somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আকাশটা খুব উঁচু নয়

১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইটপাথরের এই নগরী ছেড়ে বিমানবন্দর সড়ক ধরে এগিয়ে যেতে থাকলে বাঁ দিকে যে সবুজ শ্যামলিমা চোখে পড়ে, সেটাই কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব। কংক্রিটের জঙ্গলে এক টুকরো মরূদ্যান। উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, শীর্ষ আমলা আর বড় বড় ব্যবসায়ীদেরই সেখানে যাতায়াত। সেখানে পা দিয়ে মাদারীপুরের এক দরিদ্র কিশোর ভাবে, এ কোথায় এসে পড়লাম!
অভাবের সংসারে খানিকটা সহায়তা করতেই প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়ুয়া সিদ্দিককে বলবয় হিসেবে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে কাজ জুটিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরই এক আত্মীয়। যাঁরা খেলতে আসেন, তাঁদের বল কুড়িয়ে দেওয়াই যার কাজ। বিনিময়ে সামান্য বকশিশ। কিছুদিন পর হলো প্রমোশন, এবার ক্যাডি। খেলতে আসা খেলোয়াড়দের গলফ কিটের ব্যাগ বহন করাই যাদের প্রধান কাজ। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত আরো অনেকের মতো। কিন্তু সিদ্দিক তাঁর জীবনের গল্পটা যে লিখতে চেয়েছিলেন অন্য রকম করে! গলফ ক্লাবে পুরনো ‘ক্লাব’ (গলফের স্টিক) দিয়ে অনুশীলন, ক্যাডি আর বলবয়দের সঙ্গে খেলতে খেলতে একসময় সিদ্দিক আবিষ্কার করলেন, এ খেলাটায় তাঁর ধারেকাছে কেউ নেই। স্বপ্নের ডানা মেলার শুরু সেখানেই।
দেশে, এরপর দেশের বাইরে, অপেশাদার আসরগুলোতে খেলতে থাকেন সিদ্দিক। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত- একে একে বেশ কিছু জায়গাতেই শিরোপা জিততে থাকেন। পথচলার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন গ্রামীণফোনকে, প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর থেকেই স্পন্সর হিসেবে তাঁর পাশে আছে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৬ সালে, মাত্র ২২ বছর বয়সে গলফে দেশের সেরা খেলোয়াড় হয়ে যান সিদ্দিক। পরের পথচলাটা অবিশ্বাস্য গতিতে, বস্তিতে বসবাস করা ট্যাক্সিচালকের ছেলের কাছে যা মাঝে মাঝে মনে হতে পারে স্বপ্ন। ২০০৮ সালে ভারতের পেশাদার গলফের সর্বোচ্চ সংস্থা পিজিটিআইয়ের (প্রফেশনাল গলফ ট্যুর অব ইন্ডিয়া) চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন পুনেতে। পরের বছর বেঙ্গালুরু ওপেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ওপেন জয়ের আগে অবশ্য অনন্য এক কীর্তি গড়া হয়ে গেছে সিদ্দিকের। ব্রুনাই ওপেন জয়ের মাধ্যমে পেশাদার গলফে প্রথম এশিয়ান ট্যুরের শিরোপার স্বাদ পরখ করেন সিদ্দিক, প্রিয় গলফার আর্নি এলসের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার জেবিইক্রুগারকে হারিয়ে। পরের বছর বাংলাদেশ মাস্টার্স ও আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট জিতলেও বড় আসরে শিরোপার স্বাদ পাওয়া হচ্ছিল না ‘বাংলাদেশের টাইগার উডস’-এর। দিল্লির ইন্ডিয়ান ওপেনে জয় এলো সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে।
