তখন অনেক অনেক ছোট। এই ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়ি হয়তো। গ্রামে থাকি। সত্যি কারের গ্রাম যাকে বলে। বাড়ির যে দিকেই যাইনা কেন মাটির কাঁচা রাস্তা। রাস্তা পেরুলে বা উঠলেই ছোট খাল বা বয়ে চলা জলাশয়। চারদিক গাছে-গাছে ছেয়ে আছে। যেন গাছেরই ছাদের তলায় কুড়ে ঘর। সত্যি কারের কুড়ে ঘর। আর গ্রামে শীত একটু আগেভাগেই আশে। সেও কি শীত স্বাভাবিক গরম কাপড়ে টিকে থাকা দায়। তো সেই সময় নিজেদেরকে গরমের আরাম দেয়ার স্বাভাবিক আর নিয়মিত তিনটি উপায় ছিল।
একঃ কখন ঘন গাছের ছাদ আর পাতার আচ্ছাদনের ফাঁক ফোঁকর গলে এক চিলতে রোদ এসে পরবে সামান্য খোলা উঠানে। আর কে কার আগে সেই জায়গায় গিয়ে বসবে পাটি পেতে। একজন হয়তো বেশ আগেই পাটি পেতে বসেছে, অন্য আর একজন গিয়ে তার চেয়ে আর একটু আগে বসে পরলো!
ব্যাস তার দেখাদেখি আর একজন তার চেয়েও সামনে গিয়ে বসতে চেষ্টা করলো। ওমনি শুরু হয়ে গেল ঝগড়া আর কলহ। রোদ, রোদ পরা যায়গা আর কে কোথায় বসবে সেই নিয়ে। মাঝে মাঝে চরম আকারও ধারন করতো সেইসব ঝগড়া! স্বাভাবিক ভাবেই জয় হত তার বা তাদের, যাদের বাড়ি আর যাদের যায়গা সেটা। বাকিরা এবার গালাগাল করতে করতে উঠে পড়তো বা উঠতে বাধ্য হত।
তবে কিছু ভবিষ্যৎ হুমকি ঠিকই দিয়ে যেত পরাজিতরা! যেমনঃ “আসবিনা আমাদের উঠানে খেলতে?” “আসবিনা আমাদের মাঠে ধান শুকাতে বা কাঁথা শুকাতে?” “যাবিনা বিকেলে আমাদের সাথে, আমাদের মাঠের জায়গায় খেলতে!” ইত্যাদি ইত্যাদি।
দুইঃ যাদের নিজেদের অনেক ধান হত, সেই ধান সেদ্ধ করতে উঠোনের মাঝখানে ইট দিয়ে উঁচু করে, ধানের খড় দিয়ে জ্বালানি বানিয়ে ধান সেদ্ধ করতো। আর সেই আগুন জ্বলে ওঠার আগেই তার চারপাশে ছোট-বড়, বুড়ো-খুঁড়ো সবাই গোল করে যায়গা দখল করে নিত। আবার কেউ কেউ অন্যের জন্য যায়গা রেখেও দিত!
তারপরও চলতো এর গা ঘেঁসে, ওর পিঠ ঘেঁসে একটু আধটু আগুনের উত্তাপ নেয়ার অবিরাম চেষ্টা। সেখানেইও সেই একই বিপত্তি। শেষমেশ সেই একই জয়-পরাজয়ের আখ্যান। যাদের বাড়ি আর যাদের ধান, তারা আর তাদের কাছে পিঠের মানুষরাই শেষ পর্যন্ত আগুনের আরাম পেত!
আবারো ফিরে যাবার সময় সেই একই রকম হুমকি!
তিনঃ স্কুলে যাবার পরে। ক্লাস থেকে বাইরে বের হওয়া যাবেনা, তাহলে স্যারেরা দেখে ফেলবে আর পরে ক্লাসে এসে বকা-ঝকা তো আছেই সাথে দুই একটি বেত্রাঘাতও পরতে পারে। তাই ক্লাসের জানালার কাছে, যেখানে রোদ এসে পরে গাছপালা বা পাতার ফাঁক গলে, কে কার আগে বসবে সেটা নিয়েই চলতো চরম প্রতিযোগিতা। খুনসুটি, ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি। এমনকি মারামারি পর্যন্ত!
শেষে নালিশ, অভিযোগ, বিচার এমনকি কান ধরে উঠ বস করা পর্যন্ত! কখনো কখনো বেঞ্চের উপরে দাড়িয়ে থাকার শাস্তি, কখনো বা বেঞ্চের নিচে মাথা রেখে পিঠে নেয়া বেত্রাঘাত! উহ কি সব দিন ছিল! এবং ক্লাস শেষে আবারো ঝগড়া আর মারামারির নিয়মিত ব্যাঞ্জনা!
আর আজকাল?
কোথায় শীত, কোথায় রোদের জন্য অপেক্ষা, আকুলতা আর ঝগড়ার সেই নিখাদ আনন্দ?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:০৮