somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি কবিতা ও পাঠক এবং মূর্ত ও বিমূর্ত চিত্রকল্প ভাবনা

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হেলাল হাফিজ তাঁর ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতায় বলেছেন-



`নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না!’



আজকাল যেখানে মানুষই বোঝা দুঃসাধ্য ব্যাপার সেখানে সব কবিতা বোঝা যাবে না এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তাই বলে দুর্বোধ্যতার দায় শুধু কি কবির একার? পাঠকেরও নয়? অবশ্য অনেকে পৃথিবীর জটিল তত্ত্বগুলো বোঝেন, হিরোশিমা-নাগাসাকি বোঝেন, রাজনীতি বোঝেন, হেলেনের যে সৌন্দর্যে- প্রেমে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল তাও বোঝেন কিন্তু কবিতা বোঝেন না!



কবি কি কোনো ভিনগ্রহণের প্রাণী?

কবিতার পাঠক, আপনি কি মনে করেন কবি অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন? কবি যে ভাষায় কথা বলেন, যে ভাষায় বায়ূ গ্রহণ করেন, যে রাস্তায় হাঁটেন, যে সমাজে বসবাস করেন সে ভাষা আপনার নয়? আপনি সে বায়ূ গ্রহণ করেন না? সে রাস্তায় আপনি হাঁটেন কিংবা সে সমাজে আপনি বসবাস করেন না? কবির কাছে কি আলাদা কেনো অভিধান আছে যে অভিধান আপনার কাছে নেই?



কবিতা না বোঝার দায় কি শুধু কবির একার পাঠকের নয়?

কোনো কোনো পাঠকের অভিযোগ- কবিতা বুঝতে হলে যদি কবির শরণাপন্ন হতে হয় কিংবা অভিধান খুলে বসতে হয় তাহলে কবিতা পড়ার কী দরকার? অথবা বর্তমান সময়ে কবিতাপাঠকের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকে কবিতার দুর্বোধ্যতাকে দায়ী করেন। আসলে কি তাই? অথবা এ দায় কি কবির একার শুধু?



পাঠক বুঝলেই তা কবিতা কিংবা না বুঝলে তা কবিতা নয়! তাই কি?

পাঠক হিসেবে একটি কবিতা আমি বুঝলাম না। এর জন্য আমি কবিকে দায়ী করলাম এই বলে যে, আপনি কী কবিতা লিখেছেন যা আমার বোধগম্য হলো না? পাঠক হিসেবে আমার এ কবিতা না বোঝার দায় কি শুধু কবির?

আসলে কি তাই? উত্তর হ্যাঁ অথবা না দুটোই হতে পারে কিংবা কিছু হ্যাঁ কিছু নাও হতে পারে। শুরুতে কতগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে পাঠকের কাছে। আশা করি যারা কবি ও কবিতা নিয়ে চিন্তিত তারা এ-সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবেন।



একজন পাঠক হিসেবে আমার ভাবনা:

কবিতা বোঝা এবং না বোঝা এ প্রসঙ্গে আমার ধারনা- বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। সামগ্রিকভাবে না বোঝার দায় কবিতার কবিকে দিতে আমার সাহস হয় না অথবা সহসা কবির দিকে আঙ্গুল তুলতে দ্বিধা কাজ করে, পাছে অন্য পাঠকের কাছে পাঠক হিসেবে আমার দুর্বলতা প্রকাশ পায়। কেননা, কবি অভিধান খুলে কবিতা লিখতে বসেন না, তবে তার চর্চা করেন। কারণ কবির প্রচুর শব্দ প্রয়োজন। কবি তাঁর চোখ-কান খোলা রাখেন সবসময়। তিনি চলতি পথে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, জলে-স্থলে, আকাশে-মাটিতে, বৃক্ষে, ডালে, পাতায়, বাতাসে, পাখির কূজনে সর্বত্র খুঁজে ফিরেন কবিতার শব্দ। কেননা, কবিকে নির্মাণ করতে হয় সে শব্দমালা যা প্রতিধ্বনিত হবে মানুষের অন্তরে।



