১।
রাত ১২ টা। সিনেমা দেখছিল সাব্বির। খুব জমে উঠেছে সিনেমা। টানটান উত্তেজনা। বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে সাব্বিরের। এমন সময় ফোন এল একটা।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। এই সময়ে কেন যে ফোন আসে। ফোনটার দিকে চেয়ে দেখল সে। প্রেমা ফোন দিয়েছে। প্রেমা সাব্বিরের ছাত্রী। সামনে পরীক্ষা ওর। যে কোন সমস্যাতেই ফোন দিয়ে বসে। সাব্বির আনন্দচিত্তে সমস্যার সমাধান করে দেয়। তবে আজকে ভালো লাগছে না ফোন ধরতে। সিনেমায় এত সিরিয়াস একটা অবস্থা। তবে ফোন ধরা উচিৎ, বেচারী হয়ত খুব ঝামেলায় পড়েছে। ফোন ধরে সাব্বির।
হ্যালো ভাইয়া, আমি না একটা অংক মিলাতে পারছি না। প্রেমা কেমন আহ্লাদ করে বলে।
কোন অংক?
ভাইয়া, ৫ নাম্বার চাপ্টারের ৭ নাম্বার অংকটা।
সাব্বির বই খুলল। প্রশ্নটা দেখে খুব মেজাজ খারাপ হল ওর। এই অংক না পারার তো কোন কারণ নেই। একই নিয়মের অনেকগুলো অংক করিয়ে এসেছে সে। এটা না পারলে আগের একটা অংক ও তো পারার কথা না। তবু অনেক কষ্টে মেজাজ ঠান্ডা করে অংকটা সলভ করে দিল সে।
ভাইয়া, কী করেন? প্রশ্ন করে প্রেমা।
সিনেমা দেখি।
কথা বাড়ানোর ইচ্ছা না থাকায় আর কোন প্রশ্ন করে না সাব্বির।
ভাইয়া, কী সিনেমা?
ইংলিশ সিনেমা।
আপনি কি প্রেমের সিনেমা দেখেন?
হ্যাঁ দেখি মাঝে মাঝে।
ভাইয়া, আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে।
আচ্ছা, শুনে খুশি হলাম, এখন পড়। আমি রাখছি ফোন।
আপনি এমন কেন, ধুর! বলেই ফোন রেখে দেয় প্রেমা।
মেয়েটা তো ভালোই বেয়াদব, এভাবে ফোন রেখে দিল। থাক ব্যাপার না, আমার মাস শেষে টাকা পেলেই চলবে।
আবার সিনেমা দেখতে থাকে সাব্বির।
২।
আগামীকাল থার্মোডায়নামিক্স পরীক্ষা। পড়া শুরু করতে হবে, কিছুই পড়া হয়নি। সাব্বির বইপত্র বের করে পড়তে বসল। সাথে চা নিয়ে নিল। পড়তে পড়তে চায়ে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা। বই খোলার সাথে সাথে প্রেমা ফোন দিল। বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরল সাব্বির।
হ্যালো ভাইয়া, আপনি প্লিজ এখনই আমার বাসায় আসেন, না আসলে আমি কালকে ফেইল করব। একদম কিছুই পারি না
আমি, প্লিজ ভাইয়া। আহ্লাদে আঁটখানা প্রেমার গলা।
সাব্বিরের মেজাজ চরমে উঠল। কালকে তার নিজেরও পরীক্ষা, তার উপর কিছুই পড়া হয়নি। যেতে ইচ্ছা করছিল না মোটেই। তবু দায়িত্বের কথা ভেবে সাব্বির বলে,
আমি আসছি, তবে কালকে আমারও পরীক্ষা। বেশীক্ষণ থাকতে পারব না।
ঠিক আছে ভাইয়া, অল্প থাকলেই হবে।
