১।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল রফিকের। আজকে দেখা করার কথা, অনেকদিন পর। মিতু ঢাকা এসেছে গত পরশু। প্রায় এক বছর পর দেখা হবে আজকে। এক বছর মিতু দেশের বাইরে ছিল। ওর আব্বু ওর পড়াশুনার জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ছুটিতে এসেছে মিতু, থাকবে বড়জোর পনের দিন। মনে মনে উত্তেজনা কাজ করছে রফিকের। বিদেশে থাকতে মিতুর সাথে যে একদম কথা হয়নি তা না। তারপরও বহুদূরে থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কথা বলা আর সামনাসামনি কথা বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য।
দেখা হবে সকাল ১১টায়। এখন বাজে মাত্র ৭টা। মেসের সবাই এখনও ঘুমায়, ছুটির সময় মেসে সকাল হয় অনেক দেরীতে। টাইম কাটানো দরকার। মাত্র দিয়ে যাওয়া পেপারটা হাতে নিল রফিক। অনেকক্ষণ চলে যাওয়ার পর রফিক বুঝতে পারল সে এতক্ষণে মাত্র দুই লাইন পড়তে পেরেছে। রফিক মনে মনে হাসল। মন থেকে উত্তেজনাটা দূর করা দরকার। উল্টো গোনা শুরু করল, একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই......মিতু দেখতে এখন কেমন হয়েছে। মিতুর হাসিমাখা মুখটা মনে পড়ল তার। ওর হাসিটা কি এখনও ওরকমই আছে! ধুর, আমি না উল্টো গুনছিলাম। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় ভরে যাচ্ছে সবকিছু। রফিক আর মিতুর বয়সের পার্থক্যটা একটু বেশি, তারপরেও রফিকের নিজেকে খুব বাচ্চা মনে হল।
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল রফিকের। মিতুর ফোন। বুকটা কেঁপে উঠল তার, ঘুমিয়ে দেরী হয়ে গেল নাকি! ফোন ধরতে ধরতে সময়টা দেখে নিল সে, নাহ ১০টা বাজে আরও এক ঘন্টা বাকী।
“শোন ঝামেলা হয়ে গেছে, আমাদের বাসায় গেস্ট আসছে, আজকে বিকালে দেখা করি, আম্মু কিছুতেই বের হতে দিবে না এখন!” খুব আহ্লাদ করে বলল মিতু।
“ঠিক আছে, কিন্তু আমার তো সময় থেমে গেছে। ঘড়ি একদমই চলছে না, ৩ ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠেছি, প্রতিটা সেকেন্ড মনে হচ্ছিল একেকটা মহাকাল। বিকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারব কিনা জানি না!” মন খারাপ করে বলল রফিক।
“তোমার এই অস্থিরতাটা আমার খারাপ লাগছে না, মনে হচ্ছে তুমি এখনও আমাকে ভালোবাস।”
“তুমি কিন্তু নীল জামা পরে আসবা, নীল জামায় তোমাকে একদম পরীর মত লাগে!” আদর আদর করে বলে রফিক।
“আচ্ছা, ঠিক আছে! এই রাখছি, আম্মু ডাকে।”
বলেই ফোন রেখে দিল মিতু।
হতাশ হয়ে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রফিক।
এমন সময় আবার ফোন এল, অচেনা নাম্বার। রফিক ফোন ধরল।
আশেপাশে কান্নার আওয়াজ, তারই মধ্যে একজন খুব স্পষ্ট করে বলল, “রফিক, তোর বাবা মারা গেছে, তুই দ্রুত চলে আয়, আসরের পর দাফন করা লাগবে”।
রফিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন রেখে দিল।
