somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রফেসর হামিদুর রহমান ছাহেব (দা.বা.) ধারাবাহীক জীবন -পর্ব ২

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রফেসর মুহাহাম্মদ হামীদুরুর রহমান সাহেব : ধারাবাহীক জীবন


কৈশোর
======
নিমতলীতে আমরা প্রথম যে বাড়িটায় থাকতাম, সেটা ছিল একটি টিনের বাড়ি। কেরাসিন তেলের টিন কেটে বাড়ির চারিদিকের বেড়া বানানো হয়েছিল। মাসে ষোল টাকা ভাড়া। এ বাসায় এক বছর থাকার
পর এখন যে বিল্ডিং এ আমাদের মাদ্রাসা সে বিল্ডিং এ গেলাম। তখন এটা ছিল এক তলা বিল্ডিং। আর এর মালিক ছিল হাজী আবুল খায়ের।
তার ছেলে হাজী আবুল হাসানাত এর বাসায় আমরা এখন প্রায়ই
প্রোগ্রাম করি। আমাদের এই নতুন বাসাটায় দুটো রুম ছিল।
একটা রুম এত ছোট ছিল যে, ঘরে একটা ডবল চৌকি রাখার পর ঘরে ঢোকার জন্য আর কোন জায়গা থাকত না।

চৌকির উপর দিয়ে ঘরে ঢুকতে হত। এক পাশে চৌকি রাখার পর আর এক পাশে সামন্য একটু ফাঁক। সেখানে একটা টেবিল আর একটা চেয়ার ছিল। ঘরে ঢুকে চৌকির উপর দিয়ে যেয়ে চেয়ারে পড়া-লেখার জন্য বসতাম। আমি আর আমার এক চাচা এক ঘরে থাকতাম। আর এক ঘরে আমার আব্বা-আম্মা শহীদ আর মাশহুদকে নিয়ে থাকতেন।

তখন শহীদ আর মাশহুদ তো নাবালক। আব্বা মারা যাবার সময় একজনের বয়স ন’বছর আর একজনের বয়স সাত বছর। ঐ দুজনের আব্বার কথা মনেও নাই। তাদের স্মৃতিতে আব্বা নাই।
আর আমার স্মৃতিতে আব্বা সবচেয়ে ভাস্মর। কারণ তখন আমার ছিল বয়স ষোল। এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল তখন ছিল ঢাকা হল। ঢাকা হলের উত্তরধারে মাঠ। ঐ মাঠে মুকুল ফৌজের প্যারেড করতাম। ঐখানে পটুয়া কামরুল ইসলাম আমাদেরকে মুকুল ফৌজের
ট্রেনিং দিতেন।

আমাকে খুব স্নেহ করতেন। মাঠটা ছিল ছোট। আর মসজিদের পূর্ব দিকে মাঠ। এখনো আছে মাঠটা। এখনকার শহীদুল্লাহ হলের পাশে। ঢাকা হলের কমন রুমে কখনো কেরাম খেলতাম,
কখনো খবরের কাগজ পড়তাম। হলের ছাত্ররা আবার বাচ্চা ছেলেদের আদর করত। কাজেই আমাদের হলে গমানাগমনে কোন বাধা-নিষেধ ছিল না। আমি মুকুল ফৌজের প্যারেডের সময়ে প্যারেড করতাম।
আবার নামাজের সময় হলে মাঠের পাশে দোতলা মসজিদে নামায পড়তে যেতাম।

মসজিদটা এখনো আছে। শহীদুল্লাহর মাজারের পাশে দোতলা মসজিদটা
শাহী আমলের মসজিদ। মসজিদের একতলায় কিছুই নাই।
দোতলায় মসজিদ। তখনও তো কচি-কাচার আসর হয়নি।
এখানে আমাদের ভ্রতচারী নৃত্যও শিখাত কামরুল হাসান। পটুয়া তখনো হয়নি। প্যারেড করা, ভ্রতচারী নৃত্য করা, সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান করা – এসবই করতাম। ব্যারিষ্টার মওদুদুর রহমান সাহেবর সঙ্গে ড্রামা করতাম। তিনি আমাদের ফুটবলের লিডার, ক্রীকেটের লিডার, ড্রামারও লিডার। আব্বা এগুলো কিছু জানতেন না।
ছোট রাস্তাতার মধ্যে রাস্তা বন্ধ করে ড্রামা করতাম।

