এক
গ্রামের নাম রোহণিয়া। গ্রামীণ পাঠশালার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র আরিফ। বাবা নদীপাড়ের বাজারের একজন মুদী। চাচা অন্যের জমিতে বর্গা খাটে। মা শালীন গৃহিণী। আরিফ তার মায়ের মতই নম্র ও পরিশ্রমী। আরিফের ছোটভাই আসিফ আবার বাপ-চাচাদের মত বদমেজাজি। আরিফের কপাল দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এ ছেলের হাতে সোনা ফলতে পারে। সকলের মতই চার আঙ্গুলে সাদামাটা কপাল, তার কোথাও কিছু লেখা নেই। লেখা নেই যে, আরিফ একদিন অনেক বড় হবে। তবু আরিফের মা স্বপ্ন দেখে। ছেলেকে নিয়ে কত কি যে ভাবে! যখন আরিফ গর্ভে তখনই সে ঠিক করেছিল যে ছেলে হলে উকিল বানাবে আর মেয়ে হলে ডাক্তার। শিশুসন্তানকে নিয়ে বুঝি সকল মায়েরই অমন পাহাড় সমান আশা থাকে। সবাই সুসন্তানের মা হতে চায়। তবু সন্তান যদি বখে যায় তার জন্য মায়ের ভালোবাসায় চুল পরিমাণ হেরফের হয়না। ‘মা’ এক আজব অদ্ভুত মাখলুক!
আরিফের বাবা বলেন, “ইশকুল বাদে দোকান দেখবি, হিসাব-কিতাব ভালমতন শিখ” অর্থাৎ প্রাইমারী পড়া শেষ হলেই ছেলেকে ব্যাবসা শেখাবেন তিনি। আরিফ অবশ্য বাবা এবং মা দুজনকেই খুশি রাখার জন্য মাকে বলে সে অনেকদূর পড়বে। শহরে যাবে, কলেজ পড়বে। বাবার কাছে বলে সে অনেক বড় ব্যাবসায়ী হবে। গাঁয়ের সবচেয়ে বড় দোকানটি হবে তার। গাউস কাকার সাথে টক্কর দিবে। সবাই গাউস বেপারীর নাম ছেড়ে কথায় কথায় আরিফ মোল্লা-আরিফ মোল্লা করবে।
ক্ষণেই আরিফ বলে ওঠে, “আইচ্ছা, আব্বা। মা যে আমারে অনেক পড়তে কয়, বেলিস্টারি পড়তে কয়?”
আনোয়ার মোল্লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “গরীবের অত শিক্কিত অইতে নাইরে বাবা। গরীবের সবহানেই দোষ। বেশি পড়লেও পাপ। সংসার ধর্ম বড় ধর্ম। এতো ট্যাহাও আমাগো নাই।”
পরিস্থিতি থমথমে হয়ে যায়। দুজনেই গভীর চিন্তায় পড়ে যায়। প্রহর গড়ায়, আযান হয়। বাপ-ছেলে নদীতে যায়, নেয়ে আসে। বাড়ি যায়, একসাথে খায় সবাই। ছেলে ঘুমায়, বাবা দোকানে যায়। রাত হয়, কুপি জ্বলে। আরিফ পড়তে বসে, পাঁচের ঘরের নামতা পড়ে আর ভোলে-পড়ে আর ভোলে। সলতা পোড়ে, তেল ফুরায়। রাত বাড়ে, আরিফ ঘুমিয়ে যায়। আনোয়ার ঘরে ফেরে। মাঝে মাঝে মেজাজ খিটখিটে হলে বউকে গালাগাল দেয়, পান হতে চুন খসতেই হাত তোলে। কখনো কখনো আরিফের ঘুম ভেঙ্গে যায়, আরিফ কাঁদে-আরিফের মাও কাঁদে। বিষণ্ণ চেহারায় আনোয়ার বিছানায় গা’লাগায়। সকালে উঠে বউয়ের মন জয়ের চেষ্টা করে, মন ভুলাতে পারলে ভালো আর না পারলে দোকানের পথে হাঁটে আর পথময় নিজেকে গালপাড়ে। আরিফ স্কুলে যায়। পাঠ সাঙ্গ করে বাবার দোকানে যায়, ফের দুপুরে দুজনে একসাথে ফেরে।
আজ আরিফের মন একটু খারাপ। বাসায় ফিরেই মা’কে বলল, “মা আমি বৈকালীগো মত ঢাকায় যামু। আমি বেলিস্টারী পরমু।”