প্রেমার বাসা কাছেই। আধঘন্টা পড়িয়ে চলে আসা যাবে। শার্টটা গায়ে দিয়ে বের হয়ে পড়ে সাব্বির। বের হয়েই মনে পড়ে ঘড়িটা আনা হল না। সে প্রেমাকে যে রুমে পড়ায় সে রুমে কোন ঘড়ি নেই। সে দেখেছে বেশিরভাগ টিউশনিতেই আশে পাশে কোন ঘড়ি থাকে না। বা আগে থাকলেও কিছুদিন পরে তা সরিয়ে দেয়া হয়। টিচার যাতে ঘড়ি দেখে না পড়াতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা। গাধা গার্ডিয়ানরা বুঝে না আজকাল মোবাইলেই ঘড়ি থাকে। তবে মোবাইল বের করে বারবার টাইম দেখতে ভালো লাগে না সাব্বিরের।
প্রেমার বাসায় যেয়ে অবাক হল সাব্বির। বাসায় কাজের মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বলে দাওয়াতে গেছে। তবে সাব্বির যখন রেগে একাকার হয়ে ফেরত আসবে ঠিক তখন কাজের মেয়ে বলে, প্রেমা আপা আপনাকে এই বইটা দিতে কইসে।
কী আর করা! বইটা নিয়ে হাঁটা শুরু করল সাব্বির। পেশাব করে দিতে ইচ্ছা করছে বইটার উপর। এরকম বেয়াদব মেয়েকে আর পড়ানো যাবে না।
ঠিক এ মুহূর্তে একটা মেসেজ এল ফোনে।
ভাইয়া, রাগ করবেন না প্লিজ। বইটা খুলে দেখবেন ভালোভাবে। প্রেমার এরকম মেসেজ পেয়ে খানিকটা অবাক হল সাব্বির।
দ্রুত বাসায় যেয়ে বইটা ঘেটে দেখা শুরু করল সাব্বির। মাঝামাঝি একটা পেইজে স্ট্যাপলার দিয়ে আটকানো একটা লাল খাম পেল সে। খাম খুলে একটা চিঠি পেল সে।
এই যুগে আবার চিঠিও দেয় নাকি মানুষ।
ভাইয়া,
আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে। ভালো লাগাটা একটু বেশি রকমের ভালো লাগা। আপনাকে এত নাটকীয়ভাবে চিঠি দিলাম কেন সেটা একটু বলে নেই। আমাদের যদি ফিউচারে কিছু হয় তখন অনেকেই জানতে চাইবে আমাদের প্রেম কীভাবে হল। তখন আমরা মজা করে এই কাহিনী বলব। তখন হয়ত অনেকেই হাসাহাসি করবে, মজা পাবে। একটা কাহিনী তৈরি করে ফেললাম। আমাদের এই কাহিনী নিয়ে হয়ত একদিন সিনেমা হবে। আমরা দুইজন হাতে হাত ধরে সেই সিনেমা দেখব।
যাহ! কিছু না হতেই অনেক কিছু ভেবে ফেলছি। হয়ত এই চিঠি পাওয়ার পরে আপনি আর আমার সাথে কথা বলবেন না। কিন্তু সবসময় জেনে রাখবেন আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি।
আমি সুন্দর করে লিখতে পারি না। চিঠি লিখার আগে ভাবছিলাম কোন বাংলা সিনেমা বানাব না, এখন দেখছি বাংলা সিনেমার মতই বলে ফেলছি আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি।
এ যুগে কেউ চিঠি লিখে না। এখানেও আমরা গল্প বানাতে পারব। ছেলে মেয়েদের কাছে আমরা আমাদের প্রেমের কথা বলব। চিঠির কথা বলব। ওরা হাঁ করে শুনবে। শুনে জিজ্ঞেস করবে আম্মু চিঠি মানে কী? হাহাহাহাহা...
অনেক কথাই ছিল, এখন কেন যেন কিছুই মনে আসছে না।
ইতি,
আমি
চিঠিটা পড়ে গা কেমন শিরশির করে উঠল সাব্বিরের। এই প্রথম কোন মেয়ে ওকে এরকম চিঠি লিখল। অদ্ভুত এক প্রসন্নতায় মনটা ভরে উঠল তার।
রাত ১ টা ২০ মিনিট। প্রেমাকে ফোন দিল সাব্বির।
হ্যালো প্রেমা, ছেলে-মেয়েদের কাছে প্রেমের গল্প বলতে লজ্জা করবে না তোমার?
মিষ্টি একটা হাসির শব্দ শুনতে থাকে সাব্বির...