মাঠের পাশে দোতলা বিল্ডিং। সেখানে ছিলেন মাহতাব। এখনো আছে। মুহাম্মদপুরে। তার ওখানে যেতাম খুব। আমি যখন ক্লাশ নাইন-টেনে পড়তাম। ঐখানে একদিন পেলাম কুরআন শরীফের তরজমা।
আলী হাসান সাহেবের তরজমা কলিকাতা থেকে প্রকাশিত। সুরা ইয়াসিনের বিখ্যাত আয়াত ’ওয়ামা লিয়া
লা আ’বুদুল্লাযি ফাত্বারনি ওয়া ইলাইহি তুরযাউন’ এর তফসির পড়ার পর খুব ভাল লাগল। তারপর থেকে বাসায় আর সকালে কুরআন শরীফ জোড়ে পড়ি না। আব্বা জিজ্ঞেস করলেন, সকাল বেলা তুমি তেলওয়াৎ কর না? আমি বললাম, আব্বা আমি তাফসীর পড়ি।
না বুঝে কুরআন পড়ে লাভ কি?’ আব্বা কিছু বললেন না। বাসায় আব্বা একটু ফ্রি থাকলেই আব্বা ডাক দিতেন, হামীম, হামীদ..। আমি জবাব দিতাম, জি আব্বা। আস, পড়। মাদ্রাসায় আরবী ছিল। সিগা পড়তাম। নাসারা, নাসারা, নাসার ..। পরে
মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেবের সহবতে সে শিখা পাক্কা হয়।

১৯৫২ সালে একবার আব্বা আমাকে বললেন, ‘তোমাকে ভৈরবে নিয়ে যাব। একলা একলা থাকতে পারবে?’ আমি বললাম যে, পারব। তিনি আমাকে সঙ্গে করে ভৈরব নিয়ে গেলেন। আমাকে পৌছে দিয়েই চলে এসেছিলেন। সেখানে কাঁচাবাজারে আমার এক দুসস্পর্কীয় আত্মীয়ের মুদি দোকানে
থাকতাম। ভৈরবে তখন নিখিল পূর্ব পাকিস্থান কিরআত প্রতিযোগিতা হবে।

আমারতো সম্বল হল উস্তাদযি আমাকে ছোটবেলায় যেসব জায়গাগুলো মশক করিয়ে দিয়েছেন সেগুলো। ওয়া ইয ইয়াফাউ কওয়াইদ..ওয়াযকুরনি আযকুরকুম.. এ ধরণের কুরআন শরীফের কিছু আয়াত। আর আমি যখনই এ আয়াতগুলো তেলওয়াৎ করতাম, আমি ফাষ্ট হতাম।
কারণ উস্তাদযিরআমাকে যেসব জায়গা পড়িয়ে দিয়েছেন, সেখানে আমার অজ্ঞাতে ওয়াজিব গুন্নাহ, ইখফা, ইদগাম, মদ সব আদায় হয়ে যেত।

১৯৪৯ আমি যখন ইসলামিয়া হাই স্কুলের ছাত্র, তখন স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন আব্দুল বারী এবং প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুফতী দ্বীন মুহাম্মদ খান (রহঃ) সাহেব, বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম। আমি তার কোন মাহফিলে বসি নাই। তার মাহফিল হবার সময় অনেক দুর পর্যন্ত মাইক লাগানো থাকত।
হয়তো চকের মসজিদে বয়ান করছেন, আর মাইক চকবাজার দিয়ে মোগলটুলি, চানখারপুলের রাস্তায় রাস্তায় লাগানো থাকত।

তাদের দুরদর্শিতা কত বেশী ছিল! আমার হেড মাষ্টার সাহেব বলতেন,
তুই যে কুরআন শরীফ পড়তি, দ্বীন মুহাম্মদ সাহেব বলেছেন,
‘এই চিজ তুমি কই পাইলা?’

