
আমাদের সমাজে একটা অদ্ভুত বিষয় খুব সাধারণভাবে দেখা যায়—
অনেক সময় কেউ আমাদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়, প্রতিশ্রুতি দেয় অমুক তারিখে ফেরত দেবে। কিন্তু সময় পেরিয়ে যায়, দিন সপ্তাহে, সপ্তাহ মাসে, মাস কখনো বছরে পরিণত হয়… তবুও সেই টাকা আর ফেরত আসে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, টাকা ফেরত না পাওয়ার পরও অনেকেই মামলা করে না, আইনি পদক্ষেপ নেয় না, এমনকি প্রকাশ্যে বিষয়টিও তোলে না—বরং চুপচাপ বসে থাকে।
প্রশ্ন হচ্ছে: কেন?
এর পেছনে আছে কিছু মানসিক, সামাজিক ও বাস্তব কারণ, যা অনেক সময় আমাদের অজান্তেই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
১. সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়
বাংলাদেশের মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নির্ভর সমাজে সামাজিক সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় যে মানুষটা টাকা ধার নিয়েছে সে হতে পারে আত্মীয়, বন্ধু, ব্যবসার পার্টনার বা এলাকার পরিচিত কেউ। তার বিরুদ্ধে মামলা করলে সামাজিকভাবে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেতে পারে, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যেতে পারে—এই ভয়েই অনেকেই মুখ খোলে না।
বাস্তব উদাহরণ:
সিলেটের একটি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই তার এক খালাতো ভাইকে ৫ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন ব্যবসা করার জন্য। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও টাকা ফেরত আসেনি। মামলার পরামর্শ দিলেও পরিবার বলল, “আত্মীয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে সমাজে মুখ দেখাবে কিভাবে?” ফলে তিনি আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে বিষয়টা চেপে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই টাকা আর ফেরত পাননি।
২. “লোক জানাজানি” বা মানহানির ভয়
অনেকে মনে করেন মামলা করলে বিষয়টা “পাবলিক” হয়ে যাবে, মানুষ জানবে, নিজের মান ইজ্জত নষ্ট হবে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা ভয় পান, যদি বাজারে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি কারও বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে মামলা করেছেন, তাহলে অন্যরাও ভাবতে পারে তিনি ‘কঠিন’ মানুষ—ফলে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাস্তব উদাহরণ:
ঢাকার গুলিস্তানে এক পোশাক ব্যবসায়ী তার এক কাস্টমারের কাছে ৩ লক্ষ টাকা পাওনা ছিলেন। কিন্তু তিনি মামলা না করে চুপ করে যান। কারণ বাজারে কেউ যদি জানে তিনি কাস্টমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তাহলে ভবিষ্যতে অন্যরা হয়তো লেনদেনে ভয় পাবে। অথচ টাকা না ফেরত পাওয়ার কারণে তার দোকানে পণ্য ঘুরাতে সমস্যা হয়, নতুন ইনভেস্টমেন্ট আটকে যায়।
৩. আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা ও সময়সাপেক্ষ ঝামেলা
অনেকেই মনে করেন মামলা মানেই দীর্ঘদিন কোর্ট-কাচারিতে ঘোরাঘুরি, খরচ, সময় ও মানসিক চাপ। বিশেষ করে ছোট অঙ্কের টাকার ক্ষেত্রে মানুষ ভাবে, “মামলা করতে গিয়ে আরও বেশি খরচ হয়ে যাবে।” এই ধারণা থেকে অনেকে আইনি পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী হন না।
বাস্তব উদাহরণ:
নরসিংদীর এক যুবক তার এক বন্ধুকে ৫০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। পরে টাকা ফেরত না পেয়ে মামলা করার কথা ভাবলেন। কিন্তু স্থানীয় একজন বলল, “মামলা করলে বছর চলে যাবে, উকিলের খরচই বেশি হবে।” ফলে তিনিও বিষয়টা ছেড়ে দেন।
৪. ‘ভদ্রতা’ বা ভুল জায়গায় দয়া
কিছু মানুষ মনে করেন টাকা চাইতে গেলে বা আইনি পদক্ষেপ নিলে “খারাপ” মনে হবে। তারা ভাবে, “লোকটা হয়তো বিপদে আছে, আমি একটু সময় দিই।” কিন্তু এই ‘ভদ্রতা’ অনেক সময়েই বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই সুযোগ নিয়ে আর টাকা ফেরত দেয় না।
বাস্তব উদাহরণ:
রাজশাহীর শিরিন আক্তার তার এক বান্ধবীকে ১ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন মেয়ের চিকিৎসার জন্য। তিনি ভাবলেন, “বান্ধবীর বিপদে সাহায্য করলাম, নিশ্চয়ই ফেরত দেবে।” কিন্তু ২ বছর কেটে গেলেও টাকা ফেরত আসেনি। মামলা তো দূরের কথা, আজও তিনি টাকাটা চাইতেও লজ্জা পান।
তাহলে করণীয় কী?
প্রথমেই প্রমাণ রাখুন: টাকা লেনদেনের সময় লিখিত চুক্তি, রসিদ, মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক ট্রান্সফারের কাগজ রাখুন। এগুলো ভবিষ্যতে আইনি পদক্ষেপ নিতে সহজ করবে।
আইনি নোটিশ দিন: মামলা করার আগেই একজন উকিলের মাধ্যমে আইনি নোটিশ পাঠানো অনেক সময় সমস্যার সমাধান এনে দেয়।
আলোচনায় বসুন: অনেক সময় খোলামেলা কথা বললেই সমাধান পাওয়া যায়।
আত্মবিশ্বাসী হোন: কারও কাছ থেকে আপনার পাওনা দাবি করা অন্যায় নয়—বরং এটা আপনার অধিকার।
মামলার ভয় কাটান: বর্তমানে ছোট পাওনার জন্যও সহজ প্রক্রিয়ায় মামলা করার ব্যবস্থা আছে (বিশেষ করে Negotiable Instruments Act অনুযায়ী চেক বাউন্সের ক্ষেত্রে)।
উপসংহার
টাকা ফেরত না পেলে চুপ করে বসে থাকা আসলে এক ধরণের “নীরব ক্ষতি”। এতে যেমন আপনার আর্থিক ক্ষতি হয়, তেমনি সমাজে এক ধরণের ভুল বার্তা যায়—যে কেউ চাইলেই টাকা নিয়ে না ফেরত দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারে। তাই সামাজিক চাপ বা ভুল ধারণার কারণে নীরব না থেকে সচেতন হোন, নিজের অধিকার দাবি করুন।
আপনার নরম মন আর ভদ্রতা যেন আপনার আর্থিক ক্ষতির কারণ না হয়—এইটাই মূল কথা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


