somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খুঁজে খাওয়া ইফতার

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১২ সকাল ৭:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লেখাটি যুগান্তরে গতকাল পড়ে খুব খারাপ লাগল। তাই শেয়ার করলাম সকলের সাথে।

খুঁজে খাওয়াদের মজার ইফতারি
-আরমান জামান
ছিন্নমূল ছেলেমেয়েরা রাজপথের টোকাই হিসেবে পরিচিত। দিনে কখনও একবেলা পচা-গান্ধা খাবার জোটে আবার কোনদিন জোটেও না। কেউ কেউ আবার কেমিক্যালের গন্ধ শুঁকে শুঁকে খিদা মেটায়- পাথরের মূর্তির মতো চেহারা দেখে রাজপথের টোকাই হিসেবে চিনতে একটুকুও কষ্ট হয় না। ময়লা-নোংরা-ছেঁড়া জামা-কাপড় পরিহিত টোকাইদের প্রতিটি দিন অতিকষ্টে পার হয়। খিদার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে-বসে সময় কাটায়। কিন্তু রমজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে অভুক্ত টোকাইদের চেহারায় যেন তেল তেলে ভাব ঢেউ খেলে- মানুষের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন রকমের ইফতারি খেয়ে তাদের আনন্দ যেন আর ধরে না। পেটপুরে খাওয়ার পর থেকে যাওয়া মজাদার ইফতারিগুলো রাত এবং দুপুরের খাবারের জন্য সযত্নে রেখে দেয়, কেউ কেউ আবার অতিরিক্ত ইফতারি রোদে শুকিয়ে পলিথিনের পুঁটলিতে ভবিষ্যতের জন্য জমা করে। ফকিরাপুলে বাসায়-দোকানে ছোটাছুটি করে ইফতারি জোগাড় করছিল সখিনা। তার ব্যস্ততার মাঝেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, খুকি ইফতারি খেতে তোমার কেমন লাগে? সে হাফাতে হাফাতে বলল, ‘ভালোই লাগে- যাইগা, সবাইর খাওয়া অইয়া গেলে আর দিব না।’ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে শেষ করতে না পেরে মনে বড়ই অশান্তি লাগছিল। তাই ইফতারি আনার জন্য সে যেই বাড়ি বা দোকানে যাচ্ছিল দূর থেকে তাকে ফলো করছিলাম। ইফতারি জোগাড় করা শেষ হয়ে গেলে একটা ওয়ালের পাশে বসে পেটের খিদায় খুব দ্রুত হাত চালিয়ে ইফতারি খাচ্ছিল- খেয়ে পেটপুরে গেলে তার চোখে-মুখে একটি প্রশান্তির ভাব ফুটে ওঠল। তখন আস্তে আস্তে আবার তার পাশে গিয়ে বসলাম। সে মুচকি হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ইফতারি খাইছেন’? আমি মাথা নেড়ে তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- তুমি কি প্রত্যেকদিন ইফতারি জোগাড় কর? আর খাওয়ার পর যা থাকে তা কী কর? হেসে সখিনা বলল, ‘প্রত্যেকদিন ইফতারি জোগাড় করি। খাওয়ার পর যেডি থাহে পলিথিনের ব্যাগের মধ্যে রাইখা দেই- রাতে খাই, পরের দিনও খাই। তারপর যেডি থাহে পাক্কার ওপর রইদে শুহাই। শুহাইলে, পলিথিনের ব্যাগে ভইরা রাইখা দেই- রোজা গেলেগা তো আর ভালা কোনো খাওন পাই না, তহন শুহানো ইফতারি খাই, কহনও কহনও কেহ কিনতে চাইলে বেইচা দেই’। টোকাই বাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কত বছর ধইরা সে ঢাকায় ইফতারি জোগাড় করে? বাবু হেসে বলল, ‘তা কইতে পারুম না। তবে আমার জন্ম ঢাহাতে