কিন্তু ‘ যখনই উস্তাদযির মশক করা ছাড়া অন্য জায়গা থেকে পড়তাম, তখন ফাষ্টর্ হতাম না। হয়তো সেকেন্ড, থার্ড হতাম।
আমার পজিশন নীচে চলে যেত। এটা তো ১৯৫৫ সালে মেট্রিক পাশ করে স্কুল থেকে চলে এলাম।

১৯৭৬ সালে রিযওয়ানকে হিফযখানায় দিলাম। আযিমপুরের পশ্চিমদিকে আব্দুল্লাহ হুযরের মাদ্রাসা। হাফেয জাহিদের কাছে পড়ত। তার সঙ্গে আর একজন হাফেজ ছিলেন। নাম হাফেজ ইসমাঈল সাহেব। পড়াতেন খুব সুন্দর। বা চাদের আদরও করতেন। আবার পিটাতেনও খুব বেশী।
জাহিদতো আলেম ছিল। ও আবার আলেম ছিল না। সে আমাকে পান খাওয়ায়। এটা খাওয়ায়, সেটা খাওয়ায়।

রিযওয়ান মাদ্রাসায় ভতির্ হয়েছে। আমি তার সঙ্গে মাদ্রাসার দোতলায় একটা ছোট কামড়ায় ঘর ভাড়া করে রাত্রে থাকতাম। একবার আমাকে বলে যে, একটা কুরআন শরীফ শোনান না? আমার পড়া শুনে বলে যে,
মাখরায তো ভালই আদায় হয়। গুন্নাহ-মদের তো খবর-টবর নেই।
এই প্রথম তার কথায় ধাক্কা খাইলাম।

আল্লাহর মেহেরবানী, এর কয়েকদিন পরেই রমযানে আমি হাফেজ্জী হুযুরের সঙ্গে এতেকাফ করতে গেলাম। কামরাঙ্গিচরে। আর ঐ প্রথম নুরানী ট্রেনিং নিলাম। এতদিনে বুঝলাম, ইখফা, ইদগাম, ইক্বলাব আর ইখফার হরফ কাকে বলে। কিন্তু ‘ আমি যখন ভৈরবে নিখিল পূর্ব পাকিস্থান কিরআত
প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছি, তখনতো আমার জানা নাই কোথায় ইদগাম, ইখফার গুনড়বাহ করতে হবে। দরকার কি? উস্তাদযির মুখস্ত করিয়ে দিয়েছে, সেগুলো তেলওয়াৎ করি। ফাষ্ট হয়ে যাই। আর মশকের
বাইরে পড়লে ফেল। ঐ কম্পিটিশনে উস্তাদযির মখস্ত করিয়ে দেয়া জায়গা তেলওয়াৎ করলাম। আমি ফাষ্ট হয়ে গেলাম। এটা হল ক্লাশ এইটের ঘটনা।

১৯৪৭ সাল। পাকিস্তান হল। পাকিস্তান হবার আগের না পরের ঘটনা মনে নাই। আমি তখন আব্দুল গণী হাই স্কুলে পড়ি। চাঁদপুরে।
হাজী শরিয়ত উল্লাহর বিখ্যাত আল্লাহওয়ালা, মুজাহিদ বাংলাদেশে।
হিন্দু জমিদারদের বিরদ্ধে অত্যাচারিত মুসলমানদের পক্ষে আন্দোলন করেছেন। একদিকে তাদেরকে অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার এবং আবার পরিপুর্ণভাবে শরিয়তের উপরে চলার জন্য দাওয়াত – এই
দুই কাজ একসঙ্গে করতেন।