বৈকালী থাকে আরিফদের পাশের গ্রামে। একই পাঠশালায় পড়ে ওরা। আজ বৈকালীর বাবা এসে বৈকালীকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ঢাকায় ওর বাবার ভালো চাকরি হয়েছে। ওরা সবাই ঢাকা চলে যাবে। বৈকালী সেখানেই পড়াশুনা করবে।
আরিফ ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতে জানে। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে ও। স্বপ্নে চাইলেই অনেক কিছু হয়ে যাওয়া যায়। ও স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নে ও অনেক কিছু হয়ে যায়। ব্যাবসায়ী, উকিল, গ্রামের চেয়ারম্যান, ওদের ইস্কুলের হেডমাস্টার...।
দুই
দশ বছর পর। আরিফ ঢাকায় এলো। আরিফের মায়ের স্বপ্ন যে তাকে পূরণ করতেই হবে। আরিফের মা গত হয়েছেন আজ চার বছর প্রায়। গ্রামে আরিফের ছোট ভাই আসিফ ও তার বাবা, মুদীর আয়ে দুজনের বেশ চলে যায়। ঢাকায় জীবনের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে আরিফ। আরিফের পরিশ্রমই আজ আরিফের সোনার হরিণ। আরিফকে নিয়ে আজ আরিফের বাবার অনেক গর্ব, সে মনে মনে ভাবে... ছেলেটা একেবারে ওর মায়ের মত হয়েছে।
দিন যায়, মাস যায়, পঞ্জিকার পাতা উল্টায়... বছর ঘুরে বছর আসে। ছয় বছর পর আরিফ বাড়িতে যায়। ছেলেকে বাবা জড়িয়ে ধরে, আনোয়ার সাহেব যেন হারানো সাত রাজার ধন ফিরে পেয়েছেন! ছেলেকে নিয়েই নদীতে নাইতে গেলেন। আজ কত বছর পর বাপ-ছেলে একসাথে স্নান শেষে দুপুরে খাবেন! ভাবতেই আনোয়ার সাহেবের চোখে জল এসে যায়। “অমন সোনার ছেলে ঘরে ঘরে জন্মায় না। কি পুণ্য করেছিলাম বিধিই জানেন!”— মনে মনে ভাবেন তিনি। স্রষ্টার কাছে আরিফের দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
বিকেলে আরিফ বেরুলো, হাজারবারের দেখা গ্রামটাকে আবার দেখল। সব আগের মতই আছে। তবু আরিফকে ঘিরে থাকে এক হাহাকার, এক শূন্যতা। মাতৃবিয়োগের বেদনা। এ বেদনা সবার কপালে জোটে না আবার সবাই সইতেও পারেনা। অনেক কুসন্তান আছে যারা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। আবার কত সুসন্তান বৃদ্ধ মায়ের বিছানার পাশে গেলে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনা, এই বুঝি মায়ের পরাণ ফুরায়! মায়ের মৃত্যুর কথা চিন্তা করে মাটিতে আছড়ে পড়ে কাঁদে, গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদে। ভেতরটা বিদ্যুতের মত চিলিক দেয়। কত কষ্ট করে এ দেহ গড়ে দিয়ে মা চলে গেলে কবরে, এ বেদনা নীল বিষেও যাবেনা।
সন্ধ্যায় মায়ের কবরের পাশে বসে বসে কাঁদতে থাকে আরিফ। রাত নামে, আরিফ বাড়ি ফেরে না। তাকে খুঁজতে খুঁজতে আসিফ ও তার বাবা গভীর রাতে কবরস্থানে এসে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলেন। আরিফের বাবা বুঝতে পারেন আরিফ এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবে। তার শহরে থাকাই ভালো ছিল। পিতা হিসেবে সন্তান দূরে থাকার কষ্ট তিনি সইতে পারেন কিন্তু সন্তানের অকাল মৃত্যু তিনি সইতে পারবেন না। তাই পরের দিনই আরিফকে একরকম জোর করেই ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন আনোয়ার সাহেব। পুত্রকে ট্রেনে তুলে দিয়ে ব্যাথাতুর মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, এই বুড়ো বয়সে এসে কাঁদলেন। অনেকক্ষণ কাঁদলেন। এ কান্না তৃপ্তির কান্না। ভালোবাসার কান্না।