দুই একটা কাপড় ব্যাগে ঢুকিয়ে রওনা হল সে। বাসে উঠে মিতুকে ম্যাসেজ দিল, “আজ দেখা হবে না, আমার বাবা মারা গেছেন”। ম্যাসেজ দিয়েই ফোন বন্ধ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল সে।
২।
রফিকের মা সিরাজাম মুনিরা মারা যান রফিকের মাত্র ৫ বছর বয়সে। তারপর থেকেই বাবার কাছে মানুষ। বাড়িতে বাবা, চাচারা একসাথে থাকেন। কলেজ লাইফ থেকে পড়াশোনা করতে বাড়ির বাইরে, তাই বাড়ির সাথে কেমন একটা দূরত্ব চলে এসেছিল। বাবা যে একজন আছেন এই বোধটুকু যেন ম্লান হয়ে গিয়েছিল। আজ এতটা বছর পরে বাবার সেই মুখটা বারবার মনের মধ্যে নাড়া দিচ্ছে। কে জানে হয়ত আমরা যা পাই তা গুরুত্ব দেই না, যা পাই না তা নিয়ে করি আকাঙ্ক্ষা আর যা হারাই তা নিয়ে করি আফসোস।
রফিক ভেবেছিল বাবাকে নিয়ে সবাই অনেক কান্নাকাটি করছে, কিন্তু গিয়ে দেখল সবকিছু মন খারাপ করা রকমের স্বাভাবিক। চাচাদের দায়িত্ব বলতে দাফন কাফন আর কুরআন খতমের ব্যবস্থা করা। রফিকের কেন যেন কান্না পাচ্ছে না, তবে বাবার মুখটার দিকে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। একটু পর থেকে এই মুখটাকে আর দেখা যাবে না, চাইলেও না। চাইলেও কোন কিছু না পাওয়ার মত কষ্ট বোধহয় আর কিছুতে নেই।
সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে গেল। বাবা আর নেই, বাবার ঘরটা খালি, একদম খালি। মৃত মানুষের রেখে যাওয়া ঘরটা কেন যেন খুব কথা বলতে থাকে। রফিকের সাথেও মৃত বাবার ঘরটা কথা বলতে থাকে। রফিকের কাছে মনে হয় সে কোন স্বপ্নে আছে, কঠিন স্বপ্ন, বড় বেশি দুঃস্বপ্ন।
দেখতে দেখতে দুইদিন চলে গেল। দুপুর বেলা, রফিক ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবার খাটে। মৃত মানুষের খাটে শুতে সবাই কেমন ভয় পায়, রফিক ঐ খাটেই ঘুমায়, আত্মীয়স্বজনদের নিষেধ সত্ত্বেও। ঘুম যখন ভাঙল তখন প্রায় সন্ধ্যা। ঘুম থেকে উঠতেই বাবার ছবি দেখতে ইচ্ছে হল রফিকের। বাবার খুব বেশি ছবি নেই তার কাছে, একসময় একটা অ্যালবাম ছিল, সেটা খুঁজতে বাবার আলমারি খুলল রফিক। বাবার কিছু কাপড় চোপড় ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না, ভেতরের ড্রয়ার খুলতে একটা ডায়েরি পেল সে। রুমে আলো জ্বেলে ডায়েরিটা খুলল রফিক, খুলতেই মায়ের ছবিটা উল্টো হয়ে নিচে পড়ে গেল। ছবির উল্টো পাশে লিখা প্রাণপ্রিয় মুনিয়া পাখি, রফিকের আব্বু ওর আম্মুকে আদর করে মুনিয়া পাখি বলে ডাকত। কিছুই মনে নেই রফিকের, এই মানুষটার ভেতরে সে একসময় ছিল, কী অদ্ভুত সবকিছু! ছবিটা নিয়ে যাবে রফিক, ছবিটা খাটে রেখে ডায়েরির পাতা উল্টানো শুরু করল সে। বাজারের হিসাব নিকাশ আছে অনেক, মাঝে মাঝে কবিতার দুইএকটা লাইন, বাবা কবিতাও লিখতেন নাকি, হঠাত তার মনে হল বাবা মানুষটা সম্পর্কে বলতে গেলে সে কিছুই জানত না।
আরও কিছু পাতা উল্টানোর পর হিজিবিজি করে বাবার হাতে লিখা...
