আমরা প্রায় সবাই জানি, স্থূলতাকে এখন একটি রোগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। উন্নত দেশগুলোতে আজ স্থূলতাকে এপিডেমিক বলা হচ্ছে। সেডেন্টারি লাইফ স্টাইল এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস স্থূলতার বড় কারনগুলোর মধ্যে অন্যতম। আজকাল স্থূলতা নিয়ে অনেক গবেষণা কিংবা লেখা সবজায়গায় পাওয়া যায়। তবুও, আমার আজকের লেখার মূল বিষয়টি স্থূলতা নয় বরং আমাদের উপমহাদেশে স্থূলতার সমান আরেকটি নীরব ঘাতক, এর নামটাও বেশ , থিন আউটসাইট ফ্যাট ইনসাইড ( টোফি) । সহজ বাংলায়, বাইরে চিকন ভেতরে মোটা।
-এইটা আবার কি ?
-হ্যাঁ, এইটাও এক ধরনের স্থূলতা।
- কিন্তু কেন ?
-চলুন না, এটা নিয়ে আজকে ধাপে ধাপে আলোচনা করা যাক-
স্থূলতা কিংবা এর ছোটভাই টোফি দুটোই নিয়ে জানতে গেলে প্রথমে জানতে হবে বিএমআই নিয়ে। বডি মাস ইন্ডেক্স বা বিএমআই হচ্ছে আপনার উচ্চতা ও ওজনকে বিশ্লেষন করে নির্ণয় করা- আপনার ওজনটি আপনার জন্য স্বাস্থ্যকর কিনা। আমার মনে হয়, ব্লগে মোটামুটি সবাই বিএমআই নিয়ে জানেন। ভুলে গেলে চটজলদি এখানে গিয়ে দেখে নিতে পারেন। তো, বিএমআই হিসেব করে আমরা একটা সংখ্যা পাই। সংখ্যাটা নিচের চার্টটার মতে আপনাকে বলে দিবে, আপনার ওজন কি স্বাভাবিক নাকি কম নাকি বেশী অথবা অতিরিক্ত বেশী
চার্ট অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২৫ থেকে ৩০ এর আগ পর্যন্ত ওভারওয়েট এবং ৩০ এর উপর স্থূলতা বা ওবেসিটি। এটাই এতদিন ধরে প্রচলিত। এই বিএমআই অনুযায়ী আমরা যাদের ওভারওয়েট বা ওবেস বলে সংজ্ঞায়িত করি, তাদেরই হার্টের সমস্যা, কোলেস্টেরলের সমস্যা, ডায়াবেটিস, ফ্যাটি লিভার সহ নানা সমস্যার ঝুঁকি বেশী থাকে এটা সবাই জানে। এর মাঝেও কয়েকটি কিন্তু আছে। প্রথমত, একজন স্থূল ব্যাক্তি যেকিনা স্মোকিং করেন/ ড্রিংক করেন তার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিগুলো স্থূল কিন্তু অন্য কোন রিস্ক ফ্যাকটর ( যেমন স্মোকিং, ড্রিংকিং, স্ট্রেস) নেই এমন ব্যাক্তির তুলনায় বেশী। দ্বিতীয়ত, আপনার জেনেটিক্স কতোটুকু শক্তপোক্ত এবং আপনার জীবন যাপন ও চারপাশের পরিবেশ কেমন সেটার উপর ভিত্তি করে ঝুঁকিগুলো রোগে পরিণত হয় । তৃতীয়ত, উপরে যে বিএমআই বা বডি মাস ইনডেক্স নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটা শুধু মাত্র ওয়েস্টার্নদের জন্য।সাউথ এশিয়ানদের ( বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, চায়্না সহ দেশগুলোর মানুষের) জন্য সঠিক নয়।
হতেই পারে, বিএমআই ক্যালকুলেটরে হিসেব করে আপনি নিজেকে হালকা স্বাস্থ্যকর ওজন বা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর ওজনের একজন বলে ধরে নিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার জন্য আপনার নির্ণয় করা বিএমআই ভুল হতে পারে, যেহেতু আপনি একজন সাউথ এশিয়ান। আবার কেন?
