ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, আপনারা বাবা এ যুগের ছেলে মেয়ে । তাই আপনাদের কাছে পিতা,মাতা জাত, পাত, ধর্ম,কর্মের কোন গুরুত্ব নাই। যা মনে আসে, যা ভালো মনে হয় তাই করেন। কিন্তু বাবা আমাদের কাছে জাত পাত ধর্ম কর্মের গুরুত্ব অনেক। আমাদের সমাজ নিয়ে চলতে হয়। দশ জনের সঙ্গে ওঠাবসা করতে হয়৷
হুগলির বিখ্যাত রায় পরিবারের নাম শুনেনি একসময় বাংলাদেশে এমন লোক খুব কম ছিলো । ময়মনসিংহের ত্রিশালে এখনো আমাদের জায়গির রয়েছে। আমাদের ভয়ে একসময় বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেতো । দেশের ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নিয়েছে আমাদের "রায়" পরিবার ।
সেই পরিবারের একমাত্র কন্যা কি না বিবাহ করছে ভিন্ন ধর্মে? তা ও আবার এক মুসলিম কে? হায় ভগবান এ যে সহ্য হবার নয় ।
ভদ্রলোক একটু থেমে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবার বললেন, "বাবা তুমি অনুরাধা মা মনিকে মুক্তি দাও । বিনিময়ে যা চাইবে তাই দেবো । নগদ টাকা, বাড়ি, গাড়ি যা চাইবে ।" লোকেটা হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমিতে চলে এলো।
সামান্য অর্থ বাডি গাড়ীর লোভে অনুরাধকে ছেড়ে দিবো? এ কথা বলার সাহস পেলো কোথায়? আবল তাবল আর সহ্য হচ্ছে না। লোকটার কথায় আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছে । তবুও রাগকে যথাসম্ভব সংবরণ করে দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, "আপনি ভুল জায়গায় চলে এসেছেন । আপনি এখন আসতে পারেন । প্লিজ চলে যান । যেহেতু আপনি অনু'র জেঠু পরিচয় দিয়েছেন সেহেতু যথাযথ সম্মান দিয়ে বলছি, "এসব প্রস্তাব নিয়ে আর কোনদিন আমার সামনে আসবেন না। এর পরেও এ বিষয় নিয়ে আমার কাছে এলে সেটা কারো জন্যই মঙ্গল হবে না ।"
আমার কথায় লোকটার চোখ দু'টো তীব্র ঘেন্নায় দপ করে জ্বলে উঠলো । কিন্তু পরক্ষণেই তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন , "দেখুন বাবা ভুল করবেন না । আপনি জানেন না, আপনি কত বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছেন । সাত দিন সময় দিলাম, হয় আমার কথা শুনুন,না হয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিন।"
লোকটার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। সে আসলে কি বলতে চাইছে।
এ তো দেখছি সরাসরি হুমকি। যেন তার বাপের রাজত্ব চলছে তিনি হুকুম করবেন আর আমি তা মেনে নিবো।
এবার আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো। নিজেকে কন্ট্রোল করলে পারছি না। ইচ্ছে করছে ঘাড়ে ধরে অফিস থেকে বের করে দিতে৷ কিন্তু শত হলেও তো তিনি আমার চাচা শশুড়। বাড়ির বড় কুটুম, তাই অনেক কষ্টে নিজেকে সামনে নিয়ে বললাম, আপনি এখন আসুন প্লিজ।
এ নিয়ে আপনার সাথে কোন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। অনুগ্রহ করে বিদায় হন। লোকটা আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আমি ইশারায় তাকে কথা বলতে না করে বের হবার দরজাটা খুলে দিলাম। লোকটা এবার উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললেন,ঠিক আছে তাহলে। মনে রেখো ছোকরা আমি দেখে নিবো তোমায়৷ এরপর তিনি আর দাড়ালেন না দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলেন৷
একজন অজানা,অচেনা লোক হুট করে অফিসে এসে গায়েপড়ে প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে গেলো আর আমি তাকে কিছুই বললাম না । লোকটা চলে যাবার পর শরীরের ভেতর রাগ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো । কোন কাজেই মনোযোগ দিতে পারলাম না। সারাদিন গজগজ করতে লাগলাম ।
এর মধ্যে অফিসে চাউর হয়ে গেছে আমার বিবাহের কথা । কলিগরা একে একে সবাই এসে অভিনন্দন জানাচ্ছে, খেতে চাচ্ছে । কবে অনুষ্ঠান করবো সে সব জানতে চাইছে । বউ এর বাড়ি কোথায়? এরেঞ্জ মেরেজ নাকি লাভ ম্যারেজ ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্নে আমায় জর্জরিত করে মজা করছে৷
দুপুর নাগাদ সিইও স্যার আমার ডেকে নিয়ে বিবাহের বিস্তারিত জানতে চাইলেন । সব খুলে বললাম তাকে । হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছি শুনে তিনি কিছুটা অবাক হলেও কিছু বললেন না । সকালের ঘটনাটা শুনে বললেন, একটু সাবধানে থেকো । অনার কিলিং বলে একটা বিষয় আছে; সেটা জানো তো ?
