- নাম নাসিমা বানু। বয়স বিশের কোঠায়। মিয়ানমারের মুসলিম সংখ্যালঘু পরিবারে তার জন্ম। বিবিসি'র সাংবাদিক মার্কডুমেট কুতুপাল অস্থায়ী শিবিরে থাকা ‘নাসিমার’ সাথে কথা বলেন। যেখানে এখন ৩০ হাজারের মত রোহিঙ্গার বসবাস। নাসিমা জানান, বার্মাতে আমার লোকদের নির্যাতন করা হতো, তাই আমরা বাংলাদেশে চলে এসেছি।
আমাদের পরিবারের বিষয়টি ছিল এ রকম যে, আমাদের উপর বর্মী সরকারের চাপ ছিল। আমাদের কিছু সম্পত্তি ছিল।
- একদিন সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে সদ্য ফিরে আসা কোন লোককে আশ্রয় দেয়ার অজুহাতে আমার বাবাকে অভিযুক্ত করলো। যে কোন লোক বার্মায় ফিরে গেলে তাকে জেলে পাঠানো হতো। তাই তাদের দেখাশোনা করা, আশ্রয় দেয়া ছিল বেআইনী। কিন্তু বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।
ওরা আমার বাবাকে একটি সেনা শিবিরে ধরে নিয়ে গেল ও খুব মারধর করল। সাতদিন পর ওরা বাবার রক্ত ভেজা জামা-কাপড় আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিল। ওরা জানাল বাবাকে মেরে ফেলা হবে।
- তাই আমরা আমাদের সব গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগী বাজারে বিক্রি করে দিলাম। বিক্রয়লব্ধ টাকা সেনা শিবিরে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর ওরা বাবাকে ছেড়ে দিল। এর কিছুদিন পর আমার ভাইকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোক আক্রমণ করল। সে মারাত্মকভাবে আহত হল। অনেক কষ্ট ভোগের পর মারা গেল।
আমি শারীরিকভাবে বেড়ে উঠতে শুরু করলে বাবা খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন আমি বার্মায় নিরাপদ নই। কারণ, বর্মী সরকার আমাদের বিয়ে করতে দেয় না। তাই বাবা আমাকে বাংলাদেশে চলে যেতে বললেন।
আমাদের একজন আত্মীয় ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুক। তিনি আমার দেখাশোনা করতে রাজি হলেন।
- ‘আমরা একটা নদী পাড় হবার জন্য নৌকা ভাড়া করলাম। ব্যাপারটি ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। নদীর অপর তীরে বিডিআর আমাদের আটকে দিল। ওরা আমাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য জনপ্রতি একশত টাকা করে ঘুষ চাইল। কিন্তু তখন আমাদের সবার মিলে একশত টাকার মত ছিল। বিডিআর বাহিনীর একজন সদস্য বলল, ‘তাহলে এই মেয়েকে আমাদের কাছে ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার আত্মীয়স্বজনরা আমাকে ছেড়ে যেতে রাজি হল না। ওরা যুক্তি দেখালো, আমাদের সাহায্য ছাড়া মেয়েটি চলতে পারবে না। তারপর ওদের দয়া হল। আমাদের ছেড়ে দিল।
নাসিমা বলল, ‘আগে থেকেই আমার এক বোন বাংলাদেশে ছিল কিন্তু তার ঠিকানা আমার জানা ছিল না। আমরা কক্সবাজার চলে এলাম ও ভিক্ষুকের থালা হাতে শহরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কোন কোন সময় লোকেরা বেঁচে থাকার জন্য দয়া পরবশ হয়ে আমাদের কিছু চাল ও কয়েকটি টাকা দিত। তারপর এমন একজন লোকের সাথে আমার সাক্ষাৎ হল, যে আমার বোনকে চিনত। সে আলীকদমে থাকত। একদিন আমার বোনের স্বামী এসে আমাকে তার কাছে নিয়ে গেল।'
- সেখানে আমি দু'বছর ছিলাম। কৃষি শ্রমিকের কাজ করতাম। জীবন মোটামুটি ভালই ছিল। আমি বিয়ে করতে সক্ষম হলাম। কিছুদিন পর একটি সন্তানও জন্ম দিলাম।
