দুই বুড়া
....মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ।
প্রকৃতির আশীর্বাদ এই কুমিল্লা জেলা।
এখানে দক্ষিণাঞ্চলের মতো ঝড় জলোচ্ছ্বাস এসে কারো হাত পা ধরে টানাটানি করেনা, আবার উত্তরের অভদ্র শীতের মতো কারো লেপ কম্বল নিয়ে হানাহানিও লাগায় না।
প্রকৃতির এই নিঃসঙ্ঘাতময় পরিবেশের মধ্যেও এ অঞ্চলের লোকেরা যে খুব সুখে দিন কাটায় তা কিন্তু না। তারা প্রতিনিয়তই কৃত্রিম সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে তাদের বুদ্ধিমত্তার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এখানে হাঁসের ডিম নিয়ে উদ্ভূত ঝগড়া শেষ পর্যন্ত বাঁশের লাঠিতে রূপ নেয়াও অসম্ভব নয়। আবার আদার নালিশ আদালত পর্যন্ত যাওয়াও অবাক হবার মতো ঘটনা নয়।
এ অঞ্চলেরই এক গ্রামে বাস করে দুজন প্রবীণ ব্যক্তি। খাঁটি বাংলা ভাষায় বলতে গেলে দুই বুড়া।
একজনের নাম চান মিয়া এবং অন্যজন মালু।
জীবনের সব কাজ শেষ করলেও একটি কাজ তাদের কোনদিনও শেষ হয়না। অপরের দুর্নাম রটনা করা।
মালু মিয়া হয়তো আখিরাতের ভয়েই ফকিরকে দুটি টাকা দান করেছিল। কিন্তু তা চান মিয়ার কানে পৌঁছতেই তিনি তাঁর সকল পান্ডিত্য একত্র করে প্রমাণ করলেন যে ওই টাকা চুরির। নইলে শিরনী না দিলে তো মালুকে কোন দিন মসজিদে দেখা যায়না। আজ আখিরাতের ভয় মাথায় চাপে কি করে?
চান মিয়া আগাগোড়া ব্যকরণিক লোক।
লেখাপড়া জানা সেকেলে পন্ডিত। জীবনের প্রতিটি কাজ তিনি ব্যকরণের নিয়ম মাফিক করেন। এমনকি যখন অকথ্য অশ্রাব্য ভাষায় কাউকে গালিগালাজ করেন তখনও নাকি ব্যকরণের একটি বিশেষ নিয়ম অনুসরণ করা হয়। যার তত্ত্ব হয়তো ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিংবা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কারোরই জানা ছিলনা। তার পান্ডিত্যের মাত্রা ছিল এমনই প্রখর!
সেদিন শীতের মাত্রা তেমন ছিলনা। একটু সকাল সকাল বাইরে বেরিয়ে এলেন চান মিয়া। রাস্তা দিয়ে পূর্ব পাড়ার কবিরের ছেলে জলিল তিনটি লাউ নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিল।
চান মিয়া সামান্য ভদ্র ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, কি রে জইল্যা, লাউ কত?
-তিন টেঁয়া দাদা।
-একটা না তিনডা?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। ইতোমধ্যেই কোথ্থেকে মালু মিয়া এসে ইয়ার্কি স্বরে বললেন, তোর বায় কিনচে নি লাউ, কেনরে..ঐ? তিন মাদান কোঁতাইলে তিন টেঁয়া বারুইত ন। তুই আইচত লাউ কিনতি!
এ আঘাত চান মিয়ার সহ্য হবার মতো নয়। ইচ্ছে করে তখুনই তিনি তিনটি লাউ কিনে মালুকে দেখান যে তার বুকের পাটা কত বড়!
কিন্তু পকেটে একটা মেরামত করা দুই টাকার নোট ছাড়া অন্য কোন টাকা না থাকায় তিনি তার ব্যকরণের বিশেষ নিয়মটি প্রয়োগ করেন।
এক সময়ে গালিগালাজের মাত্রা এতোই তিব্র হলো যে শীত আর শীত রইল না!
রীতিমতো কয়েক ঘরের মানুষ জটলা পাকিয়েছে এখানে। হাঁকডাক শুনে ঘুম থেকে উঠে এসেছিল তারা।
হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে জলিলের খাঁচি থেকে একটা লাউ নিয়ে মালুর দিকে তাক করলেন চান মিয়া।
মালু মিয়াও যমদূতের মতো আরেকটি লাউ হাতে নিয়ে চান মিয়ার দিকে তাক করলেন এবং তার যতেœ পালিত ভূঁড়িতে দিলেন এক গুঁতো...!
দুই হাত দূরে গিয়ে পড়লেন চান মিয়া।
মাটি থেকেই তার হাতের লাউটা ছুঁড়ে দিলেন মালু মিয়ার কপাল বরাবর। কিন্তু গতি বেশি হওয়ায় তা পড়ল গিয়ে লিপির মার মুখে।
লিপির মা তার দুই ঠোঁটের জোড়ে অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তা শুধু গে্যঁ গে্যাঁ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলনা।
কারণ তার বিশেষ চারটি দাঁত ইতোমধ্যেই নিখোঁজ...!
গতিক না দেখে জলিল তার অবশিষ্ট লাউটি নিয়ে কোনমতে স্থানটি ত্যাগ করল।
সেদিনের মতো বাজার মিটে গেল।
কিন্তু ঝগড়া মিটল না।
বিকেলে দরবার বসল সর্দার বাড়িতে। গ্রামের অধিকাংশ লোক সেখানে উপস্থিত। এমন দিনের জন্য তারা সবাই যেন অপেক্ষা করে....