আমি মাথা নেড়ে "না" বললাম ।
তিনি কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, "অনার কিলিং হচ্ছে, পরিবার বা বংশের সম্মান রক্ষার্থে সংঘটিত খুন বা হত্যাকাণ্ড । যদি কোন পরিবারের কর্তা বা পুরুষ সদস্যরা মনে করে, তাদের বংশের বা পরিবারের কোন মেয়ে নিম্ন বংশে বা ভিন্ন জাতে,ভিন্ন ধর্মে পরিবারের অমতে বিবাহ করেছে । এবং তাতে সমাজে তাদের মর্যাদা হানি হয়েছে । তাহলে সেই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নিজ সমাজ বা গোত্রে সম্মান ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ওই নারী সদস্যকে হত্যা করে । এতে সমাজে তাদের পূর্বের অবস্থান বজায় থাকে মনে করা হয় । এ পর্যন্ত বলে স্যার একটু থেমে আবার বললেন, বাংলাদেশে অবশ্য এসব হয় না ।ভারতে এখনো এমন ঘটনা ঘটে বলে শুনেছি । তবুও বলা তো যায় না, একটু সাবধানে থেকো ।
এরপর স্যার যেটা করলেন তাতে আমি যারপর নাই বিস্মিত হলাম। ম্যানেজারকে ডেকে দশ হাজার টাকা আনতে বললেন । ম্যানেজার একটা খামে করে টাকাটা নিয়ে এলে স্যার সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন , "এই নাও এটা আমার ও কোম্পানির তরফ থেকে তোমাদের জন্য উপহার । তোমাদের জীবন সুন্দর হোক ।"
স্যারের এই ছোট একটি আচরণে তিনি আমার মন জিতে নিলো। বিয়ের এই প্রথম কেউ এতোটা সুন্দর করে অভিনন্দন জানালো। মনটা হঠাৎ করে অসম্ভব ভালো হয়ে গেলো। সেই সাথে স্যারের প্রতি চির কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম ।
আমাকে আবেগে আপ্লুত হতে দেখে , স্যার চেয়ার থেকে উঠে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "তারাতাড়ি একটা পার্টি দাও মিয়া । কতদিন বিরানী খাই না । বিয়ের বিরানীর মজাই আলাদা । এরপর তিনি সিকিউরিটি অফিসারকে ডেকে অফিসের নিরাপত্তা আরো জোরদার করতে বললেন।
এতকিছুর পরেও হুমকি পাওয়ার বিষয়টা মাথা থেকে গেলো না । উলটো সেটা মনের ভেতর এমন একটা চাপ সৃষ্টি করলে যে, কোন কাজই ঠিক মতো করতে পারলাম । সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য অফিসের সামনে দাড়াতে খেয়াল করলাম , আমাদের অফিস বরাবর রাস্তার অপর পাশে দুটো লোক দাড়িয়ে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে । আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে তারা চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ চারিতার ভান করলো । লোক দুটো'কে দেখে মনের ভেতর খটকা লাগলো । অজানা আশংকা জেগে উঠলো। হতে পারে আমি যা ভাবছি তা নয় । হতে পারে এ লোক দুটো এমনিতেই এ দিকে তাকিয়ে ছিলো৷ কিন্তু তবুও ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না ।