শিশুটির জন্মের পাঁচদিন পর একদিন পুলিশ আসল। তারা কোন আগাম সংবাদ না দিয়েই এসেছিল। আমরা তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। ওরা আমার স্বামী ও বোনের জামাইসহ সকল বর্মীদের ঘেরাও করে ফেলল ও তাদের ট্রাকে উঠিয়ে নিল। আমি পুলিশকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বললাম, আমার কয়েকদিন আগে একটি সন্তান হয়েছে। স্বামীকে ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না।
স্বামীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য পায়ের উপর পড়লাম। তাদের দয়া হল না। বলল, রোহিঙ্গারা কোন দয়া আশা করতে পারে না। আমি তাদের বললাম, তবে ওরা যেন আমাকেও নিয়ে যায়। তারা আমাকে একটি লরীতে উঠিয়ে নিল ও নাফ নদীর কাছে নিয়ে গেল। একটি মাছ ধরার নৌকা দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় কূলে ভিড়াল। মাঝিকে মারধর করার হুমকি দিল, সে যদি আমাদের নদীর ওপারে নিয়ে যেতে অস্বীকার করে।
- আমরা যখন ওপারে পৌঁছালাম, মাঝি বলল, সে নাসাকা বাহিনীকে কিছু রোহিঙ্গাদের গুলি করতে দেখেছে। সে আমাদের পথ বাতলে দিল কেমন করে নদীর উজানে হেঁটে যেতে হবে এবং বাংলাদেশে গোপনে প্রবেশ করতে হবে। আমরা সারারাত ধরে হাঁটলাম। ভোরের আলো দেখা দিলে আমরা এপারে চলে এলাম।' এমন সময় আমার কোলের শিশুর মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক অবস্থা লক্ষ্য করলাম। কোন রকম নড়াচড়া ছাড়া স্থির হয়ে আছে। পুতুলের মত তুলতুলে শরীরটা বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমাদের চলার পথে কখন আমার সন্তানটি কোলেই মারা গেছে, তা আমি অনুভব করতে পারিনি। সন্তানকে তার মায়ের বুকের আশ্রয়ে নিরাপদ মনে করেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে কেবল হেঁটেই চলেছি। আমার সহযাত্রীরা নদী তীরের নরম কাদায় হাত দিয়ে একটা ছোট গর্ত খুঁড়ল। সেখানেই বুকের ধনকে কবর দিলাম। ধরা পড়ার ভয়ে ইসলাম ধর্মমতে শিশুর জানাযা পড়ার জন্য সেখানে অপেক্ষা করতে পারলাম না। এমনকি সন্তান হারানোর বেদনায় আমার বুক ফেটে যেতে চাইলেও আমি শব্দ করে কাঁদতে পারলাম না।
- আমরা একটা প্রশস্ত সড়কের উপর উঠে এলাম। চলন্ত একটি জীপকে হাত নেড়ে ইশারা করলাম। গাড়ি চালকের কাছে আমাদের জীবন রক্ষা করার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম। সেখান থেকে জলদি অন্য কোথাও আমাদের নিয়ে যেতে বললাম, বস্তুতঃ চালককে দেয়ার মত আমার মাথার ওড়নাটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। চালক কুতুপাল; শিবিরের নাম আগেই শুনেছিল। তাই বলল, রোহিঙ্গারা সেখানে নিরাপদে আছে।
- ‘কুতুপাল' শিবিরে আসার সপ্তাহখানেক পর স্বামী বলল তাকে কাজের সন্ধানে বের হতে হবে। এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। সে চলে গেল। এখন কোথায় আছে, এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। পথঘাটও চেনা নাই যে আমি তাকে খুঁজে বের করব। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে কারো পরিচয় নেয়াও সম্ভব হয়নি যে তাদের সাহায্য নেব।
আমি এখন প্রতিদিন জঙ্গলে যাই। জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করি। যদি কিছু সংগ্রহ করতে পারি তবে আহার যোগাড় হয়। আর না হলে উপোস থাকি। এই পুরো সপ্তাহে আমি কেবল তিন বেলা খেয়েছি। স্বামী-সন্তান হারা আমি একা আছি। যাদের পরিবারের সদস্য দশ-বারো জন, তাদের মুখের আহার জোটানো আমার চেয়ে অনেক খারাপ। এমন জীবনের চেয়ে আমার জন্য মৃত্যু অনেক ভাল ছিল।