৩।
দোলনা কেনা হয়েছে। ওয়াল জুড়ে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর বাবুদের ছবি। নতুন অতিথির জন্য সবার কত আয়োজন। সাব্বির প্রেমাকে কোন কাজ করতে দেয় না। হাঁটাহাঁটিও ধরে ধরে করায়। মাঝে মাঝে প্রেমার পেটে কান দিয়ে বাবুর সাথে কথা বলে সাব্বির। বাবু ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। ডাক্তার এখনও কিছু বলছে না। তবে সাব্বির মোটামুটি নিশ্চিত যে ওদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে। বাবুর নাম নিয়ে প্রেমা সাব্বিরের ঝগড়ার অন্ত নেই। প্রেমা অবশ্য বলে দিয়েছে বাবুর নাম সে রাখতে পারবে না, ওর ভীষণ লজ্জা লাগে। তবে সাব্বির কোন নাম ঠিক করলে সেই নাম নিয়ে ঝগড়া করতে ভুলে না প্রেমা। বাবুর জন্য ড্রেস কেনা শুরু হয়েছে। সাব্বির মেয়ে বাবুর ড্রেস কিনছে। প্রেমা মেয়ে বাবু ছেলে বাবু দুইজনের জন্যই কিনছে। প্রেমার ধারণা ওর জমজ বাবু হবে। তাও যে সে জমজ না, একটা ছেলে একটা মেয়ে জমজ। দুইটা পিচ্চি সামলাবে কীভাবে তাই নিয়ে সে চিন্তিত। প্রেমার ধারণা ছেলেটা বেশি দুষ্টু হবে। একটু বড় হলে ওরা মারামারি করবে। কী যে হবে, না না, প্রেমা ওর কোন বাচ্চাকে মারতে পারবে না।
প্রেমা স্বপ্ন দেখে, ওর বাবুরা বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করছে আম্মু! তোমার সাথে আব্বুর দেখা হল কীভাবে। প্রেমা সব ঠিক করে রেখেছে কীভাবে গল্প বলবে। ওদের আব্বুর যে পড়াতে আসার সময় একবার প্যান্টের চেইন খোলা ছিল সেই গল্প ওদের নিশ্চয়ই বলতে হবে। ছিঃ ছিঃ। না, থাক এই গল্প বলা যাবে না, পরে আবার ওদের আব্বু রাগ করতে পারে।
সেদিন রাতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল প্রেমা। কেমন ঘুরছিল চারপাশটা। পেটে প্রচন্ড ব্যথা। ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি আসার অবস্থা। প্রচন্ড খুশিতে মানুষের কান্না পায়, প্রেমার কেন যেন মনে হল ব্যথার জন্য এই কান্নাটা আসলে প্রচন্ড খুশির জন্য। প্রেমাকে হাসপাতালে নেওয়া হল। এ্যাম্বুলেন্সে পুরোটা সময় ওর হাত ধরেছিল সাব্বির। ব্যথার ধাক্কায় সাব্বিরের হাতটা প্রবলভাবে চেপে ধরছিল প্রেমা। কেউ একজন আসছে, যে আসছে সে বারবার জানান দিচ্ছে যে আমি আসছি, তোমরা
তৈরি নাকি।
রাত ৩ টা ৩০ মিনিটে প্রেমা একটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিল।
৪।
এই বাবুকে একটু ধর তো। আমি রান্না করতে যাই। প্রেমা বলে সাব্বিরকে।
ধরতে পারব না। সাব্বির কেমন চিৎকার করে বলে।
কয়েকদিন ধরেই সাব্বির ভালো করে কথা বলে না প্রেমার সাথে। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা আরও খারাপ হচ্ছে। প্রেমা সাব্বিরের এমন ব্যবহারের কারণ জানতে চেয়েছে বারবার। সাব্বির কোন উত্তর দেয়নি।
তুমি আমার সাথে এমন কর কেন? একটু রেগেই জিজ্ঞেস করে প্রেমা।
আরেকজনের বাচ্চা আমি ধরব কেন?
মানে? প্রেমার চোখেমুখে বিস্ময়।
মানে খুব সোজা। না বুঝার ভান কর কেন? তাচ্ছিল্য করে বলে সাব্বির।
মানে কী বলতে চাও, ঠিক করে বল।
আমিও ফর্সা, তুমিও ফর্সা, তাহলে এই বাচ্চা এরকম হল কীভাবে? আমার সাথে চেহারায় তো কোন মিল নেই এই বাচ্চার। চিৎকার করে বলে সাব্বির।
ছিঃ, কী বলছ এসব।
ঠিকই বলছি। মানুষজনও আড়ালে এই কথাই বলে। এইসব শুনতে আমার ভালো লাগে না।
তুমি কি আমাকে ছেড়ে দিতে চাও?
ছাড়ব তো অবশ্যই, তবে আগে এই বাচ্চার DNA টেস্ট করাব আমি, দেখব এটা আসলেই আমার বাচ্চা নাকি।
আকাশ থেকে পড়ে প্রেমা। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারে না সে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হতে থাকে তার। বাবুর দিকে তাকায় সে। বাবুর মুখটা কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে, চোখের পানি মুছল না প্রেমা।
৫।
শ্রেয়া এখন বড় হয়েছে। শ্রেয়া প্রেমার মেয়ের নাম। শ্রেয়ার মা নেই। সবাই বলে ওর মা কেন যেন আত্মহত্যা করেছিল।
শ্রেয়া এস,এস,সি পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করছে।
Mother’s Name: Prema Mahjabin.
Father’s Name: Sabbir Ahmed.