পীর শরিয়ত উল্লাহ মারা গেলেন ফরিদপুরে। তার ছেলে মহসিন আলী । মহসিন আলী সাহেবের ছেলে বাদশা মিয়া এবং তার ছেলে আবার মহসিন আলী দুদু মিয়া। শেষের দু’ জনকে আমরা পেয়েছি। হাফেজ্জী হুযুরের কাছে আসতেন। মহসিন আলী দুদু মিয়া মাওলানা আবরারুল হক সাহেবের কাছে মুরীদ হয়েছেন। পীর মুহসীন আলীর এখনো বিরাট প্রভাব। আমার
আব্বা বললেন, ‘পীর বাদশা মিয়া হুযুর আসবেন। আব্দুল গণী হাই স্কুলের মাঠে বিরাট জলসা হবে। তুমি তার সামনে কুরআন পড়তে পারবে?
’ আমি বললাম, পারব। এই প্রথম ওপেন কিরআত পড়া।
মাইকে। এই দুই জায়গার কথা খুব ভাল মনে আছে। এক, চাঁদপুরে, হাজী শরীয়ত উল্লাহ সাহেবের সামনে। আর একবার ক্লাশ এইটে থাকাকালীন ভৈরবের নিখিল পূর্ব পাকিস্তান কিরআত প্রতিযোগিতায়।

আব্বা আমাকে অকল্পনীয় স্নেহ করতেন। আমরা যখন ঢাকায় নিমতলীতে থাকতাম, বাসার সামনের রাস্তায় একটা ঘটনা হল। তখন আমি সিক্সে পড়ি। এখন যেখানে নিমতলীর মসজিদ, ঠিক তার পাশে দিকে একটা বাড়ি ছিল। সেটা এখন ভেঙ্গে ফেলেছে। এ বাড়িতে থাকতেন এক আরব। তিনি বাংলাদেশ রেডিওতে কিরআত পড়তেন। তার কিরআত খুব সুন্দর ছিল। তিনি যেহেতু অবাঙ্গালী ছিলেন, মহল্লার ছেলেরা তাকে বিভিন্ন ভাবে খুব
কষ্ট দিত। হাজী আবুল কালাম সাহেবের ছোট ছেলে আবুল হোসাইন
আমার সহপাঠী। তার বড় ছেলে আবুল হাসান আমার দুই বছরের বড়।

অনেক সময় তিনি আমার সঙ্গে ক্রীকেট খেলতেন। তার বাসায়, মসজিদে প্রায়ই আমি থাকতাম। আবুল হোসাইন খুব দুষ্ট ছিল।
মেট্রিক পাস করেনি। সে আমাকে বলে যে, হামীদ আয়। আমিতো আর জানি না, সে কি করবে। আমি তার সঙ্গে গেলাম। এখন আমাদের মাদ্রাসা যেখানে,
ঠিক তার উল্টো দিকেই ঐ আরবের বাসা ছিল।
সে আমাকে নিয়ে ঐ আরবের বাসার সামনে গেল। বাসার দরজার শিকলের কড়া খুব জোড়ে কয়েকবার নেড়ে সে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
আমি দাড়িয়ে আছি। দরজা খুলে বের হয়েছে আরব। অনেক লম্বা ফিগার। আমাকে দেখেই বলে, তুমি এমন করেছ কেন?
আমি বললাম যে, আমি করি নাই। সঙ্গে সঙ্গে আমার গালে একটা থাপ্পর মেরে দিল। আমি একদম কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলাম।