সিদ্দিককে শুধু একজন গলফারের পরিচিতিতে সীমাবদ্ধ করে রাখা কঠিন। সিদ্দিক হয়ে উঠেছেন একটি প্রতীক, এক প্রেরণার নাম। সিদ্দিকের সাফল্যের পথ ধরে জামাল মোল্লা, সাগরসহ অনেকেই আসছেন পেশাদার গলফের ভুবনে। সিদ্দিক আসলে বাংলাদেশের মানুষেরই ‘হার মানতে না জানা’ মনোভাবের চরিত্রায়ন। অভিজাততন্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে সিদ্দিক গলফকে নিয়ে এসেছেন চেনা মানুষের গণ্ডিতে। তাঁর কারণেই বাংলাদেশের অনেকে গলফের খোঁজখবর রাখছে, গলফের প্রতি আগ্রহও বাড়ছে। ক্রিকেটের উন্মাদনা আর ফুটবলের সোনালি অতীতের সঙ্গে সঙ্গে গলফও আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছে সম্ভাবনাময় খেলা হিসেবে। দক্ষিণ এশীয় গেমসে সোনা এসেছে গলফে- এই স্বপ্ন দেখার সাহসটা তো সিদ্দিককে দেখেই পাওয়া।
বছর তিনেক আগের কথা। কালের কণ্ঠের আয়োজনে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার দেওয়া হবে, এ জন্য পত্রিকার পাতায় ছাপা ব্যালট কেটে আর ওয়েবসাইটে ভোট দিচ্ছেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। সদ্য নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ করার নেতৃত্বে থাকা সাকিব আল হাসান ভোট পাচ্ছেন প্রচুর, তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাচ্ছেন সিদ্দিকও। একটা সময় দুজনেই পাচ্ছিলেন প্রায় সমান সমান ভোট। অবশেষে যদিও সাকিব এগিয়ে যান, প্রায় ৫০ ভাগ ভোট পেয়ে পুরস্কারটা পেয়ে যান বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডারই। কিন্তু অবাক করার বিষয়, প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন সিদ্দিক! গলফ নিয়ে সেই অর্থে উন্মাদনা নেই, দর্শকপ্রিয়তা নেই। খেলাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাঁরা, তাঁরা বাদে জটিল নিয়ম-কানুনও অনেকের অজানা, তাই রোজকার খবরের কাগজে ক্রিকেটের প্রচারণার সঙ্গে তুলনায় গলফের অবস্থান অনেক পেছনে। সেই গলফের একজন খেলোয়াড় পেয়েছিলেন ৩০ ভাগ ভোট, তামিম ইকবালকে পেছনে ফেলে! কারণ বাংলাদেশের অনেক মানুষ খেলাটা না বুঝলেও বুঝতে পেরেছিল সিদ্দিকের সাফল্যের মর্ম। সিদ্দিক তাই ঠিক গলফার ছিলেন না, ছিলেন মানুষের স্বপ্ন দেখার ও সেটা সফল করার এক বাস্তব উদাহরণ। সেই স্বপ্নের ক্যানভাসেই আরেকটা তুলির পরশ বুলিয়ে দিলেন সিদ্দিক, বাড়িয়ে দিলেন স্বপ্ন দেখার সীমানাটাও।

মাসখানেক আগে গলফ ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলছিলেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনে পয়সায় গলফ শেখানোর একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। প্রথম দিকে অনেকেই এলেও ধীরে ধীরে কমতে থাকে সংখ্যাটা। এমনকি বিকেলের নাশতার ব্যবস্থা রেখেও গলফ শিখতে আগ্রহীদের পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে কদিন আগেই কালের কণ্ঠে ছাপা হয়েছিল বিকেএসপিতে ক্রিকেটার হিসেবে ভর্তীচ্ছুদের লম্বা লাইনের ভিড়ের ছবি। বাবা-মা সন্তানকে ক্রিকেট কোচিংয়ের জন্য মাঠে দিয়ে আসছেন, এই দৃশ্য এখন আর বিরল নয়। সেই কর্মকর্তার আক্ষেপ হয়তো ঘুচবে খুব তাড়াতাড়িই। সেদিন খুব দূরে নয়, যেদিন ক্রিকেটের মতো গলফ শিখতেও আসবে প্রচুর কিশোর-কিশোরী। সাকিব আল হাসান দেখিয়েছিলেন, আকাশটা খুব উঁচু নয়। বাংলাদেশের নতুন প্রজšে§র জন্য সিদ্দিকুর তা আরেকটু হাতের নাগালে এনে দিলেন।
কালেরকন্ঠে প্রকাশিত ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৪০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×