জনাব তাহাজ্জুদ পেশাগতভাবে তারা পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী। প্রধান ব্যবসা হচ্ছে মাছের, আড়তে তাদের বেশ কয়েকটা ঘর আছে, তাছাড়া আরও ব্যবসা আছে। মটর শ্রমিক ইউনিয়নের কোন একটা দায়িত্ব আছে তাঁর ভাইয়েরা, ট্রাক আছে। আর্থিক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো। উনি নিজে ছুটাছুটি করে ড্রাইভিং লাইসেন্স করিয়ে দিয়ে ভালো উপার্জন করেন।
পৈত্রিক সম্পত্তি যা পেয়েছে আট ভাই, এক বোন তা বেশ ভালো পরিমাণ, নিজেও করেছেন। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেন তাকে নিজের সম্পত্তির সিংহ ভাগ নিজ ইচ্ছেয় ভালোবেসে দলিল করে তার নামে দিয়ে দেন।
তাহাজ্জুদ সাহেব পদ্মায় মাছের ট্রলার তদারকিতে যান, কিছুদিন থেকে মাছ নিয়ে ফেরেন। কিছুদিনের বিরতি নিয়ে আবার যান প্রমত্ত পদ্মার জেলেদের থেকে মাছ কিনতে।
এভাবে কয়েক মাস যেতে না যেতেই, একবার বাড়ি ফিরে এলে তাঁর প্রাণ প্রিয় বিবিকে আর পেলেন না, তিনি স্বামীর দেয়া উপহারের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে কাউকে না জানিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাহাজ্জুদ সাহেবের প্রাণ যখন নালতে, তখন তিনি পেলেন একটা ঠিকানা। দেরি না করে আর যতটুকু সম্পত্তি ছিলো সেটুকুও তিনি নিজে বিক্রি করে ছুটলেন বহু কাঙ্খিত ঠিকানায়। ঠিকানা মত স্থানে পৌঁছে পেলেন তিনি তাঁর প্রিয়তমা বিবিকে।
যে বাসায় ভাড়া ছিলো তাঁর বিবি, সেই বাসায় তিনি অবস্থান করলে প্রতিবেশীরা আসে মারধর করতে। তিনি প্রমাণ দেন যে, সে তাঁর বিবাহিত বিবি। তখন প্রশ্ন ওঠে তাহলে এতদিন স্বামী সেজে কে ছিলো তার সঙ্গে??
প্রতিবেশীরা তাহাজ্জুদ সাহেব কে একান্তে জানায় অন্য আরেকজন লোকের ব্যাপারে। তিনি এই সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটা উপায় বের করেন আর সত্য জেনে নেন। তখন তিনি কষ্টে স্থির হয়ে যান এবং সিদ্ধান্ত নেন নিজ এলাকায় একা ফিরবেন। হৃদয় ভরা যে স্বপ্ন নিয়ে, কাঠখোর পুড়িয়ে তিনি বিবিকে খোঁজ করে, এসেছেন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে, শুধুমাত্র তার সাথে সংসার ধরে রাখার আশায়, এমনকি অবশিষ্ট সম্পত্তিটুকুও বেঁচে দিয়ে অর্থ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তাতো আর হওয়ার নয়, তাঁর প্রানপ্রিয় বিবি তাকে ভালোবাসে না।
নিজ বাড়িতে ফিরে আসার কয়েক বছর পরে একজন জীবন সঙ্গীনির অভাব বোধ করেন তিনি এবং কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে একজনকে পছন্দ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন তাঁকে বিয়ে করবেন। ঐ ভদ্রমহিলার বান্ধবীকে তিনি বোন ডাকতেন, তাকে বললেন বিয়ের প্রস্তাব দিতে কিন্তু পাত্রী কোনভাবেই রাজি নন। তাঁর আগে বিয়ে হয়েছিলো, সে সংসারে কষ্ট ছিলো, এখনও কষ্ট করছেন, তাছাড়া আরও ব্যাপার আছে, তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ে করবেন না। তাহাজ্জুদ সাহেব ও নাছোড়বান্দা, তাঁর ঐ বোনকে দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেই চলেছেন।
অবশেষে রাজি হলো পাত্রী। বিয়ে হলো, শুরু হলো নতুন সংসার। দু'জনের চমৎকার জুটি, মাশাআল্লাহ। সুখী দাম্পত্য জীবন তাদের। সুন্দর মত কাজ করেন তাহাজ্জুদ, কোন অভাব অনটন নাই তাদের সংসারে, সম্মানের সঙ্গে ভালোবাসেন তাঁর সালেহ(ভালোবেসে দেয়া নাম)কে। সালেহা তখন আর বাইরে শাড়ী, কাপড় এর ব্যবসা করতে যায় না। সরল ভালোবাসা, সুখ, শান্তি ছাড়া তাদের বাড়তি কোন চাহিদাও নাই।
কিছুকাল পরে তাহাজ্জুদ সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর ভালোবাসার সালেহ(সালেহা) অন্যের বাড়িতে ঠিকা কাজ করা শুরু করে। তখন তো তারা অভাবে পড়ে অথচ এতটুকু বাড়তি চাওয়া নাই। এত স্বল্প পারিশ্রমিকে গৃহপরিচারিকার দিন গেছে সেই কবে! আবার কাজে কামাই-ও দেয়না কখনও, দিলেও কল করে জানিয়ে দেন উপযুক্ত কারণসহ, বেশিরভাগ সময়ই স্বামীর অসুস্থতার বাড়াবাড়ি। বলেন মাস শেষে বেতন নিচ্ছি হালাল করে নিতে হবে তো, নাহলে দায়ী থেকে যাবো তোমাদের কাছে, আল্লাহকে কি জবাব দেবো?