আব্বা আমার ঘটনা শুনেই রেগে গেলেন, কেন আমার ছেলেকে মারল! আমাকে তখনই ধরে ঐ আরবের বাসায় নিয়েএলেন। আরবকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন আমার ছেলেকে মারলেন? ‘দুষ্ট, বাসার শিকল নেড়ে পালিয়ে
যায়।’ আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি শিকল নেড়েছ? আমি বললাম, না আব্বা। গুরখা (আবুল হোসেনের ডাক নাম) নেড়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছে ।’ আব্বা তখন ঐ আরবকে সব বুঝিয়ে বললেন।
আরব ক্বারী যে ভুল করে আমাকে থাপ্পর মেরেছেন, এজন্য তিনি আব্বার কাছে মাফ চাইলেন। এখন সেদিনের সেই থাপ্পর খাওয়া আমার জন্য সৌভাগ্যের কারণ হয়ে গেল। তারপর থেকে তিনি আমাকে খুব
আদর করতেন। বাসায় নিয়ে বসাতেন। বিভিন্ন খাবার-দাবার খাওয়াতেন। আমিও এক আলেমের বাসায় যাতায়াতের সুযোগ পেলাম।

এর একটি উল্টো ঘটনাও আছে। আমি তখন ক্লাশ সেভেন বা এইটে পড়ি। এটা আবার আব্বাকে নিয়েই ঘটনা। আব্বা আমাকে যে কি ভালবাসতেন! মাঠে এলাকার ছেলেদের সঙ্গে খেলার সময় এক দুষ্ট ছেলে আর এক ছেলেকে ঢিল মেরেছে। ঢিলটা এসে লাগল আমার পায়ে। আব্বাকে বাসায় যেয়ে যেই
বলেছি, তিনি দৌড়ে বাইরে এলেন। কে মেরেছে ঢিল? এক ছেলেকে কাছে পেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে মেরেছে ঢিল?
সে বলে যে, আমি মারি নাই। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই ছেলের গালে একটা
থাপ্পর মেরে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় হৈচৈ পড়ে গেল, আপনি মৌলভী সাহেব এমন কাজ কিভাবে করলেন?
পরে এটা নিয়ে মাতবরদের সামনে ঘরোয়া বিচার হল। আব্বা সবার সামনে মাফ চাইলেন। আর বললে, ছেলের মহব্বতে তিনি এ কাজ করে ফেলেছেন। এজন্য তিনি দুঃখিত।

আমার আব্বাজান ছোটবেলা থেকেই আমার দ্বীনদারীর ব্যাপারে অকল্পনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। চাদপুরে বাসা ছিল। বাসা থেকে প্রায় একশ ফিট উত্তর দিকে মসজিদ। আমার উপর আব্বাজানের হুকুম ছিল, ‘সুযোগ পেলেই মসজিদে যাবে। মুয়াজ্জিন সাহেবের কাছে থাকবে। ইমাম সাহেবের কাছে থাকবে। মসজিদ ঝাড়ু দিবে। মুয়াজ্জিন সাহেব না থাকলে আযান দিবে।’
এটা ১৯৪৬-৪৭ সালের কথা। আমি ক্লাস থ্রির ছাত্র। তখনই আমি বাসার কাছের মসজিদে প্রায়ই আযান দেই।
এখনতো ওলামায়ে কেরাম বলেন, নাবালকের জন্য আযান দেয়া দুরস্ত নেই। সেজন্য আমি একদিন বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত মুফতী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হুযুর আমিতো ক্লাস থ্রিতে থাকতে মসজিদে আযান দিয়েছি। এখন কি হুকুম?’
তিনি বলেন যে, আপনি তো মসজিদে আসার জন্য মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন।