অইছে মায়ের কাছে হুনছি- আমার বাবাকে আমি দেহি নাই। আর মাও কয়েক বছর আগে এক লোককে বিয়া কইরা কই গেছেগা কইতাম পারুম না। আমি যে বছর থেইক্কা বুঝি, তহন থেইক্কাই মানুষের বাসায় বাসায় গিয়া ইফতারি আনি- সারা বছর খাইতে না পারলেও রোজার মাসটা খুব ভালা, দামি দামি খাওন খাইতে পারি। ভালা ভালা ইফতারি খাইয়াই পেট ভইরা যায়। খাওয়ার পর অনেক ইফতারি থাহে, কিছু ফালাইয়া দেই, সামান্য অন্যদের দিয়া দেই। রোজা ছাড়া অন্য সময় তেমন খাই না আর খিদাও থাহে না। ব্যাগের ভেতর গাম ঢুহাইয়া মুখ দিয়া টানলে পেট সবসময় ভরা থাহে।’ কমলাপুর রেলস্টেশনে জমাকৃত ইফতারি শুকাচ্ছিল সুমন, রবিন আর রিনা। তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম ইফতারি শুকিয়ে তারা কী করবে? তারা বলল, ‘শুহানোর পর আমরা এইডি অন্যদের কাছে বেচুম, তারা নিয়া খিচুড়ি বানাইব। তারা কম দামে কিন্না নিয়া খিচুড়ি বানাইয়া অনেক লাভ করে, মাইঝখান দিয়া আমরাও কয়েকডা পয়সা পাই’। এ কথাগুলো বলে তারা হি হি করে সেহে ওঠল। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নিচে ইফতারির ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল রেখা। সে বলল, ‘প্রত্যেকদিন এই ব্যাগ ভইরা ইফতারি পাই। রোজার আগে পেডের ভুকে ঘুমাইতে পারতাম না- এহন পেড ভইরা খাইতাম পারি, ঘুমও অয় ভালা। আমার মা-বাবা দুইজন পঙ্গু, আমি ছাড়া কাজ করবার মতো আর কেউ নাই- আমি যে ইফতারি নেই তারাও হেইগুলা পেড ভইরা খায়। সারা বছর যদি এই রহম রোজা থাকত, পেড ভইরা ভইরা খাইতে পারতাম’! শুলশানে ছেড়াঁ পলিথিন ব্যাগে সামান্য কয়েকটা ইফতারি নিয়ে ফুটপাতে বসে কাঁদছিল সুমন। তাকে তার ইফতারি কোথায় জিজ্ঞাস করলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বলতে লাগল, ‘ঐ দিকের একটা বাড়িতে ইফতারির লাইগা ঢুকছিলাম- দারোয়ান মাইরা বাইর কইরা দিছে, আমার ব্যাগের সব ইফতারি ফালাইয়া দিছে, ব্যাগডা ছিঁড়া ফালাইছে। এহন আমার ভাইবোনেরা কি খাইব? বড় লোকেরা কি খাওন দিব, হেরার গেইডের ভেতরই ঢুকতে দেয় না।’ সুমনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তার মা-বাবা কোথায়? সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবারে দেহিনাই, মা কয়েক মাস আগে মইরা গেছে। আমার তিনডা ছোড ভাইবোন আছে, আমি খাওন নিলে হেরা খায়, আজগা রাইত আমার ভাইবোনডির কী অইব’।
পিজি হাসপাতালের ডাক্তার অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘টোকাইদের সংগৃহীত ইফতারি যদি ঠিকভাবে রোদে না শুকিয়ে পলিথিনে ভবিষ্যতের জন্য রাখা হয়, তবে সেগুলো বিষাক্ত হয়ে যাবে। ইফতারি তখন অসহায় ছেলেমেয়ের ডায়রিয়াসহ মৃত্যুর কারণ হতে পারে’। টোকাইরা স্বাধীন বাংলাদেশেরই সন্তান। তাদের মানসম্মত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা সরকারের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।


৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×