তিন
পাঁচ বছর পর। আরিফ এখন হাইকোর্টের উকিল। দিনকে দিন তার খ্যাতি বাড়ছে। অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং পারঙ্গম উকিলদের মধ্যে অন্যতম সে। সব মামলা উনি লড়েন না। আগে যাচাই বাছাই করেন, অন্য উকিলদের মত মামলা পেলেই হাতে নিয়ে ফিস চার্জ করেন না। সত্য-মিথ্যা ভেদ করে নেন। অন্যায় সমর্থন করেন না। আর ন্যায় এবং ন্যায্য থেকে কেউ বঞ্চিত হবেন তাও বরদাশত করতে পারেন না। তাই এ যাবত হারের তালিকায় তার নেওয়া কোন মামলা নেই। যদি জজ সাহেব কখনো ভুল করেও কোন ভুল আদেশ দিয়েও বসেন তো জজ সাহেবের ঘুম হারাম করে ছাড়েন আরিফ, ক্লায়েন্ট দরিদ্র হলে কখনো কখনো নিজের পয়সায়ও মামলা লড়ে জজের বারোটা বাজিয়ে দেন। তাই জজ সাহেবরাও আদালতে তাকে দেখলেই নড়েচড়ে বসেন। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে আরিফের মেহনতের অন্ত্য নেই। তবে আরিফের আফসোস শুধু একটা জায়গাতেই, যোগ্য লোক তথা জনবলের অভাবে একেকটি মামলার চূড়ান্ত ফলাফল পেতে যে সময় ব্যয় হয় তাতে মামলাকারির ধৈর্যের বাঁধতো ভাঙ্গেই বরং অপরাধিরাও সময় সুযোগে অনেক অঘটনও ঘটিয়ে ফেলে। বিচার ব্যবস্থার দ্রুততা এখন তার একান্ত কাম্য বিষয়।
আরিফের মত উকিল আদালতের প্রতি বেঞ্চে বেঞ্চে দরকার। তবেই যদি এই সমাজ, এই প্রশাসন কিছুটা হলেও শুধরায়।
আরিফ রাতে বাসায় ফিরেই তার কম্পিউটার চালু করে, ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ে। মাঝে মধ্যে বাবার সাথে ফোনে কথা বলে। প্রথম মাসের আয় থেকে সে দুইটা মোবাইল কেনে। তার বাবা ও ভাইকে পাঠায়। কখনো কখনো নৃশংস সংবাদ পড়ে ছোট ভাইকে ফোন দেয়। দুই ভাইয়ে সমাজ নিয়ে কথা বলে। আসিফ খুব বেশি পড়ালেখা করেনি তবু ভালো-মন্দ ঠিক বোঝে। তবে আসিফের একটাই দুঃখ সে ভাইয়ের মত দুনিয়ার সব খবর রাখতে পারেনা। জগত থেকে বিচ্ছিন্ন। গ্রামে কারো কম্পিউটার নেই। ইন্টারনেট কি জিনিষ, খায় না মাথায় দেয় তাও বলতে পারবে না অধিকাংশ লোকে। আসিফ বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানের দোকানি বলে লোকজন তার সাথে সখ্যতা করে। চেয়ারম্যান এলে ওর দোকানেই বসে। গণ্যমান্যরা এখানেই আড্ডা দেয়। সেই সুবাদে সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু তথ্য সে জানে, এই যা। মাঝে মাঝে চেয়ারম্যান সাহেব পত্রিকা পড়তে পড়তে দোকানে রেখে গেলে সে ঐটা পড়ে। একটা পত্রিকা কয়েকবার পড়ে। তারপর সেটাকে ছিঁড়ে সদাই বিক্রি করে। কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরালেই পাজী টাইপ আর কি!