যে কবিতা আমি বুঝতে পারি না সে কবিতা অনুভব করার চেষ্টা করি। বিভিন্ন চিত্রকল্প সাজিয়ে কবিতার শব্দগুলো অনুভব করার চেষ্টা করি, যদি এতেও ব্যর্থ হই, তাহলে নিজের অনুভব এবং কল্পনাশক্তির সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে নিজেকে বলি কবিতা বোঝার মতো প্রস্তুতি আমার ছিল না কিন্তু কোনোভাবেই কবিতার কবিকে দায়ী করি না,না বোঝার দায় চাপিয়ে।



প্রায়শই কবিকে বলা হয় সহজ-সরল শব্দে কবিতা লিখতে কিন্তু কবি কি কারও আজ্ঞাবাহী? কবি কি পাঠকের কথা ভেবে কবিতা লেখেন? এ প্রশ্নে হয়তো অধিকাংশের উত্তর হবে ‘কবি যদি পাঠকের জন্য কবিতা না লেখেন তাহলে কেন তা প্রকাশ করেন পাঠক সমাজে?’ খুব স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক প্রশ্ন। কিন্তু একটু কী শরীর থেকে ‘পাঠক’ পদবী সরিয়ে ভাবতে বসবেন? যদি তা করতে পারেন তাহলে অনুভব করবেন কবি কখনোই পাঠকের কথা ভেবে কবিতা লিখতে বসেন না! কবি যখন লিখতে বসেন তার মস্তিকে পাঠকভাবনা থাকে না, থাকে কবিতার শব্দ,চিত্রকল্প, আত্মপীড়ন-দহন। তিনি এমন কিছু অনুভব করেছেন, দেখেছেন যা তাঁর ভাবনাকে বিদ্ধ করে রেখেছে। আর তাই তিনি যন্ত্রণাকাতর হোয়ে বসে যান কলম নিয়ে সে শব্দগুলোকে একটি অবয়বে গেঁথে দিতে। কবি নির্মাণ শেষে অনুভব করেন কবিতাটি হয়তো মানুষের কথা বলেছে, এই সমাজের কথা বলেছে। এই ভাবনা থেকে তিনি তাঁর কবিতাকে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে এর প্রকাশ করে থাকেন। পাঠকের ভাবনা-চিন্তা কবির সাথে মিলে গেলে পাঠক আবিষ্কার করেন কবিতাটি তার জন্য লেখা হয়েছে। যে কবিতাটি পাঠক বুঝলো না তার দায় কবির ওপর চাপিয়ে নিজেকে ভারমুক্ত করলেন। আর এ থেকে আমার সে ধারনা আরও মজবুত হয় যে কবি পাঠকের জন্য লেখেন না সবসময়।



এই বোঝা বা না বোঝা প্রসঙ্গে বরং দুটি উদাহরণ দেই। একটি সহজভাষায় লেখা অন্যটি কিছুটা দুবোর্ধ্য। দেখা যাক সহজভাষায় লেখা কবিতাও কী সবসময় সহজে বোঝা যায় কিনা কিংবা কঠিন শব্দে লেখা কবিতা সব সময়ই দুর্বোধ্য হয় কিনা!



“তখন রাত্রি আঁধার হল,
সাঙ্গ হল কাজ-
আমরা মনে ভেবেছিলেম,
আসবে না কেউ আজ ।
মোদের গ্রামে দুয়ার যত
রুদ্ধ হল রাতের মতো;
দু-এক জনে বলেছিল,
আসবে মহারাজ।
আমরা হেসে বলেছিলেন,
আসবে না কেউ আজ ।”
(আগমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)



“হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গুটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তারও চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।

মুছে দেবো আদ্যাক্ষর, রক্তবর্ণ অনার্য প্রাচীন।
বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।”
(সোনালি কাবিন : আল মাহমুদ)



