somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি অযাচিত প্রেমপত্র ও আমাদের যাপিত জীবন

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে শুধু, শান্তি পাবে না শান্তি পাবে না শান্তি পাবে না ..."

অন্তর্জালিক ভাবের আদান প্রদান তথা পত্রবিনিময় এই ইলেকট্রনিক যুগে আমাদের প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে জানি, তবু কালি কলমে পত্রলিখনের আনন্দ এখনও অনেকের মনেই একটি অনাবিল দ্যোতনার জন্ম দিতে পারে, আমি নিশ্চিত। আর সেটা যদি হয় একটি প্রেমপত্র, তবে তো কথাই নেই!

ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে আমার এখনও কালি ও কাগজের সহমিলনের প্রতি সীমাহীণ পক্ষপাত। আমার লিখা সে রকমই একটা পত্র (প্রেমপত্র বলাই ভাল) আজ, এতোদিন পরে, কালি ও কাগজের অস্ফুট প্রতিবাদ কে অগ্রাহ্য করে কোন এক অলীক যুক্তিহীণ অভিপ্রায়ে এই ব্লগে মেলে ধরলাম। কে জানে...হয়তো নব্য মৃদুগম্ফু কোন উঠতি প্রেমিক বা প্রেমিকা এর থেকে কোন রসদ হয়তো খুঁজে পেতে পারেন!
পুনশ্চ: বলাই বাহুল্য, এটা আমার লিখা জীবনের প্রথম প্রেম পত্র। চিঠিটির স্থান, কাল, পাত্র সংগত কারণেই গোপন রাখলাম।
....................................................................................................
২৩ জানুয়ারী, রাত ৩ টা
একি হলো বলতো আমার? এখন এখানে রাত তিনটা। তোমার সাথে ঘন্টা চার আগে ফোনে কথা হলো। সকাল আটটায় উঠতে হবে- এই ভেবে তাড়াতাড়ি শুতে গেলাম। অথচ কী এক অর্বাচীন নৈ:শব্দের আলোড়নে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশ ফিরে চোখ মেলেই দেখি তোমার চিঠিটা আমার বালিশের পাশে। কখন যে চিঠিটার নিলাভ অক্ষরগুলোকে আদর করতে করতে, তাদের অস্ফুট না বলা কথাগুলো খুঁজতে খুঁজতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম- জানি না। ঘুমু ঘুমু চোখে এখন তোমার চিঠির অক্ষরগুলো দেখছি...ওরা আমার অস্তিত্বের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে প'ড়ে আমাকে আদর করছে, ঘুম তাড়ানিয়া পাখি হয়ে উড়ছে আমার বুকের অলিন্দে...আর আমি বিস্মিত হয়ে মিলিয়ে নিচ্ছি ওদের আদুরে খুনসুটির সাথে তোমার মুখ! মৃদু আলো ছড়ানো তোমার মুখ! গালে হাত দিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা কবিতার মতো তোমার মুখ...আশ্চর্য সুন্দর তোমার মুখ!

২৪ জানুয়ারী, দুপুর ১:৪৫
এইমাত্র তোমাকে ফোন করে জাগালাম। তুমি আমাকে যেনবা কত যুগ পরে ডাকলে নাম ধরে। খুব লোভী করে দিচ্ছ তুমি আমাকে, জানো তা? আশ্চর্য! এতোটা লোভীর মতো কত দীর্ঘদিন আমি কাউকে চাইনি। কত দীর্ঘদিন আমি দিনরাত্রির মনোব্যাকুলতা নিয়ে কাউকে এভাবে ভাবিনি। তুমি আছ, তুমি আছ, তুমি আছ...এটা ভাবতেই আমার পুরো অর্বাচীন জগতটা হইচই করে জেগে উঠছে। আমার চারপাশের অবিমৃষ্য হঠকারী মানুষগুলোকে আজকাল বেশ সহ্য হচ্ছে। এতোদিন পাতালরেল গুলোকে আমার কুৎসিত প্রাচীন ডাইনোসর মনে হতো। আজ তারাই ঝলমলে লম্বা লেজঅলা ঘুড়ি হয়ে প্রতিদিন আমায় অভিবাদন জানায়। ইউরোপের বিচ্ছিরী ক্লান্তিময় সূর্যহীণ আকাশটাকে ভালো লাগতে শুরু করে। আমাদের বুড়ি ডেস্কক্লার্ক ফ্রাউ মোযারের হতচ্ছারা কুকুরটা কে প্রথম বারের মতো আদর করে দেই। তুমি আছ তুমি আছ তুমি আছ... এই ভাবনা সাহসী করে তুলছে আমাকে ইদানিং, আমাকে সুন্দর করে তুলছে!