গ্রামের তুলনায় গভীর রাতে বিছানায় যায় আরিফ। কিন্তু শহরে ১২টা কিংবা ১টা মোটেও গভীর রাত নয়। আরিফ শুয়ে শুয়ে ভাবে, মানুষের জীবন কত বিচিত্র! আবার মরে গেলে হঠাৎ দৃশ্যপট বদল। মুহূর্তেই সকল বৈচিত্র্য বিনাশ... ভাবতে ভাবতেই নাক ডাকতে শুরু করে আরিফ।
চার
তিন বছর পর। ‘জীবন’ নামক উপন্যাসের পাতা উলটেছে, অনেকগুলো অধ্যায় পেরিয়েছে। অনেক কিছু বদলে গেছে। আরিফের বাবা পরলোকগমন করেছেন। অনেকদিন রোগে ভুগেছেন কিন্তু কাউকে কিছু জানাননি, স্ত্রীকে ভীষণ মনে পড়ত। তাই বাঁচতে চান নি হয়তো। তবে আসিফের বিবাহ সম্পন্ন করে গেছেন। আসিফ বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। আরিফ আর আগের মত তেমন একটা পত্রপত্রিকা পড়েন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক চালান। ফেইসবুকে বার্তা-ব্যাস্ত থাকেন। অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলেন হাসিনা নওশীনের সাথে। হাসিনা নওশীন আরিফের মক্কেল। তার একটি মামলা তিনি লড়ছেন। হাসিনা নওশীন একজন ডিভোর্সি। সন্তান তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে থাকবে নাকি তিনি রাখবেন এই বিষয়ক মামলা...।
হাসিনা নওশীনের এক বন্ধু তাকে আরিফের ফেবু আইডি দিয়ে মামলা বিষয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে আরিফ-নওশীন ফেবুর নাম পরিচয়েই পরস্পর পরিচিত হন। আরিফের কেন জানি মনে হয় যে, সে নওশীনকে যুগ যুগ ধরে চেনে। নওশীনের কথা বলার ধরণ তার কাছে অনেক পরিচিত মনে হয়। আরিফ নওশীনের প্রতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে তবে সরাসরি কিছুই বলে না। সামনাসামনি কিংবা ফেইসবুক সবখানেই সরল সাবলীল আচরণ করে সে। ভদ্রলোক বলে কথা।
নওশীনের সাথে রাতভর কথা বলে আরিফ। তার জীবনের অনেক কথাই বলে কিন্তু নওশীন খুব বেশি কিছু বলে না, শুধু সায় দেয়। এতেই আরিফ আগ্রহ পায়। কথা বলেই যায়। নওশীন আরিফকে যতদূর জেনেছে তার দেখা উৎকৃষ্টতম ছেলেদের মধ্যে সে একজন। তবু নওশীন আর নতুন কোন সম্পর্কে জড়াতে চায় না। কিন্তু আরিফকে সে ছাড়তেও চায় না। আরিফদের ছাড়া যায় না। এদের শুধু ভালোবাসা যায়। এরা পৃথিবীতে ক্ষণে ক্ষণে জন্মায় না, কালে ভাদ্রে জন্মায়। কারুর পুণ্যের ফসল হিসেবে স্রস্টা এদেরকে এই পাপময় ধরাকে সরা বানাতে মনুষ্য সমাজে প্রেরন করেন। নওশীন ঠিক করলেন তিনি মামলা নিষ্পত্তির পর বিদেশ চলে যাবেন। আরিফের সাথে দেখা করবেন না আর তবে ফোন, ফেইসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন।
ওদিকে আরিফ কত কি ভাবে! ভাবনার জালে নওশীন আর তার জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। নওশীনের সাথে কথা বলার সময় সে নানাভাবে নওশীনের জীবন-ভাবনা জানার চেষ্টা করে। নওশীন পরিষ্কার করে কিছু বলে না। আরিফ বিরক্ত হয়। মনে মনে ভাবে, নওশীন কি তবে আরিফকে এভয়েড করছে!