১১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২
মাথাটা কেমন ওলট পালট লাগিতেছে। পরম করুণাময় কেন আমারে নিয়া যান নাহ। সবকিছুতে অসহ্য যন্ত্রণা, আর বাঁচিবার ইচ্ছা নাই আমার। কেন যে মুনিয়ার পেটে এখনই সন্তান আসিতে গেল। পাকিস্তানী দালাল কুতুব মিয়া আমার বউটারে নিয়া গেল, আমি কিছুই করিতে পারিলাম নাহ। মুনিয়া বলিতেছে সে পাকিস্তানী জানোয়ারটার পেটে ছুরি মারিয়া পালাইয়া আসিয়াছে, তারপরও কেন যে এমন লাগিতেছে। মুনিয়ার উপর এমনিতেই অনেক ঝড় গিয়াছে, ওরে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতে পারিতেছি নাহ। এই সন্তানটা কি আসলেই আমার নাকি ঐ পাকিস্তানী কুত্তার বাচ্চাটার??? নাকি ঐ দালালের বাচ্চাটার??? হে রাব্বুল আলামীন, আমার মৃত্যু দাও তুমি, আর কিছু তোমার কাছে চাহিবার নাই।
নিজের জন্ম পরিচয় সম্পর্কে জানতে রফিক আরও কিছুক্ষণ ডায়েরির পাতা উল্টালো কিন্তু কিছুই পেল না।
৩।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখছিল মিতু। বাতাসে খুব সুন্দর করে পাতাগুলো নড়ছে। আর মাত্র পাঁচদিন থাকবে সে, অথচ একবারও রফিকের সাথে দেখা হল না তার। বাবা মরে গেছে রফিকের, তাই বলে এতদিন ফোন অফ কেন। রফিকের বেশ কয়েকজন বন্ধুর কাছে খবর নিয়েছে মিতু, কেউ কোন খবর দিতে পারে না। সারাক্ষণ কেমন অস্থির লাগে তার, দিনের মধ্যে কম করে হলেও একশবার সে ফোন করে রফিককে কিন্তু প্রতিবারই ফোন বন্ধ পায়।
মিতুর মনে হল ওর হাতে আসলে করার কিছু নেই, রফিকের গ্রামের বাড়ি কোথায়, ফ্যামিলি কীরকম কিছুই সে জানে না। শুধু জানত বাড়িতে রফিকের শুধু বাবা আছেন, আর কেউ নেই।
কৃষ্ণচূড়া গাছটায় মৌমাছি বাসা বানিয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে আছে মিতু। হঠাত কানে এল তার বাবা খবরে শুনছেন রফিক নামের এক যুবকের গুলিতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী কুতুব মিয়া নিহত। রফিককে অস্ত্রসহ ঘটনাস্থল থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দৌড়ে খবরের কাছে যেতেই সে দেখল খবরে রফিককে দেখা যাচ্ছে। সে বলছে, কুতুব মিয়া রাজাকার, আমার মাকে সে পাকিস্তানী মিলিটারিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, আমি উচিৎ কাজ করেছি। এতটুকুই খবরে প্রচার করছে, তারপর রফিককে পুলিশ আর কোন কথা বলতে দিচ্ছে না।
এইটুকু খবর শুনতেই সমস্ত পৃথিবীটা দুলে উঠল মিতুর, মাথা ঘুরে পড়ে গেল সে।
৪।
মিতু আরও দুইদিন পরে বিছানা থেকে উঠতে পারল। ডাক্তার কড়া ঘুমের ঔষধ দিয়ে রাখে তাকে। মিতুর বাবা খুব অবাক হয়েছে, কেন এমন হল কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
অনেক কষ্ট করে বাসায় ম্যানেজ করে সেদিন মিতু বাইরে বের হল। আগামী পরশু তার প্লেনের টিকিট করা আছে। ফ্লাইট ক্যান্সেল করারও উপায় নেই, বাসায় সে কিছু বলতে পারছে না।
মিতু বুঝতে পারল কারাগারে গিয়ে কোন নাভ হবে না। সে প্রথমে রাজন নামের তার পরিচিত এক অ্যাডভোকেট বন্ধুর কাছে গেল।
“এইটা দোস্ত একটা জাতীয় ইস্যু, আমরা জুনিয়র অ্যাডভোকেট যারা আছি তারা আসলে খুব একটা সুবিধা করতে পারব না।” সবকিছু শুনে করুণ মুখে উত্তর দিল রাজন।
“তাহলে কোন সিনিয়র, ভালো কারও সাথে আমার কথা বলিয়ে দে”, চটপটে জবাব দিল মিতু।