এনথ্রোপলজি ডিপার্টমেন্টটা মূল ক্যাম্পাস থেকে অনেকটা দূরে। ভবনটা প্রাচীণ। Baroque age এর অনেক ভাস্কর্যের নমুনা ভবনটার গায়ে ছড়িয়ে আছে। আমি তিনতলায় আমার ডেস্কে বসে তোমাকে লিখছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে প্রথমেই দৃষ্টি আটকে যায় Karl's Kirche (kirche অর্থ গীর্জা)-র কারুকার্যময় সোনালী চূড়ায়। কিছুক্ষণ আগে ঢং ঢং করে চার্চের ঘন্টা বাজলো...for whom the bell tolls? কেন, জানো না? It tolls for thee! ... পড়েছ? হেমিংওয়ের উপন্যাস। গত দুইদিন বরফ পড়েছিল। আজ ঝলমলে রোদ। চার্চের চূড়ায় জমে থাকা বরফকুচি গলে গলে পড়ছে। সামনের কেয়ারি করা বাগানের রডোডেন্ড্রন আর ঝাঁকড়ামাথা গাছগুলো পাতাহীণ ডালপালা ছড়িয়ে ঠায় একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। বরফের কুচি টুপুর টাপুর বৃষ্টির কণা হয়ে ঝরে পড়ছে ডালগুলো থেকে। আমি এই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য দেখে চলেছি আর তোমাকে লিখছি। তোমাকে ভাবছি। আমার স্মৃতিতে তোমার মুখ, আমার অসংলগ্ন চেতনায় তোমার মুখ, আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তোমার কান্তিময় মুখ......এ্যাই আমাকে যেতে হবে এখন। নীল চোখ, সোনালী বাউন্ডুলে চুল আর নোংরা দাঁতের হের্‌ ভেরনার অপেক্ষা করছে আমার জন্য লাইব্রেরীতে...

২৪ জানুয়ারী, সন্ধ্যা ৭:৩৫
আবার আসলাম। আজ শুক্রবার। অফিস থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীণ ঘোরাফেরা, তারপর এসে বসেছি এখানে এই ক্যাফে তে। মোটেই বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না, কারণ ওখানে কিছু কড়িকাঠ আর একদলা শূণ্যতা ছাড়া আর কিছু অপেক্ষা করে নেই আমার জন্য। আমার সাথে আছে অফিসের একগাদা revised research articles/papers। একগাদা primitive thinking & civilized mind, meeting of myth & science, myth & meaning এর চর্বিত জাবর কাটা। যদিও খুব ইন্টারেস্টিং, কিন্তু মাঝে মাঝে এগুলো সমস্তকেই আমার ভীষণ ভারবাহী ব'লে মনে হয়। কী প্রাণান্ত প্রচেষ্টা মানুষের জীবনচারীতার, তার বেড়ে উঠবার ইতিহাসকে একটা ব্যাখ্যায় দাঁড় করাবার! এতো ব্যাখ্যা, এতো জটিলতা আমার আর ভালো লাগে না। ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুঁড়ে দিনাজপুর যেয়ে আমার প্রিয় কাঞ্চন নদীটার পাশে বসে থাকি। তারপর লিখি... "তুমি কি সন্নাসী হইবে না? গৃহত্যাগী? তোমার স্ত্রী পুত্র সন্তান? তোমার এ জীবন? তোমার বেঁচে থাকা? অর্থহীণ! কেন এখনও মরে যাইনি কেন মৃত্যু নয়? আত্মহত্যার স্পৃহা প্রবল থেকে প্রবলতর। পারি না। যন্ত্রণা থেকে নরক, নরক থেকে চোখ পড়লে মৃত্যুবিন্দু, চারধারে হতাহত লক্ষ মানুষ, পচা গন্ধ, শেয়ালের মাংস ছেঁড়া উল্লাস, শকুনের আহ্লাদী শিহরণ। কে যেন আড়ালে বলে, তুই মর তুই মর...মর শালা!"---ধ্যাৎ! কীসব আবল তাবল বলছি! তুমি আমার মন ভালো করে দাও..একবার অন্তত: দাও!