আজ সারাদিনে নওশীনের সাথে কথা হয়নি। রাতে ফেবুতে ইনবক্স করেও কোন জবাব মিলল না। জমানো ক্ষোভ নিয়েই আরিফ একটা স্ট্যাটাস লিখলঃ
“সময় রাত ১১ টা ২০। আমি অনলাইনে, ফেইসবুকে। একটা মানুষাকৃতির বুক-মাথার ছায়া, গ্রীন সার্কুলার একটা সাইন। ব্র্যাকেটের মধ্যে ১০৭। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে বন্ধু তালিকার একশত সাতজন আমার মত অনলাইনে আছেন। শত শত মানুষ ঘুমাচ্ছেন। সহস্র জেগে আছেন ব্যস্ততায়। আশেপাশে অসংখ্য মানুষ। আমি এখানে বিমর্ষ রাত জাগি। কত লোকই এমন বিনিদ্র বিমর্ষ প্রহর কাটায়। কালের খাতায় সে হিসেব থাকেনা। না থাকুক। সব হিসেব থাকতে নেই। কিছু বেহিসেবি জীবন ঝরুকনা পৃথিবী থেকে, দোষ কি! মহামূল্য জিনিসের মূল্য যারা দিতে জানেনা তাদের কাছে হিসেবের ফর্দ না থাকা চাই। অমূল্যকিছু অপাত্রে দান করার চেয়ে আপনাতে সীমাবদ্ধ করে রাখাই উত্তম নয়কি? যেই দামি জিনিস তুমি নিয়ে এলে সেই দামি জিনিস তুমি সাথে করেই নিয়ে গেলে, চুরি হলো না-ছিনতাই হলো না-জলেও গেলো না... এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে। হয়তো অব্যবহৃতই রয়ে গেলো তাতে ক্ষতি কি? ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত স্থান-কাল-পাত্র পাওয়া যায়নি তাই ব্যবহার হয়নি। কেউ অবহেলা করেছে, কেউ আবার বোঝেনি কিংবা বুঝতে চায়নি কেউ কেউ, কেউ হয়তো এর চেয়ে অধিক মূল্যবানটা চেয়েছে কিংবা পেয়েছে, কেউ তফাৎ ঠাওর করতে করতেই হারিয়েছে...। তোমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের জন্য হাজার হাজার বছরের আয়োজন চলেছে। একেকটা মুহূর্ত সাজাতে কত প্রবাবিলিটি, কত ইভেন্ট, কত ইকুয়েশন! তাই কি পাচ্ছো আর কি হারাচ্ছো— একটু ভেবে দেখো। একাকী নীরবে একটু ভেবো।
জীবন চলছিলো, চলছে... চলবে আমৃত্যু।”
আরিফের সাথে কথা না বলে থাকতে নওশীনেরও কষ্ট হয়। নওশীন বুঝল পরিস্থিতি মোটেও ভালোর দিকে গড়াচ্ছে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল কয়েকদিন দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসবে। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ইনবক্স ব্যবহার করবে তবু মোবাইলে কানেক্ট করবে না।