চলুন, আমরা হার্ভার্ডের পাবলিক হেলথের এই লেখাটা ঘুরে আসি।
কিছু বাক্য এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি এইখানেও তুলে দিচ্ছি- With the emergence of more research, however, several groups have begun to set lower cutoff points for BMI and abdominal obesity metrics among Asians. (13,14) China and Japan define overweight as a BMI of 24 or higher and obesity a BMI of 28 or higher; in India, overweight is defined as a BMI of 23 or higher, and obesity, a BMI of 27 or higher. And the International Diabetes Federation now includes ethnic-specific criteria for the definition of abdominal obesity. (14)
( বাক্যের পাশের সংখ্যাগুলো রেফারেন্সের অংশ, ওয়েবসাইটে গিয়ে গ্রহনযোগ্য জার্নালগুলোয় প্রকাশিত গবেষণাগুলোও পড়তে পারেন)
মানেটা কি বুঝলেন ? সহজ কথায়, আমাদের কাউন্টারপার্ট একজন আমেরিকান বা ইউরোপিয়ানের জন্য বিএমআই ২৫ থেকে ৩০ মানে ওভারওয়েট আর ৩০ এর বেশী ওবেসিটি বা স্থূলতা, কিন্তু আমাদের জন্য ২৩/২৪ মানেই ওভারওয়েট এবং বিএমআই ২৭ মানেই স্থূলতা!
আসলে এইখানে এই বিএমআই বা আদর্শ ওজনের মাপামাপি সবই মূলত জেনেটিক্সের খেলা। এতদিন পর মেডিকেল সায়েন্স এই কথা স্বীকার করেছে। এটার ব্যাখ্যা পরে করছি। আগে এতোটূকু বলে নেই- একজন সাউথ এশিয়ানের জেনেটিক্স তার বিএমআই ২৭ কে সাপোর্ট করে না, তার জন্য এই ওজন- স্থূলতা। ( যদি না ____ )
তাহলে এবার ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের এইখানে ঢু মেরে আপনার জাতীয়তা অনুযায়ী আপনার আদর্শ ওজনটি আরেকবার দেখুন ।
হ্যাঁ, এতদিন ধরে আপনার যে ওজনটি ওয়েস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ডে আদর্শ ছিল, সেটা আপনার জাতীয়তা অনুযায়ী আদর্শ নাও হতে পারে, সেটাই প্রথম কথা। প্রথমেই, এই সত্যটি মনে প্রানে ধারন করুন ।
এতক্ষন কিন্তু পটভূমি রচনা করলাম আজকের আলোচ্য বিষয়ের। এবার আলোচনায় ঢুকি, আরেকটু ...
দেখা যাচ্ছে, সাউথ এশিয়ান মানুষদের পশ্চিমাদের চেয়ে তুলনামূলক কম ওজনেই অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী বা স্থূলকায় বলা হচ্ছে। কিন্তু এতে কি সমস্যা ? এজন্য সহজ বাংলায় স্থূল হলে শরীরের ভেতরে কি সমস্যা হচ্ছে তা বুঝা দরকার- অতিরিক্ত ওজন আপনার শরীরের যাবতীয় রোগ সৃষ্টিকারী জিনগুলোকে সচল করে দিতে পারে, যেমন ছোট একটি উদাহরন দেই- ধরুন, কারো শরীরে হাইলিপিডের জিনগুলো আছে, কিন্তু জীবনের এক পর্যায় পর্যন্ত সেগুলো সচল ছিল না কারন ওই জিনগুলোকে সচল করার জন্য যে অতিরিক্ত ওজন দরকার সেটা ছিল না। এখন একই ব্যাক্তি যখন অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়াতে ওজন বাড়ালেন এবং স্থূল হলেন, তার হাইলিপিডের জিনগুলো সচল হয়ে হাইপারলিপিডেমিয়া করে ফেললো। যার ফলে পরবর্তীতে হার্ট বা ব্রেনে বড় সমস্যা হতে পারে। একইভাবে অন্য বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রেও ভেবে নিতে পারেন যেমন হাই ব্লাড প্রেশার, টাইপ টু ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
তারমানে, অতিরিক্ত ওজন জেনেটিকভাবে দুর্বল মানুষের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ ( হাই ব্লাড প্রেশার, টাইপ টু ডায়াবেটিস, হাইপারলিপিডেমিয়া) সহ নানা রোগ করতে পারে। এই হাই ব্লাড প্রেশার থেকে স্ট্রোক হয়, ডায়াবেটিস থেকে কিডনীতে-চোখে-নার্ভে- হার্টে সমস্যা হয়, হাইপারলিপিডেমিয়া থেকে হার্ট এটাক বা ব্রেনে স্ট্রোক হয়। কি অদ্ভুত, মেডিসিনের প্রায় অধিকাংশ কমন রোগগুলো এইখানে চলে আসছে তাই না ?
