী ভাঙা, বোমা ফাটানো, কিংবা এরকম আরো অনেক কাজ করে এরা সেই সময়ে ভালো আয় করে। আবেগ এদের কখনও স্পর্শ করে না। খাওয়া আর যৌনতাই এদের কাছে একমাত্র বিনোদন। আমি একসময় এদের সাথে জীবন কাটিয়েছি। সে আরেক গল্প। কষ্মিন কালের কথা নামে আমি আরেকটি লেখা লিখছি সেখানে বলব। যাই হোক যে কথা বলছিলাম- শিবের গীত না গেয়ে ধান ভানি। তো সেই হকার ছেলেটি হঠাৎ সামনে মেয়েদের সীটের ঠিক পিছনের সিটে এক ভদ্র লোকের (পোষাকের ভদ্রলোক) সাথে তর্কে জড়িয়ে গেলো। হঠাৎ সেই লোক হকার ছেলেটিকে বলে উঠলো ব্যাটা হকার হকারের মতো থাকবি।
-কেন হকার কি মানুষ না?
-চুপ থাক বেয়াদপ।
শনিবার বলে রাস্তা একটু ফাঁকা। বৈশাখী বাসের ড্রাইভার জোরে টানছে। সামনে উত্তেজনা বাড়ছে। তর্ক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ছে সামনে থেকে পিছনের দিকে। সবাই হকার ছেলেটিকে ধমকাচ্ছে, থামতে বলছে, নামতে বলছে। সবাই ড্রাইভারকে বলছে বাস থামিয়ে ছেলেটিকে নামিয়ে দিতে। যে কোন জায়গায় বাস থামোনো যায়না বলে ড্রাইভার গাড়ী থামাচ্ছে না। ছাগল যেভাবে পানি দেখলে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকে ছেলেটিও সেই ভাবে দাড়িয়ে আছে আর সবার কথার জবাব দিচ্ছে। দুয়েকজন অশ্লিল গালী এর মধ্যে-ই শুরু করেছে। হঠাৎ করে আমার বিপরীত পাশে সিটের এক হুজুর বেশ হাক দিয়ে ছেলেটিকে ধমক দিলো। (যেমন আর্মিতে বেয়নেট ফাইটিংএর সময় মুখে কালি মাখানো বিভৎস চেহারার জোয়ানরা হায়দার বলে চিৎকার দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘাবরে দেয়) অনেক গুলো কথা বললো যার সংক্ষেপ এই যে তুই এখনই নেমে যাবি না হয়ে তোকে গন ধোলাই দেয়া হবে। বাসের সবাই হুজুরের দিকে তাকালো আর সমর্থন সুচক কিছু কথা বলল। হকার ছেলেটি বলল
- আপনে চ্যাতেন ক্যান আপনার লগে কিছু হইছে? হ্যায় আমারে কি কইছে শুনছেন? হ্যায় আমারে মা তুইল্যা গাইল দিলো ক্যান আমি কি মানুষ না? না আমি হকার বইল্যা যা ইচ্ছা তাই কওন যাইব। হ্যার বিচার আগে করেন। নাকি আমার লগে পারেন হ্যার লগে পারেন না।
বলার সাথে সাথে হুজুর বাম হাত দিয়ে ছেলেটির কলার ধরে যে হাত দিয়ে সে খাবার খায়, যে হাত দিয়ে ওজু করে, যে হাত দিয়ে পবিত্র ক্বোরানের সুরায় তার শাহদৎ আঙ্গুল বুলায় সেই হাত আর শরিরের সর্ব শক্তি দিয়ে থাপ্পর দিলো। ছেলেটির মাথা স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো দুলে উঠল। নিশ্চই ছেলেটি তখন চোখে লাল সবুজ কিছু এখটা দেখছে। আমি এরকম থাপ্পর আমার বাবার হাতে, পুলিশের সেপাইর হাতে, আর ট্রেনিং ব্যাটালিয়নে সার্জেন্ট মাসুদের হাতে খেয়েছি। থাপ্পর খাওয়ার সাথে সাথে ছেলেটির মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু বন্ধ হলো না হুজুরের হাত। আমার সামনের বসে থাকা এক টুপি পড়া মুরুব্বি বলে উঠলেন ‘‘আরো কয়েকটা দেও কুত্তার বাচ্চারে আরো কয়েকটা দেও তারপর জানালা দিয়া ছুইরা ফালাও বান্দির পুতেরে।’’ হুজুর যে মুখ দিয়ে দিনে পাঁচ বেলা মহান আল্লাহ পাককে ডাকেন, যে মুখ ঠোট দিয়ে মায়ের স্তন চুষেছে, যে মুখে তার নিস্পাপ শিশু সন্তানকে চুমু খেয়েছে সেই মুখ দিয়ে হকারের বাবা মা চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছে আর তাকে ঘাড় ধরে ঠেলছে। কিন্তু তার হাতের কাজ থামে নাই।