নিমতলীতে একেবারে মসজিদের একশ গজের মধ্যে আমাদের বাসা। সেখানে আলহামদুলিল্লাহ এখন একটি মাদ্রাসা হয়েছে। সেখানেও একই কথা,
‘ইমাম সাহেবের খানা কেমন দেখ, তাকে বাসায় আন। মসজিদ ঝাড়ু দাও। মুয়াজ্জিন সাহেবের কাছে থাক। ঢাকার খানা তেলে ভরা। ইমাম সাহেবের খানা দিয়ে আস।’ এটা আল্লাহ তা’আলার অসীম মেহেরবানী, আল্লাহ তা’আলা আমার আব্বার উপরে করুণা বষর্ণ করেন, তিনি এগুলো করতেন।
তারপরে ইসলামিয়া স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ঢাকায়। স্কুলে ক্লাস
ফাইভে পড়ার সময় হেড মাষ্টার হিসেবে যাকে পেলাম, আল্লাহু আকবার,
সে আল্লাহ তাআলার আর এক রহমত। হাফপ্যান্ট পড়ে তিনি স্কুলে যেতে দিতেন না। পায়জামা পড়তে হবে। দপুর বেলা নামায পড়তে হবে।
একদিকে আব্বাজান, আর একদিকে হেড মাষ্টার। কাজেই ক্লাস ফাইভে, সেভেনে, এইটে মাথায় টুপি থাকত। সেভেন-এইটে আমার দুজন খুব প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। একজনের নাম আজিজুর রহমান ভুইয়া আর
একজনের নাম শামসুল হক। শামসুল হক সাহেবের বাড়ি নোয়াখালি ফেনিতে, আর আজিজুর রহমান ভুইয়া সাহেবের বাড়ি কিশোরগঞ্জে।

ক্লাসে আমার মাথার মধ্যে সবসময়ই টুপি। শক্ত টুপি। অন্যসময় তারা কিছু বলতেন না। পরীক্ষার সময় একজন ক্লাসে কাছে এসে বলতেন, ‘আহ! এত
গরমের মধ্যে টুপিটা মাথায় দিয়ে থাকিস!’ তখন টুপিটা পকেটে ভরে রাখতাম। একটু পরে বলতেন,‘আমরা টুপি পড়ি না। তুই মন খারাপ করিস না। টুপি পড়া বড় ভাল কাজ।’ তিনি নামায পড়তেন না।
আমার নামায পড়া দেখে বলতেন, ‘আমি নামায পড়ি না। নামায পড়া ভাল কাজ। তুই পড়িস। তুই নামায পড়া ছাড়িস না।’
তারা দুজন আমার স্কুলে পড়া-শোনার ব্যাপারে যা করেছেন, এটা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। কিন্তু আমি যতদিন মেট্রিক পাস না করেছি, ততদিন পর্যন্ত তাদের একজন নামায পড়তেন না। তবে তিনি জুমা' আর নামায পড়তে যেতেন। আলহামদুলিল্লাহ পরবর্তীকালে দুজনের
সঙ্গেই আল্লাহ পাক হজ করিয়েছেন।
হজের মৌসুমে তাদের খেদমত করার তৌফিক দিয়েছেন। দুজনেই
দাড়ি রেখেছেন। খুব মুসুল্লি-মুত্তাকি হয়ে কবরে চলে গিয়েছেন।

আব্বার মৃত্যু
==========
আমার আব্বার সুরা দোখান আর সুরা ইয়াসিন পড়ার কথা আমার খুব মনে পড়ে। জীবনের শেষ দিকে সুরা দোখান খুব পড়তেন। কুরআন শরীফ খুব পড়তেন। ঢাকায় আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় আব্বা প্রথম বাসা ভাড়া নেন নিমতলীতে। ক্লাশ সিক্স, সেভেন, এইটে ছিলাম আর এক বাসায়।

আমার তিন ভাই, শহীদুর রহমান, যেটা আমেরিকায় থাকে, আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট। আর আব্বা মারা যাবার সময় আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। আমি তখন ঢাকা কলেজে পড়ি। ফাষ্ট ইয়ার। ১৯৫৫ এ মেট্রিক পরীক্ষা দিলাম। তখনো মার্চের পরীক্ষা হত। মাস তিন-চারেক পরে ফল বের হল। আগষ্টের দিকে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আব্বা মারা গেলেন।