প্রথম কবিতাটির ভাষা সহজ। শব্দও দুর্বোধ্য নয় কিন্তু সবাই কি বলতে পারবেন কে এই মহারাজ? কার আগমনের অপেক্ষায় সবাই অপেক্ষা করে বসেছিলেন? আবার দ্বিতীয় কবিতায় কিছু কঠিন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা কারও কারও কাছে দুর্বোধ্য মনে হবে কিন্তু কবি কবিতায় কী বলতে চেয়েছেন তা অনুভব করতে খুব বেশি কষ্ট হবে না।



সুতরাং বলা যায় যে, পাঠকের কাছে শব্দ দুর্বোধ্য মনে হয় তখন, যখন শব্দটি তার জানা থাকে না, বাংলাভাষায় অনেক শব্দ আছে যার অর্থ আমরা জানি না, আর এ না জানাকে জানার স্বল্পতা বলা যায়। আমি জানবো না বলে শব্দকে দুর্বোধ্য ভেবে কবিকে বলবো সহজ করে লিখতে – এ যুক্তি হয়তো মানা যাবে না। বিষয়টি আপেক্ষিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাই আমার না বোঝার সব দায় কবির ওপর বর্তাবে এটা যুক্তিসঙ্গতও নয়।



কবিতায় মূর্ত এবং বিমূর্ত প্রসঙ্গ:

কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর ‘ছবি’ কবিতায় এভাবে বলেছেন-

“ভ্যান গগ- যিনি আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে
সোনালি তুলে এনে
ব্যবহার করতেন- কখনো, শপথ করে বলতে পারি,
এমন গাঢ়তা দ্যাখেন নি।”



শিল্পী তো তাই করেন- কখনো আকাশ থেকে নীল আর শস্য থেকে সোনালি তুলে এনে শব্দ সাজান কিন্তু সে শব্দের গাঢ়তা অনুভব বা বুঝতে পারার জন্য পাঠকের কি কোনো প্রস্তুতি প্রয়োজন নেই? গাঢ়তা কি দেখা যায়, না অনুভব করে নিতে হয়? সবার বোধশক্তি সমান হবে তাও নয়। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখতে পাচ্ছেন? সবার উত্তর কি এক হবে? সবাই কি একই রকম দেখবেন এবং বলবেন? একজন হয়তো বলবেন চলিষ্ণু মেঘের কথা, কেউ হয়তো বলবেন পাখি উড়ে যাওয়ার কথা অথবা অন্যজন হয়তো আকাশে নীলের গাঢ়তা কিংবা কোনো চিত্র যা তার কাছে মনে হয়েছে – বলবেন। দেখার এ ভিন্নতা যদি থাকে তাহলে একজন কবিতাপাঠকের বোঝা কিংবা অনুভবেও ভিন্নতা থাকবে।



আবার ভ্যান গগ প্রসঙ্গে বলতে গেলে খুব অনায়াসে বলা যায় তিনি যে চিত্র এঁকেছেন, যে শিল্পের সৃষ্টি করেছেন সব দর্শকই কি তা বোঝে? কিংবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা কি সবাই বোঝে? আমার তো মনে হয় অধিকাংশই বোঝে না। অথচ জীবনানন্দকে একসময় বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সময় ঠিকই প্রমাণ করে দিয়েছে যে জীবনানন্দ দাশ রূপসীবাংলার কবি হতে পেরেছিলেন, তিনি সত্যিকারের কবি ছিলেন। তাই কবিতা না বোঝার দায় দিয়ে খুব সহজেই একজন কবিকে বাতিলে খাতায় ফেলে রাখবো না আমি।



কবিতার ভাষা সবাই বুঝবেন এটা মনে করা ঠিক হবে না। কারণ কবিতায় শিল্পের আঁচর থাকে, নন্দনতত্ত্বের ব্যবহার থাকে, ইমেজের ব্যবহার থাকে। থাকে উপমা- উৎপ্রেক্ষা, রূপক, সন্দেহ, শ্লেষ, অনুপ্রাস, বক্রোক্তি, যমক, দৃষ্টান্ত ইত্যাদি অলঙ্কারের ব্যবহার। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার তো মনে হয় ‘কবিতাপাঠক’র এ-সমস্ত বিষয়ে জানাশোনা না থাকলে সত্যিকারে কবিতার ভাষা তার কাছে দুর্বোধ্য বৈ সহজবোধ্য হবে না।