এখন তো সংসার প্রায় সম্পূর্ণ তাঁর একার কাঁধে, তাঁর ছোট দেবর কিছু সহযোগিতা করেন এবং মাত্র দুই বাসায় কাজ করে যা পান তা খুব সামান্য। বর্তমান দরের বাজারে ঐ রোজগারে দু দুটো জীবন টেনে নেয়া কষ্টসাধ্য কাজ, অসম্ভব প্রায়। কিন্তু ওষুধ-পথ্যি আছে, স্বামীর চা এর নেশা আর নিজের জন্যে একটা, সর্বোচ্চ দুটো পান একটু একটু ছিঁড়ে সারাদিনে চালিয়ে নেন।
এই বাড়তি খরচের জন্য ফযরের নামায আদায় করে ভোর বেলা ঘর থেকে বের হয়ে- টোকান প্লাটিক বোতল, লোহা, তারকাটা, জ্বালানির জন্যে খড়ি ইত্যাদি এরকম হরেক রকমের জিনিস। যেগুলো বিক্রি করার যোগ্য, সেগুলো বেঁচে নামমাত্র কিছু উপার্জন করেন। তারপর ঘরে ফিরে সকালের রান্না করে দুজনে খেয়ে নয়টার মধ্যে বের হন ঠিকা বাসার কাজের জন্যে।
মাত্র দু বাসায় দুটো বা তিনটা করে কাজ করতে তাঁর দুপুর হয়ে যায়, কারণ তিনি কাজে ফাঁকি দিতেন পারেন না। সেই বাসা দুটোর একটা বাসা ইচ্ছে করলে তাঁর ন্যায্য বেতন নিজেদের উদারতায় দিতে পারে কিন্তু তা দেয়না, একটু বাড়িয়ে দিতে বললে তাও বাড়ায় না ঠিকমত। কিন্তু এত যত্ন করে অন্য কেউ ন্যায্য বেতনেও কাজ করবে না।
সেই পড়ন্ত বেলায় যেয়ে নিজের ঘরের কাজ, স্বামীর যত্ন-আত্মি, খাবার-দাবার, নিজের পরিচ্ছন্নতা, রাতের রান্না শেষ করে ততক্ষণে সন্ধ্যা। জানেনা কোন সূরা, তেমন কোন দোয়া কিন্তু নামায পড়েন আর কাজের মধ্যে সারাক্ষণ বলেন, 'আল্লাহ রাসূল'। কাজ কর্ম শেষে সন্ধ্যায় স্বামীকে তসবিহ হাতে দিয়ে বলেন- 'আল্লাহ আল্লাহ করো, তাঁকে ডাকো'।
এই অতি বিনয়ী ভদ্রমহিলাকে আমি দাদী সম্বোধন করি এবং তাহাজ্জুদ সাহেবকে দাদা। ওনারা আমাকে 'বু' সম্বধোন করেন।
আমার তো নিজের নানা, নানী পাইনি, দাদী, দাদাকেও সেভাবে পাইনি। গত বৃহস্পতিবার মাগরিব এর সময় দাদা, তাঁর ভালোবাসার সালেহকে রেখে একলা যাত্রা করেছেন(ইন্না লিল্লাহ...)। দাদার পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় কাফন-দাফন এবং মিলাদের পরে দাদী ফিরে এসেছেন তাঁদের দুজনের সেই ভাড়া করা ঘরে।
একলা সেখানে দিনরাত্রি যাপন করছেন। শুয়ে, বসে, সব অবস্থায় কান্নারত হয়ে দোয়া করছেন তাঁর জীবনসঙ্গীর জন্যে। তাঁর শরীরের সমস্ত বল চলে গেছে, তাঁর কিছুদিন সময় চায়, পুনরায় কাজে ফিরে আসার। আমি বলেছি, তুমি আমার কাছে থেকো, দুইবোন একসঙ্গে থাকি। কিন্তু আপাতত দাদী ওখানেই থাকবে।
তাঁদের সার্বিক কল্যাণের জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন!
একটা ব্যাপার কি জানেন! পবিত্র এবং সত্য ভালোবাসা- সুখ, শান্তির উৎস, যা পরস্পরকে স্বতঃস্ফূর্ত রাখে সব সময়, সব পরিস্থিতিতে, আলহামদুলিল্লাহ।