শহীদ এর বয়স তখন নয় বছর, মাশহুদ এর সাত বছর। তাদের আব্বার কথা কিছু মনে নেই। আমি তখন পুরো ষোল। বহু ঘটনা আছে আমার আব্বাকে নিয়ে। আর একদিন বলব ইনশাআল্লাহ, যদি আল্লাহ হায়াতে রাখেন।
আব্বাতো হঠাৎ মারা গেলেন। কলেরা অসখু হয়েছিল আব্বার। সেই রোগেই মারা গেলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র চল্লিশ। নিমতলীতে যেখানে এখন মাদ্রাসা, সেটা তখন এক তলা ছিল। পরবর্তীকালে হাজী আবুল হাসান সাহেব এর মালিক হলেন তার বাবা মারা যাবার পর। তিনি এক লাখ টাকায় বিক্রী করে দিলেন বর্তমান বাড়িওয়ালার কাছে। হাজী মুজিবুর রহমান বর্তমান বাড়িওয়ালা। তিনি সেটাকে ভেঙ্গে পাঁচ তালা বানিয়েছেন।

আমার জীবনে আমি এমন সব মানুষ আর এত সব নেয়ামত পেয়েছি – এগুলো সবই আমার আব্বাজানের উসিলায়। কুরআন শরীফে আয়াত আছে,
বুযর্গানে দ্বীন এ আয়াতের ব্যাখ্যা করে অনেক কথা বলেছেন।
সুরা কাহফে আল্লাহ তাআলা মুসা (আঃ) এবং খিযির (আঃ) এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেখানে আছে খিযির (আঃ) সারারাত ধরে খোলা মাঠে
একটা ভাঙ্গা দেয়াল মেরামত করলেন।

এর কারণ হিসেবে তিনি পরে মুসা (আঃ) কে বলেছেন,
‘প্রাচীরের ব্যাপার - সেটি ছিল নগরের দুজন এতিম বালকের। এর নীচে ছিল তাদের গুপ্তধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎ কর্মপরায়ণ।
সুতরাং আপনার পালনকর্তা ইচ্ছা করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পন কর এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার কর ।’

এখান থেকে বুয র্গানেদ্বীন বলেন যে, নেক পিতা মারা গেলে তার সন্নতানদেরকে আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে হেফাজত করেন।
আমি আমার জীবনে এ আয়াতের বাস্তব ফল পেয়েছি।
আব্বা মারা গেলেন ১০ই ফেব্রয়ারী। একজন ভদ্রলোক এলেন। তার নাম ছিল আব্দুল মোনায়েম। আসলে হবে আব্দুল মুনিম। তিনি লিখতেন আব্দুল মোনায়েম। বাড়ি ফরিদপুর। দেখতে একটু খাটো ছিলেন। পুরো মাথায় টাক। হাইকোটের্ চাকুরী করতেন। তিনি বাসায় এসে দরজার বাইরেই দাড়িয়ে থাকলেন। ভিতরে ঢুকলেন না। আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
তিনি আমাকে দেখেই বললেন, ‘আমি ভিতরে যাব না। তোমার আব্বা মারা গিয়েছেন। জানি ভিতরে বসার জায়গা নেই। আমি কেবল তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। ইনশাআল্লাহ কিছূ ভয় নাই। তোমার আব্বা বড় নেক লোক ছিলেন। আচ্ছা চলি।’

তিনি কুরআন শরীফের ঐ বিখ্যাত আয়াত, ওয়া কানা আবুহুমা সলিহা (তাদের পিতামাতা নেক ছিলেন) ঐ ভাবে আমাকে সান্তনা দিয়ে চলে গেলেন। তারপরে তাকে আমি আর কখনো দেখিনি।
আমার তো তখন সে আয়াত মুখস্ত ছিলোনা না। আমি বুঝতেও পারিনি। এখন বুঝতে পারি আল্তালাহ তা’আলা কিভাবে আমাকে সহায়তা করেছেন, এমন সব মুরব্বী মিলিয়ে দিয়েছেন! পিতা কি পরিমান সালেহ হলে
আল্লাহ তা’আলা তাদের সন্তানদের হেফাজত করেন!

