আজ থেকে আনুমানিক পনের বছর আগের কোন শুক্রবারের কথা যদি মনে করি তাহলে কোন আনন্দময় বিকেলের কথা মনে পড়ে। কারণ এই দিনটিতে বিকাল থেকে টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা হতো। গ্রামে একটা দুইটার বেশি টেলিভিশন ছিলো না। প্রাইমারিতে যে কয়জনের সাথে ভালো বন্ধুত্ব ছিলো সবাই মিলে দল বেধে সিনেমা দেখতে যেতাম আমাদের হেডস্যারের বাড়িতে। বেশিরভাগ সময় খুব সহজে ভেতরে ঢুকতে দিতো না। টিনের ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কিংবা দরজার নিচ দিয়ে সিনেমা দেখার চেষ্টা করতাম। যখন মুরব্বি কেউ আসতো তখন তার সাথে সুকৌশলে ভেতর ঢুকার একটা চেষ্টা করতাম।
আমার নিজের ছোট কাকার ঘরেও টেলিভিশন ছিলো, কিন্তু আমার অন্য চাচাতো ভাইরা সেখানে কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে ঢুকতে দিতো না। দরজার নিচ দিয়ে দেখতে গেলে সেখানে ঝাড়ু দিয়ে রাখতো! তারপরেও বাংলা সিনেমার প্রতি এক প্রবল আগ্রহ ছিলো। প্রত্যেক শুক্রবারে সিনেমা দেখে বাড়ি আসার পরে আম্মার হাতের মার খেতাম। যেদিন বেশি মারতো সেদিন হয়তো রাতের বেলায় পড়শিদের সাথে আলিফ লায়লা দেখার সুযোগ পেতাম। যাহোক, সব মিলিয়ে ছোট বেলায় এমন কোন শুক্রবার যায়নি যেদিন আলিফ-লায়লা কিংবা সিনেমা দেখার জন্য মায়ের হাতের মার খেতাম না। সে সময়ের বাবা মায়ের ধারনা ছিলো সিনেমা দেখলেই বুঝি সন্তানের চরিত্র এবং মানুষিকতা নষ্ট হয়ে যাবে।
সম্ভবত চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া পর্যন্ত অন্যের বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে গেছি। এরপর হঠাৎ করেই নিজের ভেতরে আত্মসম্মান এসে ভর করেছিলো। নিজের বাড়িতে টেলিভিশন হওয়ার আগে পর্যন্ত খেলা ছাড়া কখনো সিনেমা দেখতে যাইনি। স্কুলে পড়ার সময় প্রায় প্রতি ক্লাসেই ফার্স্ট হতাম। তাই অনেকেই পরে স্নেহের চোখে দেখতো এবং তেমন কিছু বলতো না। বছর পাঁচেক আগে গ্রামে ডিশ এন্টেনার সংযোগ দেওয়া হয়েছে। চ্যানেল এর সংখ্যা বাড়ছে হু-হু করে। সন্ধ্যার পরে যে গ্রামবাসী নাক ডেকে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতো তারা এখন টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরিয়ে সময় পার করে। তবে বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত এটা গ্রামের বিত্তশালীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন গ্রামের বাজারে চায়ের স্টলগুলোতে টেলিভিশন থাকাতে গ্রামবাসীরা প্রায় সবাই রাত দশটা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখার সুযোগ পায়। বাবা, মেয়ে, মা, পুত্র এখন একসাথে বসে ভারতীয় সিরিয়াল কিরণমালা/অন্যান্য দেখে বিনোদন উপভোগ করে।
এ কারণে সন্তান এবং তাদের পিতামাতার মধ্যে একই সাথে একই শ্রেণীর সংস্কৃতির ছায়া পড়ে। যার ফলে সন্তানরা খুব সহজেই কিরণমালা ড্রেস, কিরণমালা কলম, কিরণমালা খাতা, কিরণমালা চকলেট কিনে নিতে পারে। জমিয়ে রাখতে পারে তাদের ছবি। আমার মনে আছে একদিন এক টাকা দামের চাটনির প্যাকেটে চিত্র নায়িকার মৌসুমির ছবি দেখে সেটা বই এর ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আর শেষ পর্যন্ত সেই ছবি আমার মায়ের হাতেই ধরা পড়ে। আহা, কি মাইরটাই না খেয়েছিলাম এই ছবির জন্য। অথচ এখন পুলাপাইন ইন্ডিয়ান বেশ্যাদের (সানি লিয়ন) ছবি দেখলেও বাবা মায়েরা মাইন্ড করে না। কারণ তাদের কাছেও তো এটা স্বাভাবিক বিষয়।
সংস্কৃতির পরিবর্তন হঠাৎ করেই হয় না। দিনে দিনে একটু একটু করেই হয়। যে প্রজন্ম এসব নোংরা সংস্কৃতির ভেতরে বড় হচ্ছে তারা কি কখনো সংস্কৃতির আগ্রাসনের কথা বুঝতে পারবে? যে পোঁকা আমের ভেতর জন্মে যে যেমন কোনদিন বুঝতে পারেনা আম কি জিনিস? ঠিক তেমনি যে প্রজন্ম এই নোংরা সংস্কৃতির ভেতর বড় হচ্ছে সে কখনোই বুঝতে পারবে না নোংরামি কাকে বলে। দুঃখ লাগে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমরা কিছু শেখাতে পারছি না। অথচ এই প্রজন্মকে সঠিক সাংস্কৃতিক ছোঁয়া দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। তা না হলে একদিন যখন এদের দায়ভার আমাদের উপরে পড়বে তখন পস্তাতে হবে। সুতরাং সময় থাকতেই সাবধান।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:০৩