কিন্তু সাউথ এশিয়ানদেরই সমস্যাটা কেন ?
আমার আজকের পোস্টের মূল বিষয় এখানেই। সাউথ এশিয়ানদের সমস্যাটা কেন ? আর আগে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেই, উপরের আলোচনা থেকে আমরা দুটো বিষয়ে একমত হতে পারি-
১) ওয়েস্টার্ন বিএমআই স্কেলের মানদণ্ডে সাউথ এশিয়ানদের বিএমআই হিসাব করা যাবে না।
২) আমাদের চোখে যা স্বাভাবিক ওজন ( অন্তত এতোদিন) তাতেই আমাদের সাউথ এশিয়ানদের নানা শারীরিক সমস্যার কারন হতে পারে।
এবার, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট- অধিকাংশ সাউথ এশিয়ানদের এই সমস্যা হওয়ার পেছনে অন্যতম কারন তাদের শরীরের মাসেলের অংশ কম এবং ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ বেশী। সহজ করে বললে, পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চির একজন সাধারন সাউথ এশিয়ান লোকের ওজন ৭৫ কেজি মানে এর ব্যাখ্যা দুটো হতে পারে- তার শরীরে ১৫ পারসেন্ট ফ্যাট/চর্বি এবং বাকিটা মাসেল অথবা তার শরীরের ৩০ পারসেন্ট ফ্যাট/চর্বি এবং বাকিটা মাসেল।
উপরের ছবিতে একই ওজনের দুইজন লোকের মধ্যের পার্থক্য দেখুন।
দেখা যায়, সাউথ এশিয়ানদের জন্য ব্যাখ্যার দ্বিতীয় অংশটাই মিলে যায়। মানে আমাদের সাউথ এশিয়ানদের শরীরে জেনেটিক্সের কারনেই চর্বির/ ফ্যাটের পরিমাণ বেশী এবং মাসেলের পরিমাণ কম। এটাকে TOFI thin on the outside, fat inside বলা হয়।
সাউথ এশিয়ান মানুষের গঠন কেমন ? একজন এভারেজ সাউথ এশিয়ানের হাত পা তুলনামূলক ছোট এবং সামনে একটা ভুঁড়ি তাই তো ?
এই যে, এটাই তো বড় সমস্যা। সারা শরীরে মাসেল কম আর সামনে ফ্যাট বা চর্বি বেশী। এই ধরনের শরীরে ভিসেরাল ফ্যাটের পরিমাণ বেশী মানে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অর্গান ( লিভার, হার্ট,প্যানক্রিয়াস ইত্যাদিতে) চর্বির পরিমাণ বেশী। ভিসেরাল ফ্যাট নিয়ে যদি না জেনে থাকেন, তাহলে What Is Visceral Fat?
নিচের ছবিতে স্ক্যান করা দুটো ছবি দেখুন, একই বিএমআই কিন্তু দুইজনের শরীরে ভিসেরাল ফ্যাটের আকাশ পাতাল পার্থক্য-
আরেকটু সহজ করে দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আমাদের আশেপাশে অনেক মানুষকে দেখেছেন একটু সামান্য হেলথি ( আমাদের সমাজের চোখে) কিন্তু পরে একসময় জানা গেল তার ফ্যাটি লিভার/ হার্টের আরটারিতে ব্লক/ টাইপ টু ডায়াবেটিস। সবার পরিচিতদের মধ্যে এমন মানুষ আছেন এবং এদের সংখ্যা অনেক। কখনো ভেবেছেন তার কেন এমন হলো ? আজকে জেনে রাখুন ওই মানুষটির গঠন thin on the outside, fat inside বা টোফি।
ভেবে দেখলে, আমাদের দেশের দশটা ঘরের মধ্যে ছয়টা ঘরেই আপনি টোফি ক্যাটেগরির মানুষ পাবেন। এটা যে কতোটা নীরব ঘাতক তা কি কখনো আমরা ভেবে দেখেছি ?
আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি, আপনাদের একটা কাজ দেই। এখানে গিয়ে, আপনার বডি ফ্যাট পারসেন্টেজ হিসেব করুন -বডি ফ্যাট পারসেন্টেজ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০২২ সকাল ৯:২৫