জীবনানন্দ দাশ বলেছেন – ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’। আমরা যারা কবিতা পড়ি তাদের অধিকাংশই কবির এ বাণীকে সত্যি বলে মেনে নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে উদাহরণ দেই। যদি তাই হয় তাহলে কবির এ বাণীকে বদলে বলা যায় – ‘সকলেই কবিতার পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক’। এই যে না বোঝার দায় এককভাবে কবিকে দেওয়া হয়, এর দায় কি পাঠকের হতে পারে না? পাঠক কি মনে করেন না কবিতা পাঠের জন্য তার প্রস্তুতি দরকার? কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব,শিল্প, অলঙ্কারের কথা বলা হয় তা কি তার পাঠের বিষয়ব্স্তু নয়? সাধারণত কবিতার বিশেষত্ব এই যে তাকে দণ্ডায়মান স্কুল শিক্ষকের সামনে মুখস্তপাঠের মতো শব্দুগলো পড়ে গেলে হবে না। তাকে অনুভব করে পড়তে হবে, কিছু সময় তার জন্য বরাদ্ধ রেখে। পাঠকের সে সময়টুকু কি তার আছে? সাধারণত ব্লগে, নেটে যে কবিতা পাঠ করা হয় তাকে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতার সত্যিকারের পাঠ বলবো না। কারণ নেটে একান্ত মনোযোগ দিয়ে অথবা একাগ্রতার সাথে কবিতা পাঠ করা হয় না। একজন পাঠক নেটে এসে অনেকগুলো লেখা একসাথে পাঠ করেন, মতামত দেন। আর এ করতে যেয়ে তার মনোযোগ ভাগ হোয়ে যায় অথচ কবিত তো পাঠকের একান্ত পাঠ দাবী করে। যে কবিতাটি অন্য দশটি লেখার সাথে পাঠ করে গেলেন তা একান্ত নির্জনে, খানিকটা সময় দিয়ে তাকে পাঠ করুন, দেখবেন কিছু ভিন্ন অনুভব হলেও হতে পারে।



মূর্ত কবিতা– যাকে আমরা অধিকাংশ পাঠক সহজ-সরল ভাষা ও শব্দে লিখিত কবিতা হিসেবে বুঝে থাকি অর্থাৎ কবিতার চিত্রকল্প পাঠক সহজেই ধরতে পারেন সে সমস্ত কবিতার জন্য প্রয়োজন পাঠকের পাঠআকর্ষণ ধরে রাখা। তাই আপাতদৃষ্টিতে কবিতায় শব্দ সহজবোধ্য হলেও তার নান্দনিক ও শিল্পিত ব্যবহার ঘটাতে হবে। অতি সাধারণ এবং বহুল ব্যবহৃত শব্দ কোনোভাবেই কবিতার প্রকৃত পাঠককে ধরে রাখতে পারে না। অর্থাৎ পাঠকের ভাবনার জগতকে নাড়াতে না পারলে কবিতা সহজবোধ্য হলেও তা পাঠকের মনে দাগ কাটবে না। পাঠকের ভাবনার জগত কীভাবে নড়ে ওঠে সে বিষয়ে প্রিয় ব্লগার কবি শৈবাল কায়েস’র একটি কবিতার থেকে উদ্ধৃতি-

“বাতাস হলে, গাছের পাতা নড়ে নদীর জল নড়ে
ছেলেটা নড়লে আলোর বিপরীতে ছায়াটা নড়ে
বৃষ্টি হলে, এই শহর ভিজে ঐ শহর ভিজে
মেয়েটা কাঁদলে, চোখের জলে ঐ জানলা ভিজে।
বাতাস হলে, গাছের পাতা নড়ে নদীর জল নড়ে
ছেলেটার ফুসফুসে বাতাস ধরে না
বাধ্যগত ছায়াটা আর নড়ে না।”
(রুদ্ধ শ্বাস রুদ্ধ জানালা | শৈবাল কায়েস)