গুরুত্বপুর্ন মাশওয়ারা
==============
আব্বা মারা গেলেন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্র সাড়ে তিনটায়। ১০ই ফেব্রয়ারী, ১৯৫৬। তারপর আমরা আব্বার লাশ মুন্সিগঞ্জের বাড়িতে
নিয়ে গেলাম। জুমা' আর নামাযের পরে জানাযা হল। তারপর কবর দেয়া হল। আছর নামাযের পরেই আমার নানা আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাইকে ডাকলেন। বিচক্ষণতা কাকে বলে চিন্তা কর?
আমার নানা ইয়াকুব আলী মাতবর। আত্মীয়স্বজন সবাইকে সামনে রেখে
জিজ্ঞেস করলেন, হামীদের জন্য কি করবা?’

তখনতো আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কয়েক মাস হল কেবল ঢাকা কলেজে ভতির্ হয়েছি। তারপর বললেন, ‘সরকারী নিয়ম অনুযায়ী সে তো তার বাপের চাকুরীটা পেতে পারে।’ আমার বাবাতো রেলওয়ের আরআমএস রেলওয়ে মেইল সর্টার) ছিলেন। আসলে আমার নানার টাগের্ট ছিল আমার এক মামা। আমি এখন বুঝি। সে মামা এয়ার ফোসের্ নন-কমিশন র্যাংকে
চাকুরী করতেন। নাম আবুল হোসেন। অনেক পরে সার্জেন্ট হিসেবে রিটায়ার করলেন। টার্গেট তিনি। নানা বলছেন, হামীদ কি এখন পড়ালেখা করবে না বাপের চাকুরী করবে? তার আরো ছোট দুই ভাই আছে। সব এতিম।

এ কথাগুলো বলার আগে ভুমিকা হিসেবে বললেন, হামীদের বাপের জন্য সবচেয়ে বেশী কান্না করার দরকার আমার। কান্না করে কি হবে?’ আমার নানার বড় প্রিয় জামাই ছিলেন আমার আব্বা।
এখন আছরের পরে আত্মীয়-স্বজন সবার সামনে যখন আমাকে নিয়ে আমার নানা কথা বলছেন, তখন এক পর্যায়ে আমার সেই মামা, আবুল হোসেন, বললেন, ‘আমি বুজিরে মাসে তিরিশ টাকা করে দিব।’
বুজি মানে আমার মা। আর এটাই আমার নানার টার্গেট ছিল, আবুল যদি কিছু বলে তাহলে আমার একটা ব্যবস্থা হবে।
এই মায়ের জন্য মাসে তিরিশ টাকার ব্যবস্থা হল। কাজেই এখন হামীদ পড়ালেখা করতে পারবে। আইএসসির একবছরসহ আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাঁচ বছর আমার এই মামা প্রতি মাসে নিয়মিত তিরিশ টাকা করে দিতেন।

আরো বছর খানেক পরে আর একটা ব্যবস্থা হল, আব্বার চাকুরীর সুবাদে এতিমদের জন্য সরকারী ফ্যামিলি পেনশন হিসেবে মাসিক চৌদ্দ টাকা বার আনা পাওয়া শুর হল। এই আম্মার টোটাল ইনকাম হল আটচল্লিশ টাকা পচাত্তর পয়সা।

আমার আম্মা এই টাকা দিয়ে আমার বুয়েট পাস হওয়া পর্যন্ত ছয় বছর চলেছেন। তুমি কি কল্পনা করতে পার? আব্বা মারা যাবার পর আমার মায়ের আর ঢাকা থাকা হল না। সবাই গ্রামে চলে গেলাম। শহীদ-মাসহুদ তো গ্রামেই পড়ালেখা করেছে। আমার ব্যাপারে নানার মাশওয়ারা হবার পরে আমি ঢাকায় চলে এলাম। কলেজে যাওয়া শুরু করলাম।
www.annoor-bd.com
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×