যেই ভাবনা সেই কাজ। নওশীন কয়েকদিনের জন্য নিউজিল্যান্ড বেড়াতে গেল। এদিকে আরিফ মামলার ফাইনাল ডেট-এ নওশীনের অনুপস্থিতি, তার সাথে নওশীনের যোগাযোগহীনতা এবং আনুষঙ্গিক আরও কিছু কারণে মামলা হেরে গেলেন। প্রচণ্ডরকম ধাক্কা খেলেন আরিফ। ভীষণ কষ্ট পেলেন। জীবনের প্রথম কোন রমণীর ভুল তাকে ডুবালো।
সব ছেড়েছুড়ে আরিফ নিরুদ্দেশ হলেন।
পাঁচ
নওশীন আরিফকে অনেক খুঁজেছেন। কেন খুঁজেছেন নিজেও জানেন না। মানুষের সাথে মানুষের দুই ধরণের সম্পর্ক হতে পারে, রক্তের আর হৃদয়ের। নওশীনের সাথে আরিফের রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। তাই নিঃসন্দেহে হৃদয়ের টানে তাকে খুঁজেছেন নওশীন। হৃদয়ের এই টানকে অনেকে ভালোবাসা বলে থাকেন। হ্যাঁ, নওশীন সত্যই আরিফের প্রেমে পড়েছেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ইনবক্স চেক করেন, আরিফের কোন বার্তা এলো কিনা! হারানোর বেদনা নিয়ে এভাবে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত নওশীন একদিন পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে।
দীর্ঘ আট বছর পর, দাড়িগোঁফ মুখে আলখেল্লা গায়ে দেশে ফিরলেন আরিফ। অনেক কষ্টে ফেইসবুক আইডি উদ্ধার করলেন। প্রবেশ করতেই ধাক্কা খেলেন, ইনবক্সে ৪০০ মেসেজ! তন্মধ্যে ৩৮৪ নওশীনের আইডি থেকে আসছে!! এতোগুলো বার্তা এই মুহূর্তে পড়া সম্ভব না। মোবাইল অন করলে জানা গেল যে অপারেটর সিম সার্ভিস অফ করে দিয়েছেন। আরিফ দ্রুত নওশীনের টাইমলাইনে গেলেন। তার সর্বশেষ স্ট্যাটাসটি ছয়মাস আগের। তবে স্ট্যাটাসটি পড়ে আরিফ যা বুঝার বুঝে গেছেন। স্ট্যাটাসটি নিচে দেওয়া হলঃ
“আমি সেই কবে ভালবাসতে চেয়েছিলাম তোমায়, তুমি কিছুই বললে না। আমি ফিরে যেতে চাইলাম, তুমি সায় না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলে। এরপর বেলা কত সরে গেল অবহেলায়... আমি এখনো মরুর তপ্ত বালুকায় দাঁড়িয়ে আছি তোমার অপেক্ষায়, ভালবাসতে চেয়েছিলাম সেই কবে! দশ লক্ষ সূর্য অস্ত গেল এই মরুভূমিতে, যান্ত্রিক সময় সরে এলো অতীত থেকে বর্তমানে। বুক জুড়ে কালবোশেখি তুলুক আরও একটা ভবিষ্যৎ, তখনও বলব তোমায় ভালবাসতে চেয়েছিলাম সেই কবে!!”