কবিতার চিত্রকল্প সহজবোধ্য কিন্তু দেখুন কবিতায় শব্দের ব্যবহার কীভাবে দোলা দেয় পাঠকহৃদয়ে। ছেলেটা নড়লে ছায়াটাও নড়ে, মেয়েটা কাঁদলে জানলা ভিজে, বাতাস হলে গাছের পাতা নড়ে, নদীর জল নড়ে – এই সমস্ত শব্দবন্ধ পাঠককে মুহূর্তেই নিয়ে যায় ভাবনার অতলে কারণ প্রকৃত পাঠক অনুভব করেন এই ‘একে অন্যের বিপরীতে নড়ার’ নান্দনিকতা।



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরও কিছু কবির কবিতায় মূর্ত চিত্রকল্পের ব্যবহার যেমনি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শহীদ কাদরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দের মতো প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতায়ও বিমূর্ত চিত্রকল্পের ব্যবহার পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। আর বিমূর্ত ভাব প্রসঙ্গে তো লালন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।



[“চিত্রকল্পকে সবসময় দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দৃশ্যমানতা চিত্রকল্পের সবচেয়ে বড় গুণ হলেও চিত্রকল্পকে সবসময় প্রকটভাবে দৃশ্যমান হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু চোখ নয়, কান, জিভ ও স্পর্শ ইন্দ্রিয় ও অনুপ্রেরণা পারে জাগাতে। এমনকি মানুষের বিশ্বাস ও যাপন থেকেও অস্পষ্ট, বিমূর্ত অবয়ব কিন্তু যা বোধ ও চেতনাকে স্পর্শ করে যায় এমন চিত্রকল্প সৃষ্টি হতে পারে। এমন কী একই সাথে একাধিক সংবেদী অঙ্গকে ছুঁয়ে যেতে পারে কবির বোধ। (ইংরেজিতে একে বলে Synesthesia) যখন কেউ বলে, তোমার ‘গলাটা ভারী শোনায়’ কিংবা কারও ‘শীতলকণ্ঠ’ এর কথা বলে তখন কিন্তু একাধিক সংবেদী অঙ্গের অনুভূতিই আমরা পাই। এমিলি ডিকিনসনের’ ‘Light laughs the breeze in her castle of sunshine’ লাইনটি অথবা এডিথ সিটওয়েলের ‘dull blunt wooden stalactite / Of rain creaks, hardened by the light. পড়লে আমরা টের পাই সিন্সেথেসিয়ার ব্যবহার। জীবনানন্দ যখন চিলের ‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ’ মুছে ফেলার কথা শোনান, কিংবা বলেন, ‘…নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার’ কিংবা ‘ধূসর চালের গন্ধে তরঙ্গেরা ঝরেছে দুবেলা’ তখনও একই ভাবে সিনেস্থিসিয়ার ব্যবহার উপলব্ধি হয়।”] (কে এম রাকিব: প্রবন্ধ চিত্রকল্পের জানালা)



উদ্ধৃতিাংশে ব্লগার কে এম রাকিব Synesthesia প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। Synesthesia এর উপযুক্ত বাংলা কী হবে কিংবা আদৌ আছে কিনা জানি না তবে ইংরেজিতে একে ‘union of sences’ অথবা `mixing of sences’ নামে অবহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ বোধ/ভাবনার একতা অথবা মিশ্রণ। একটু বিশদ ভাবে বলা যায় –

– In poetry, synesthesia refers specifically to figurative language that includes a mixing of senses.
– Synesthesia was a way to heighten and clarify the symbolic imagery in these poems.
– An attempt to fuse different senses by describing one in terms of another.

