ফেইসবুকে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখলাম বাবা তাঁর নিজের ছেলেকে এমন মার মেরেছেন যে শরীরের কিছু জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। ভিডিওটির কমেন্টে আমাদের মতো হুজুগে বাঙ্গালী সেই বাপকে অমানুষ, জানোয়ার থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার কোনো গালি নেই যে ব্যবহার করছে না। কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বাপের পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়ার কথাও বলছে।
মানুষের সেন্স দেখে আমি অবাক এবং ব্যথিত হয়েছি। একজন বাবা তাঁর সন্তানকে কতোটা ভালোবাসে সেটা কি আমরা জানি না? সন্তানকে যদি বাবার কিছুটা শাসন করতে হয় সেই শাসন করতে বাবার কেমন লাগে সেটা কি বুঝি না আমরা? কিন্তু মায়ের চেয়ে মাসির দরদ যখন বেশি হয় তখন অভিভাবকেরা সন্তানকে শাসন করলে তার চেয়েও বেশি অপদস্থ হতে হয় তাঁদের।
আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আদরই পেয়েছি বেশি, তবে বাবার হাতে যে কয়েকদিন মাইর খেয়েছি সেটা মরার আগে পর্যন্তও ভুলতে পারবো না হয়তো। একবার বাড়িতে আমার মামাতো ভাইয়েরা বেড়াতে এসেছে। তাদের সাথে আমি মারামারি শুরু করলে বাবা বন্যার পানিতে আমাকে যে পরিমাণ চুবাইছে আমার প্রায় মরে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিলো!
তাছাড়া একদিন বাবাকে অশালীন কিছু গালি দিয়েছিলাম। বাবা আমাকে ধরে পরিণত সবুজ পাটগাছ দিয়ে যে পরিমাণ মেরেছিলো, সারা গা ফুলে উঠেছিলো! এগুলো ছাড়াও ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় আমার দুজন মেয়ে সহপাঠীকে খারাপ গালি দেওয়ার কারণে বাবার কাছ থেকে ভয়ঙ্কর শাস্তি পেয়েছিলাম। এরপর থেকে বড় ধরনের অপরাধ করার সাহস করতে পারিনি কোনোদিন।
বাবা আমাকে যেদিন মারতেন সেদিন রাতে আমার জন্য দারুণ কিছু কিনে আনতেন। নিজে অনেক আদর করতেন। কেন মেরেছেন তার কারণ ব্যাখ্যা করতেন এবং ভালো কিছু করার উপদেশ দিতেন। আমি বাকি সময় তা পালন করার চেষ্টা করতাম। আজ এতদিন পরে মনে হয় শাসন যদি বাবা আরও কিছুটা বেশি করতেন তাহলে হয়তো আরও ভালো মানুষ হতে পারতাম।
বাবা-মা তাদের সন্তানকে প্রয়োজন অনুসারে শাসন করবে। শরীর থেকে রক্ত ঝরালেও তাতে কিছু যায় আসে না। দু-একদিন বেদম মার খেলে কেউ মরে যায় না। কিন্তু অতিরিক্ত আদরের কারণে সন্তান যখন বিপথে চলে যায় তখন সেই সন্তানের কারণেই বাবা মাকে একদিন মার খেতে হয়। বাবা তার সন্তানকে যতোই মারুক দিনশেষে সন্তান বাবার কাছেই যাবে। একটা কথা প্রচলিত আছে, কুসন্তান যদিও হয় কুবাবা কখনও নয়।
সন্তান খারাপ হতে পারে। মানুষ খারাপ হতে পারে। কিন্তু একজন বাবা সন্তানের বাবা হিসাবে কখনও খারাপ হতে পারে না। সুতরাং হুজুগের বশে আমরা যেন কখনই কোন বাবাকে গালি না দেই। একই সাথে শিক্ষকেরা যখন তাঁর ছাত্রদের শাসন করে। অতিরিক্ত বেত্রাঘাত করে তার জন্য আমরা যেন শিক্ষকদেরও গালি না দেই। প্রাইমারিতে পড়ার সময় আমার একজন শিক্ষক পড়া না শেখার কারণে এমন মাইর দিয়েছিলেন যে বাকি জীবন আর পড়া না শিখে ক্লাসে যাইনি। আজও সেই শিক্ষককে দেখলে আমি কাঁচুমাচু করে তার কাছে ছুটে যাই।
জীবনে ভালো কিছু করতে হলে, ভালো মানুষ হতে গেলে গুরুজনদের শাসনের প্রয়োজন আছে। সরকার অনেক ক্ষেত্রেই শাসনকে নিরুৎসাহিত করছে তবুও পারিবারিক ভাবে যদি কখনও কেউ অতিরিক্ত কিছু করেও ফেলে তার জন্য আমরা যেন তাদের মাত্রাতিরিক্ত হেয় না করি। কারণ বাবা বা শিক্ষকেরা অতিরিক্ত শাসন করলেও তাদের ভালোবাসা পরিমাপ করার সাধ্য আমাদের নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৫:২৪