২৬ জানুয়ারী, রাত ৯ টা, রবিবার
জানো, গতরাতে কী যে হলো! নিজের মন খারাপটা কে তোমার উপর চাপিয়ে দিলাম, তারপর নিষ্ঠুরের মত তোমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বললাম। কেন আমাকে কঠিন করে বকা দিলে না তখন? এই ছেলেটা কে একদম প্রশ্রয় দেবে না, তাহলে মাথায় চেপে বসবে তোমার! আজ রবিবার। একটু আগে তোমার সাথে কথা হলো। এখন তুমি চুল কাটতে যাচ্ছো। আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছে। মন ভালোর আরেকটা প্রধাণ কারণ হলো, একটু আগে কথা বলে আমিও তোমার মন ভালো করে দিতে পেরেছি। তুমি ঝর্ণার জলের মতো হেসে উঠেছ। আমরা গভীর পুলকে এই মন ভালোলাগাটুকু ছড়িয়ে দিতে পেরেছি পরষ্পরের মধ্যে, তাই না? হয়তো এজন্যেও তোমাকে আমি আমার জীবনে পেতে চাই। মানুষ মানুষকে এতো শান্তি দিতে পারে!
কোমল আলো ছড়ানো তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে। শেড্‌ দেওয়া চুলে কেমন লাগছে তোমাকে দেখতে? জানি, ছবি তুলে আমাকে পাঠানোর আবদারটা অস্বস্তিকর তোমার জন্য। কিন্তু তবু লোভী স্বার্থপরের মতো তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তোমাকে কাছে পাবার, তোমার দ্যোতনা স্পর্শে নিজেকে প্রাণিত করার জন্য তোমার ছবি বা কন্ঠস্বর-ই যথেস্ট নয় জানি। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওগুলো ছাড়া নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার আর কোন মহৌষধ আমার জানা নেই।

তোমাকে বলার মতো কথা আমার সারা জীবনেও শেষ হবে না। এদিকে চিঠিটা পোস্ট করতে দেরী হলে তোমার বকুনি আমার কপালে আছে জানি। তাই ভাবছি আমার বকবকানি এখানেই শেষ করে কালকেই চিঠিটা পোস্ট করবো। সত্যি কথাটা কি, জানো? তোমার সাথে প্রতিদিনই কথা হচ্ছে, তা না হলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তোমাকে লিখে যাওয়া যেত।

আজ বেশ কয়েকদিন পর আবার তীব্র শীত পড়েছে। আমি প্রার্থনার ঢঙ্গে বিছানায় অল্প ঝুঁকে পরে তোমাকে লিখছি। আমি তোমার ফিরে আসবার অপেক্ষায় অস্থির প্রহর গুনছি। গাড়িতে তোমার ঋজু বসে থাকা, বাতাসে এলোমেলো হওয়া তোমার ঝলমলে চুল, তোমার বাঁকা গ্রীবা, গ্রন্থিল বাহুমূল, তোমার মৃদুআলো মুখ-- সব, সবকিছু চিত্রকল্পের মতো আমার একা বসে থাকা প্রেক্ষাপটকে ভরিয়ে তুলছে। তুমি আসবে...তুমি আসবে-এই ভাবনা আমাকে এই শীতরাত্তিরে জাগিয়ে রেখেছে। আর আমি লক্ষ্মী রাজপুত্রের মতো নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে বসে আছি তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায়। তুমি আমার শেষ বিকেলের আলো, তুমি কি তা জানো?





সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১১ রাত ৩:২৫
১১টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×