ফ্রেঞ্চ সিম্বোলিস্ট কবিত্রয় Charles Baudelaire, Arthur Rimbaud and Paul Verlaine- এর হাত ধরে কবিতায় ‘সিন্সেথেসিয়া’র ব্যবহার জনপ্রিয়তা লাভ করে। কবি আর্তুর র‌্যাঁবো সিন্সেথেসিয়া সম্পর্কে “নির্দিষ্ট স্বরবর্ণ নির্দিষ্ট রং ধারন করে”- এ ধারনার উপর ভিত্তি করে একটি বিখ্যাত উদাহরণ দিয়েছেন তার ‘স্বরবর্ণ’ কবিতায়-

Vowels

Black A, white E, red I, green U, blue O — vowels,
Some day I will open your silent pregnancies:
A, black belt, hairy with burst flies,
Bumbling and buzzing over stinking cruelties,
Pits of night; E, candour of sand pavilions,
High glacial spears, white kings, trembling Queen
Anne’s lace;
I, bloody spittle, laughter dribbling from a face
In wild denial or in anger, vermilions;
U,…divine movement of viridian seas,
Peace of pastures animal-strewn, peace of calm lines
Drawn on foreheads worn with heavy alchemies;
O, supreme Trumpet, harsh with strange stridencies,
Silences traced in angels and astral designs:
O…Omega…the violet light of His Eyes!



কবিতাটি পাঠ করলে দেখা যায় তিনি প্রতিটি ‘স্বরবর্ণে’র একটি সতন্ত্র রং দিয়ে বর্ণনার ভেতরে কল্পনা /চিন্তার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, যাকে আমরা ‘সিন্সেথেসিয়া’ হিসেবে চিন্তা করতে পারি।



জীবনানন্দ দাশ কবিতায় এই ইমেজের ব্যবহার বা ‘ইমাজিনেশন’কে নাম দিয়েছেন ‘ভাবপ্রতিভা’ (কবিতার কথা) । আধুনিক নিরীক্ষাপ্রবণ কবিত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ‘ভাবপ্রতিভা’।

কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়ে আজকাল যে প্রশ্ন উঠছে তার জন্য কবিকে এককভাবে আমি দায়ী করবো না। দায়ী আমাদের জীবন প্রণালী, দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির আগ্রাসন। মানুন কিংবা না মানুন – সমাজে নীতিহীনদের সংখ্যা বাড়ছে ক্রমশ, বাড়ছে ঘুষখোরের সংখ্যা! মনে কী হয় না এসব দায়ী কবিতার পাঠক কমে যাওয়ার? ঘুষখোর কেন কবিতা পড়বেন? নীতিহীন লোক কেন কবিতা পড়বেন? ধরুন আগে যখন প্রযুক্তির এ আগ্রাসন ছিল না, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট ছিল না তখন শিক্ষিত পরিবারের সদস্যরা কী করে সময় কাটাতেন? হয় গান শুনতেন না হয় কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়তেন নতুবা বেড়াতে যেতেন। তখন মানুষের হাতে অফুরন্ত সময় ছিল, মানুষ অনেকটা স্থির ছিলেন। কবিতা একসময় এক শ্রেণীর পাঠকের মনের খোরাক ছিল এবং এক সময় মানুষ বর্তমান সময়ের মতো এতো বিভ্রান্ত কিংবা দিশেহারা ছিলেন না। অস্থির মনে কবিতা আসে না, কবিতা বুঝতে পারাও যায় না। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই কবিতার ভাষাকে দুর্বোধ্য মনে হতে শুরু করে।