আরিফ সিদ্ধান্ত নিল সে নওশীনের বাসায় যাবে। আগের ঠিকানায় আছে কিনা জানা নেই তবুও চেষ্টা করতে দোষ কি, যদি পাওয়া যায়? এমন সময় হঠাৎ আরিফ লক্ষ করল যে, নওশীনের আইডি অনলাইন দেখাচ্ছে। আরিফ দেরি করল না। তৎক্ষণাৎ ইনবক্স করে ফেললঃ
“সুপ্রভাত! কেমন আছেন? দীর্ঘ আট বছর পর আপনাকে ইনবক্স করলাম। এই আইডিটা এখনো সক্রিয় আছে দেখে ভালো লাগছে। আমার এ আট বছর ছিল জীবনের মধ্যে আরেক জীবন! কি দুঃসহ সময়ের বিস্ফোরণ সে আপনাকে বোঝাতে আমি অক্ষম। আপানার সাথে আমার তেমন কোন আত্মীয়তা নেই জানি, তবুও কোথায় যেন একটা মহাজাগতিক টান কাজ করেই... নইলে সমগ্র পৃথিবী উপেক্ষা করে দুখের কথা আপনাকে কেন বলতে যাই? আর আপনিইবা কেন সহস্র জীবন রেখে আমার জীবনের পোস্টমর্টেম করতে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান? রহস্যতো কোথাও একটা আছেই! সে রহস্য হয়তো অপার্থিব, ঐশ্বরিক। আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটাকে কি বলা যায়? হয়তো এ সম্পর্কের কোন নাম নেই। পৃথিবীতে এমন কিছু সম্পর্ক থাকে যেগুলোর কোন নাম থাকে না। সেই বেনামী সম্পর্কগুলো কখনো হয় তিক্ত আবার কখনো মধুর। আচ্ছা, আমাদের সম্পর্কটা কেমন— মধুর নয়কি?”
ওপাশ থেকে উত্তর এল, “ভাইয়া আমি বৈকালী আপুর ছোটবোন, মোহসিনা নীলিমা চৈতালি। আপনার কাছে মনে হয় খবর পৌঁছায়নি। আপু...”
আরিফঃ কি বলছ? খুলে বল!
চৈতালিঃ আপু মারা গেছেন অনেকদিন হল। আপুকে আমাদের গ্রামে সমাহিত করা হয়েছে।
আরিফঃ (কান্নার ইমো) বৈকালি কি হাসিনা নওশীনের আরেক নাম? কোথায় কবর দেয়া হয়েছে তাকে?
চৈতালিঃ হুম, আপুর ডাকনাম বৈকালী। তার কবর কাশিমানে।
আরিফঃ কাশিমান? রোহণিয়ার পাশের গ্রাম?
... ... ...
... ... ...
আরিফের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এ-তো তার সেই শৈশবের বৈকালী, ঢাকায় এসে নওশীন হয়েছেন! কিন্তু তার ডাকনাম যে বৈকালী কোনদিন আরিফ জানতেই পারলনা!! তাছাড়া গ্রামের পাঠশালায়ও কোনোদিন শোনেনি যে বৈকালীর ভালো নাম হাসিনা নওশীন...! হায় জীবন!!!
কাছের মানুষ দূরে গেল। আবার কাছে এলো। চলে গেল, ফিরে এলো। অথচ, আপন কিভাবে পর হয়েই বিদায় নিল...।
আজ অনেক বছর পর আরিফ রোহণিয়ায় গেল। ভাইয়ের সাথে দেখা করল। মায়ের কবরের পাশে বসলো। মায়ের জন্য দুয়া করল। বাবার কবর যিয়ারত করল। কাশিমান গেল, বৈকালীর সমাধি খুঁজে বের করল। কিছুক্ষণ কাঁদল। নিজ গ্রামে ফিরে এলো। রাতে ভাইয়ের সাথে দোকানে থাকলো। সকালে শহরে ফিরে এলো। আবার আগের মত জীবন শুরু করল। হৃদয় পাথর হয়েছে তবু জীবনতো আর জমে যায়নি, পাথর হয়নি, থেমে যায়নি। জীবন চলমান। রাতে আরিফ একটি স্ট্যাটাস লিখলঃ
“আমাকে মরতেই হবে, মৃত্যুই মুক্তির একমাত্র পথ।
এবং তা পূর্বনির্ধারিত কিন্তু আমার সময় জানা নেই,
আমরা সময় জানতে পারিনা।
সৃষ্টিকর্তা সব কিছুর নিয়ন্ত্রণকারী, সময় তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন।”
প্রথম প্রকাশঃ সাহিত্যের ছোটকাগজ- শব্দীয় (ত্রৈমাসিক)
লেখকঃ হোসাইন মোহাম্মদ সায়েম
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৬