“সেটা করা যায়, বিকালে যেতে হবে তাহলে, এ সময়টায় সবাই অনেক ব্যস্ত থাকে”।
“কিন্তু তুই এখনই আমাকে রফিকের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দে, আমি আসল ঘটনাটা জানতে চাই”।
“সেটা সম্ভব না, রফিককে দশ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, এখন দেখা করতে দিবে না”।
খুব হতাশ হল মিতু, পরশু ফ্লাইট, আর রাজন কিনা বলছে দশ দিন শেষ হওয়ার আগে দেখা হওয়া সম্ভব না।
আর কোন কথা বলল না মিতু, চুপ করে বের হয়ে আসল সে। আকাশটা একদম পরিষ্কার, তারই মাঝে টলমলে পায়ে হাঁটতে লাগল সে। এক বছর ধরে কত অপেক্ষা করেছে সে! শুধু এই পনের দিনের আশায় আশায় একটা বছর পার করতে পেরেছে। এখন সব স্বপ্ন কেমন দুরমুর করে ভেঙ্গে পড়ছে, কেমন যেন মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটায় সবকিছু হাহা করে খালি হয়ে যাচ্ছে। এক বছরের সমস্ত স্বপ্ন যেন কিছুক্ষণের ঝড়ে উড়ে বহু দূরে চলে যাচ্ছে।
বিকালে রাজনের পরিচিত অ্যাডভোকেটের সাথে কথা বলে জানা গেল উনি কেসটা নিতে রাজী আছেন, কিন্তু খরচ হবে অনেক। মিতু খরচ নিয়ে ভাবল না, ওর বেশ কিছু জমানো টাকা আছে।
৫।
মিতুর কিছুই করার ছিল না, যেতে হবেই। বাসায় সে কিছুই বলতে পারছে না, তার উপর আবার ছুটি শেষ করে ভার্সিটিতে রিপোর্টিং এর কিছু ব্যাপার আছে। মিতু ঠিক করল সে পরশুর ফ্লাইটেই চলে যাবে, তারপর এক মাস বা দুই মাস থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে আসবে। এদিকটার ব্যাপারে রাজন তো আছেই।
মিতু চলে গেল, এদিকে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে বিচার শুরু হল রফিকের। দিন যায়, কিন্তু নানা ঝামেলার জন্য দেশে ফিরতে পারছে না মিতু। আর এদিক দিয়ে রফিককে গণতন্ত্রের বিপক্ষের শক্তি বানিয়ে দেওয়া হল। রাজনের পরিচিত অ্যাডভোকেট কিছুদূর এগিয়েই বুঝতে পারল যে কিছু করা সম্ভব হবে না। রাজন এ ব্যাপারগুলোর পুরোটাই মিতু থেকে গোপন রাখল। মিতুকে বললে সে শুধু শুধু চিন্তা করবে আর তার উপর আস্থা হারাবে।
দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে অতি দ্রুত বিচার হয়ে গেল। গণতন্ত্রের বিপক্ষের শক্তির কোন স্থান নেই বাংলার মাটিতে। মিতুর ক্ষতি করা হবে এ ভয় দেখানোতে রফিক ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিতে বাধ্য হল। রাজন এ জবানবন্দীর কথা মিতুকে জানাল। রাজন বলল রফিক ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়ে দিয়েছে, এখন তাদের কিছু করার নেই। তাও মিতু চাইল রফিকের সাথে একবার শেষ দেখা করবে। সে দেশে ফিরবে বলে ঠিক করল।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চাপ আসা শুরু করল রফিক ইস্যুতে। সরকার থেকে নির্দেশ এল রফিককে খুব দ্রুত ফাঁসি দিতে। বিচারক রায় দিয়ে দিলেন। ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রফিকের ফাঁসির দিন ধার্য হল। কাকতালীয় ব্যাপার ঘটল, ঐ তারিখেই রফিক আর মিতুর প্রথম দেখা হয়েছিল।
রফিক আর মিতুর শেষ দেখা হয়েছিল। রফিকের গায়ে ছিল একদম সাদা একটা ড্রেস, মিতু পরেছিল আকাশের মত নীল একটা জামা। একজনের চোখে ছিল পানি, আরেকজনের মুখ হাসি হাসি। দিনটা ছিল ২৫ ফেব্রুয়ারি,২০০৫।