সাহিত্যিক ডেভিড ফস্টার বলেছেন- ‘সাহিত্য শুধু মগজের বস্তু নয়, হৃদয়েরও এবং অনুপাতে হৃদয়ের ভাগটাতেই বেশি পড়া উচিত’। তাঁর এ উক্তিটি আমাদের কারও না বোঝার কথা নয়। তাঁর সাথে তাল মিলিয়ে আমিও বলতে চাই ‘কবিতা কেবল চোখ দিয়ে পাঠ করার বিষয় না, হৃদয় দিয়েও তাকে পাঠ করতে হয়’। তবে সব কবিতা বোঝা যাবে তা নয়, তাই বলে একজন পাঠকের ভালো লাগা বা না লাগা সামগ্রিকভাবে ভালো লাগা বা না লাগাকে নির্দেশ করতে পারে না। যে পাঠক সবসময় মনে করেন কবিতার ভাষা সহজ-সরল সহজে বোধগম্য হবে সে পাঠকের চিন্তা ও বোধ শক্তি প্রখর নয়, তারা ভাবনার অতলে ডুব দিয়ে মুক্তো তুলে আনতে পারেন না কেবল জলের ওপর ভাসমান কিছু দেখেই অভিভূত হতে পারেন। তবে অস্বীকার করবো না যে কোনো কোনো কবির কবিতার চিত্রকল্প উদ্ভ্রান্ত-এলোমেলো, কিছু শব্দের কারসাজি থাকলেও তা কোনো বার্তা প্রদান করে না। যে কবি বাস্তবের হাতি আকাশে ওড়ান তার ভাষা পাঠক কেন কবিই বোঝেন কিনা তা বলা মুশকিল।



সাহিত্যের যতগুলো শাখা রয়েছে তার মধ্যে কবিতা প্রাচীন এবং উৎকৃষ্টতম শাখা। কবিতা এমন এক শাখা যা বুঝতে হলে অনুভব করতে হবে, আর অনুভবের জন্য দরকার সাধনা যেমনটা লালনসঙ্গীত বুঝতে সাধনার প্রয়োজন। আর্ট ফিল্ম (Art Film) বলে যে ফিল্ম (Film) তৈরি হয় তার সবশ্রেণীর দর্শক হয় না, ঠিক তেমনি সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সাধারণ-অসাধারণ সব শ্রেণীর পাঠক থাকলেও কবিতার পাঠক নির্দিষ্ট শ্রেণীর। আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশ বলেছেন –‘মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্ট্তায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে’ (কবিতার কথা)। আধুনিক কবিতার এ ধারাটি নিরীক্ষাধর্মী এবং এর মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত। যুগে যুগে কবির সাতন্ত্রই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সময়ের বিচারে তাই আধুনিককালে কবিতার এই নিরীক্ষাকে না বোঝার দায় খুব সহসাই দেওয়াটা বুদ্ধিমান পাঠকের কাজ হবে না।



জীবনানন্দ দাশে’র উক্তিটি আবার দিয়ে শেষ করবো। ‘সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি’। সুতরাং সব লেখাকে কবিতা এবং সব লেখককে কবি ভাবার হয়তো গুরুতর কোনো আবশ্যকতা নেই (কবিতা ও কবির ক্ষেত্রে) । যিনি সত্যিকারের কবি তাঁর কবিতার কতটুকু সমঝদার পাঠক আমি- এ-ভাবনাই আমাকে বরং ভাবাক। সত্য তো এই যে, প্রকৃত কবি সমকালের বিচারে খুব একটা সমাদৃত হয় না, মহাকাল তাঁকে ঠিক একদিন গ্রন্থিত করে ইতিহাসে পাতায় আর আমরা হয়তো এই বলে আফসোস করতে থাকি, হায়! তিনি সত্যিকারের কবি ছিলেন।





পাদটিকা:
আলোচ্য প্রবন্ধটি একজন কবিতার পাঠক এবং খানিকটা কবিতা লিখিয়ে হিসেবে আমার অভিমত যা সার্বজনীন নয়। আমি এভাবে কবি, কবিতা ও পাঠককে ভেবেছি, আপনি হয়তো অন্যভাবে। কিন্তু কোনো ভাবনাই কবি কিংবা পাঠককে খাটো বা বড় করে দেখার প্রয়াসে নয়। কেননা, ভাবনারা যার যার তার নিজের মতো। প্রবন্ধটি পাঠের আগে পাঠকদের কাছে অনুরোধ যেন প্রতিটি শব্দ বা বাক্য গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করা হয়। তা না হলে হয়তো কোনো কোনো বক্তব্য একপেশে বলে মনে হলেও হতে পারে।


সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×