চারদিক থেকে চারজন এমন ভাবে তাদের বক্তব্য প্রকাশ করতে লাগল যে, সর্দার ঘটনার আগামাথা কিছুই আঁচ করতে পারলেন না। বিকট হাঁক ছেড়ে সবাইকে সাবধান হতে বললেন তিনি।
এমন সময় দরবারে দেখা গেল লিপির বাপ শুকুর আলীকে। হ্যাঁ। তিনি ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না সত্যি। কিন্তু তার স্ত্রীর কাছে সব শুনেছেন। বুড়ো নাকি নিজে ইচ্ছে করেই তার দাঁতে লাউঘুষি দিয়েছে। বুড়োর সাথে তার বৈচা মাছ নিয়ে ঝগড়া ছিল কিনা তাই। অনেক দিন ধরে দিন গুনছিলেন। নইলে রুজির মা থাকতে, নিলুর মা থাকতে লাউ কেন এসে তার মুখে পড়বে? চান মিয়ার কান ছিঁড়ে নেবার কথা তিনি বিশেষভাবে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন। বউয়ের ব্যথায় কি কম কষ্ট পেয়েছেন তিনি? বউ তার কয়লা দিয়ে দাঁত মাজতো আর বলতো, জানেন নি লিপির বাপ! লিপির বিয়ার গোস্ত খাইতাম দাঁত দারাইতে আচি। আর সেই দাঁত কিনা....
চান মিয়া ব্যকরণের সকল নিয়ম একত্র করে বললেন যে, দোষ মালুরই।
মালু তার উন্নতি দেখতে পারেনা। তার ধান ক্ষেতে গরু লাগিয়ে দেয়। সবজির বাগানে ছাগল লাগিয়ে দেয়। বিচার চাইতে গেলে বলে গরু ছাগল কি আন্নের মতো হন্ডিত নি?
এই মালুর সাথে বিবাদ তার বহুদিনের। মালু কেন সকালবেলা তাকে তিরস্কার করেছিল? তিনি কি সকালবেলা লাউ কিনতে বেড়িয়েছিলেন যে পকেটে টাকা থাকবে? তাছাড়া জলিলের সাথে রসিকতা করার অধিকারও তার আছে।
এবার পালা মালু মিয়ার।
তিনি একটু মুচকি হেঁসে বললেন যে আসলে ঘটনা তেমন কিছুনা। ব্যাপারি বাড়ির সিদ্দিক তার শ্বশুড় বাড়ির আতœীয়। এই সিদ্দিকের মামাতো ভাই কবির এবং তার ছেলে জলিল। তাই ঘনিষ্টতার জন্যই তিনি জলিলের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং চান মিয়াকে সামান্য কটু কথা বলেছিলেন।
কটু কথা কি তিনি এমনিতে বলতে পারেন না? চান মিয়ার টেম্পারেচার কেন এত গরম? গত আশ্বিনে যখন চান মিয়া তাকে তার দ্বিতীয় বউ সম্পর্কে কটুক্তি করেছিল, তখন তো তিনি কারো মুখে কুমড়ো কিংবা নাড়কেল ছুঁড়ে মারেন নি!
এ বিচার মাটি দেওয়া আদালতের কাছে দুঃসাধ্য হলেও সর্দারের কাছে তা পানির মতো। মালু মিয়া তার কাছে এক কুড়ি ডিমের টাকা পায় এখনও আর চান মিয়ার সাথে তার নতুন সম্বন্ধ হবে। তাই অবিচার তিনি করতে পারবেন না কারো উপরই। বরঞ্চ ধর্মের কথা বলে লিপির মার উপর দোষ চাপানো অন্যায় ব্যপার নয়। ঠিকই তো। গাঁয়ের বউদের পুরুষের ঝগড়ায় যাবার কি দরকার? পর্দা টর্দা বলতে এলাকায় এখনো কিছু একটা আছে।
ধর্মের নীতি না মানলে যে গজব পড়ে একথাটি উদাহরন সহ তিনি সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। এর উপর আর কোন কথা খাটল না।
তবে তিনি অবিচার কারো উপর করেননি। চান মিয়াকে এবং মালু মিয়াকে বিশ টাকা করে দেওয়ার জন্য বললেন যাতে দুটি ট্যবলেট মুখে দিতে পারে এই নারী।
টাকা পেয়ে অবশ্য শুকুরই আদায় করেছে শুকুর আলী। অন্যায় করার পরেও যে সর্দার এতোটুকু মহানুভব হবেন তা হয়তো তিনি চিন্তাও করতে পারেন নি। তাইতো ঘরে নিয়ে বউকে বুঝালেন যে পোকায় খাওয়া দাঁত গুলোর বিশেষ প্রয়োজন ছিলনা।
এ ঘটনার পর সঙ্গত কারণেই কিছু দিন তাদের কথা বলা নিষেধ। বুড়ো মানুষের বিষ সাপের বিষের চাইতেও বিষাক্ত কিনা তাই।
কিন্তু কথা বলতে যখন ইচ্ছে হলো, মুখ তখন বন্ধ হয়ে গেল একেবারেই। এ নিয়ম চান মিয়ার ব্যকরণের নিয়ম কিনা জানিনা।