আমি জানিনা ঐ হুজুরের সাথে আমার আর কোন দিন দেখা হবে কিনা। কিংবা এও জানিনা আপনি আমার এই মোটা দাগের কথা পড়বেন কিনা। কিন্তু তার পরও আপনার কাছে একটা কথা জানতে চাই
‘‘ছেলেটি এমন কি অপরাধ করেছিলো যে মহান আল্লাহ নিজ হাতে বানানো ছেলেটির ঐ মুখে আপনি আপনার পবিত্র হস্ত মোবারক দিয়ে এতগুলো আঘাত করেছিলেন? আপনি কি ঐ ছেলেটির ভয়ার্ত চোখ দুটির দিকে একবারো তাকিয়ে কোন মায়া অনুভব করেন নি? আমার মনে হয় এমন নিষ্ঠুর হওয়ার আদেশ আপনার ধর্ম আপনাকে দেয়নি।’’
ছেলেটি বাস থেকে নামছে না। কন্ডাকটর এখন ছেলেটিকে নামানোর জন্য তার হস্ত মোবারক ব্যবহার শুরু করেছে। ছেলেটি একসময় নেমে গেলো।
বাস চলছে। আমি চুপ চাপ বসে আছি। বাসে একটা থমথমে নিরবতা চলছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে সামনে থেকে এক মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলো। এতক্ষন ছেলেটিকে একলা পেয়ে মারলো কেউ কিছু বললো না।
মহিলার জবাবে পিছন থেকে একজন বলল
- হারামির বাচ্ছা একটা আস্তা বেয়াদপ। ওরে আরো মারা উচিৎ ছিলো আপনে বহেন খালা।
- বেয়াদপ, না? আপনে ওর মায়রে তুইলা গালি দিলেন ক্যান হ্যা? আপনের মা নাই? আহারে ছেলেটারে একলা পাইয়া কি মাইরই না মারলো। ছেলেটি কিচ্ছু বলল না। নিচের দিকে তাকাইয়া টপ টপ পানি ফালাইয়া নাইম্মা গেলো।
হঠাৎ করে দেখলাম চে গেভারা’র ফোন। রিসিভ করে আমি বললাম-
- লাল সালাম গুরু।
- লাল সালাম, তুমি এইটা কি করলা সাইফুল বাতেন টিটো। নিজেরে তো রেভুলেটর বলন মারাও। পাললা না হুজুরের কানসি বরাবর একটা ফ্লাইং কিক মারতে?
- ভাই বাসের সবাই একদিকে আর আমি একদিকে আমারে তো ছাতু বানাইয়া হালাইতো।
- ক্যান আবার কও তো কিসের আনসারে না কোন বালে চাকরি কইরা আইছ...
- গুরু আমি তো আনসারে না বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে ছিলাম। চাকরী তো ছাইরা দিয়া আসছি।
- ট্রেনিং কি জমা দিয়া আসছো?
- আপনি তো সবই জানেন গুরু।
-জানি জানব না কেন। তোমাদের মতো মুখোস ধারী রেভুলোটরেরাই তো আমার ছবি তাদের জুতায় লাগাইয়া ঘোরে আর নিজেরে বলে আমি চে’র আদর্শে বিশ্বাসী। তোমার চাইতে ঐ সামনের সিটের মহিলার মধ্যে বিপ্লবী চিন্তা বেশী। তুমি হইলা একটা বালের বিপ্লবী। ছেলেটা যখন বার বার বলল আমি হকার বলে কি মানুষ না.. সেই প্রশ্ন তোমার কানে ঢোকে নাই? হালার ভন্ড কোহানকার। বালের বিপ্লবী। ক্ষতিকর বিপ্লবী। থু...!!!
আমার কানে একদলা ছ্যাপ এসে লাগলো। আমি মোবাইল কেটে রেখে দিলাম। সে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বুঝতেছেনা দেইখা আমার উপর ক্ষ্যাপছে।
- নতুন বাজার নতুন বাজার... গেটে আহেন।
আমি নেমে পরলাম। এখন বিষয়টি চুপ চাপ ভুলে যেতে হবে। চে গেভারা আমার চাইতে সিনিয়র বিপ্লবী। বড় ভাই। বড় ভাইরা একটু আধটু বললে কিছু আসে যায়না। ভবিশ্যতে যাতে না বলতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনারা কি বলেন?