পানিতে ঈদের জামায়াতের ছবি নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। ভাইরাল হওয়ার জন্য নাকি নামাজ নিয়ে চটকদারিতা করা হয়েছে! গাবুরা-কয়রার মতো জায়গার ভৌগোলিক বাস্তবতা না জানার কারণে এই বিভ্রান্তি। আর চারদিকে মানুষের যে শো-অফ প্রবৃত্তি, তাতে সন্দেহ আরও উস্কে ওঠে।
উপকূলীয় এলাকার মানুষ মাত্রই জানে ভেড়িবাঁধ নিয়ে হাহাকার। পৃথিবীতে যেখানে সাগর ভরাট করা ডালভাত হয়ে গেছে, সেখানে মাত্র ১০ ফুট উঁচু মজবুত একটা বাঁধ নির্মাণ ৪০ বছরেও সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। কত টাকা লাগে এই কাজটা করতে!
কয়রার গাবুরায় যখন উত্তাল জলোচ্ছ্বাস দাপিয়ে আসে, ভঙ্গুর বাঁধ যখন চতুর্দিক থেকে হুড়মুড় করে ওঠে, তখন পুরো অঞ্চলের মাথাব্যথা হয় প্লাবন ঠেকানো। সেসময় করোনার ভয় থাকে না, ঈদের আমেজ থাকে না। শো-অফের শয়তানি, ভাইরালের ভণ্ডামি মনে আসে না। বাঁধ জোড়াতালির সম্মিলিত কাজ আর আল্লাহর উপর ভরসা তাদের বেঁচে থাকার সম্বল হয়।
কথা ছিল উপকূলীয় বাঁধ বানানোয় সাগরপ্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার। সুন্দরবনের পক্ষে দাঁড়াবার। কিন্তু তা না করে ইস্যু হয়েছে ‘ধর্ম’। ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত জনপদের মানুষের পাশে থাকার কথা ছিল, সেটা না করে কেন তারা পানিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লো সেই নিয়ে সরব। সব ব্যাপারে ধর্মকে টেনে আনা ধর্ম ব্যবসায়ীর আকাজ।
আম্ফানে তলিয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষের ঈদ–চাঁদের সময় ছিল না। বাংলাদেশের কৃষকের ফসল তোলার মাস এটা। এই মাসেই তার ভয় বেশি: ঝড়–বৃষ্টি আর ফড়িয়ার, দাম না পাওয়ার। এই মাসেই তারা বছরের সেরা খাটুনিটা দেয়। করোনা আর আম্ফানে দিনে কৃষকেরা কী বিপদে আছে, সেসবের কোনও খোঁজ আমরা কতজন রাখতে পারি? তা না পারলেও বাইনোকুলার দিয়ে ছিদ্রান্বেষণের কৌশল আমরা ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছি।
আমাদের দরকার ছিলো জনপ্রতিনিধিদের ধরার, ওয়াপদাকে ধরার, তাদের সমালোচনা করার। তারা যেন তেন প্রকারে বাঁধ বানিয়ে কাজ সারে। কিন্তু এসবে তাদের মাথা-ব্যথা নেই। তাদের কাছে দোষের হলো পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ পড়া। কেন বাড়ি থেকে প্রস্তুতি নিয়ে নামাজের জন্য এলো না? কেন ভালো কাপড় পরে এলো না?
কেউ কেউ আবার কয়েক কাঠি সরেস হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এরা কি ফজরের নামাজ পড়েছে? এরা কী জোহরের নামাজ পড়েছে? সামান্য ওয়াজিব নামাজ কেন এভাবে হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে? এরা কী প্রস্রাব করে পানি নিয়েছে? এরা কি প্রস্রাব করে এই এলাকা তলিয়ে দেয়নি? এরা কী বড়ি থেকে ওজু করে এসেছে। এরা কী অপবিত্র ছিলো। এরা অপবিত্র ছিলো না, পবিত্র ছিলো তার দায়-ভায় এদের উপর পড়বে। আপনার কেন ঠেকা পড়েছে এদের অপবিত্র বানানোর? এরা প্রস্রাব করে পানি নিয়েছে, এই প্রশ্নের মাধ্যমে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, আপনি প্রস্রাব করে পানি নেন না?
যে মানুষেরা সকালবেলা দল বেঁধে মাটি কেটেছে কাদায় মাখামাখি হয়ে, তারাই হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজটাও পড়েছে। তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা থাকলে সরকারকে বলতেন, বাঁধ বানায়ে দাও যেভাবে পারো।
টলমল পানিতে কৃষিজীবী মানুষগুলো সিজদার ভঙ্গিতে দুহাত ছোঁয়াচ্ছে; এর থেকে সুন্দর ছবি আর কয়টা আছে? এক অপূর্ব দৃশ্য। এই নামাজ শেষে তারাই আবার ফিরে যাবে বাঁধ তৈরির কাজে। কৃষকের চাষের জমি তার পবিত্র ভূমি, তার জীবনের আশা-ভরসার স্থল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:১৩