কিছুক্ষণ পরেও যখন দেখলাম লোক দু'টো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বারবার আমার দিকেই তাকাচ্ছে তখন আমার ধারনা পাকাপোক্ত হলে ।
আমি তখন চট করে সামনে দিয়ে যাওয়া একটা রিকসায় চড়ে বসলাম । কিছু দূর যাওয়ার পর পেছন ফিরে দেখি লোক দু'টো রাস্তা পাড় হয়ে এ পাশে এসে আমার দিকে তাকিয়ে আ্ছে । এরপর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, অনুরাধার জেঠু সত্যি সত্যি সত্যি আমার পেছনে লোক লাগিয়েছে ।
কাল যদি, লোকগুলো আমাকে ফলো করে বাসায় চলে আসে তাহলে তো ভয়াবহ কান্ড ঘটে যেতে পারে । আমায় না পেয়ে এরা যদি অনুরাধার কোন ক্ষতি করে ফেলে? আবার যদি সত্যিই এরা সাত দিন পর আমাকে হত্যা করে ফেলে । তাহলে? আমি না থাকলে অনুরাধার কি হবে? অনুরাধার অসহায় মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। নিজের নিরাপত্তার জন্য আমি মোটেও চিন্তিত নই । কিন্তু অনুরাধার কিছু হয়ে গেলে তা সহ্য করতে পারবো না ।
ফেরার পথে যাকে দেখছি তাকেই সন্দেহ হচ্ছে । বাসে উঠে মনে হলো বাস শুদ্ধ সব লোক আমাকে ফলো করছে । ভেতরে ভেতরে ক্যামন গুটিয়ে গেলাম।
প্রতিদিন বাস থেকে যেখানে নামি আজ সেখানে না নেমে মহাখালী চলে গেলাম । সেখান থেকে অলিগলি ঘুরে কেউ ফলো করছে না সেটা দেখে নিশ্চিত সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে চোরের মতো বাসায় ফিরলাম।
ফেরার পথে অনেক করে ভেবেছি আজকের ঘটনা অনুরাধা'কে জানাবো না । কিন্তু আমার মুখ গম্ভীর দেখে, অনুরাধা একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো । কতক্ষণ আর বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা যায় ? শেষমেষ পুরো ঘটনা ওকে খুলে বললাম । সব শুনে অনুরাধা প্রথমে আমারই মতো গম্ভীর হয়ে গেলো । তারপর রাগে ফেটে পরে জানালো , "কি নাম, কি নাম বললে? শোন, এই নামে আমার কোন জেঠা নেই । শুধু জেঠা কেন , ত্রিভুবনে আমার কোন আপনজন নেই । বর্তমানে আমিই আমার বংশের সেই একমাত্র প্রাণী । আমি ছাড়া আমার রাত কূলে কেউ নাই। মা,বাবার মৃত্যুর পর আমি এক দূরসম্পর্কের মাসির কাছে মানুষ হয়েছি । মাসির মৃত্যুর পর থেকে আমি সম্পূর্ণ একা।
নিতুন রায় নামে কোন জেঠা নেই আমার ।লোকটা নিশ্চয় অন্যকোন মতলব নিয়ে এসেছিলো। এরপর অনুরাধা কি একটা ভেবে নিয়ে বললো, ময়মনসিংহের ত্রিশালে আমাদের যে পৈত্রিক বাড়ি ও জমিজমা রয়েছে । সেগুলো দেখাশোনা করে আমার এক মামা । সেও আমাদের রক্তের কেউ নন। তিনি আমার ব্যাংক একাউন্টে প্রতিবছর জমিজমা থেকে যে আয় হয় সেই টাকা পাঠান । বাস ! এ টুকুই । এর বেশি আর কারো সাথে আমার কোন সর্ম্পক নেই। এবার তুমিই বলো, হুট করে আজ কোথা থেকে নিতুন রায় নামের এই জেঠু হাজির হলো ?
শোন বাবন, এরপর লোকটা এলে, তাকে বেধে রেখে সোজা পুলিশে খবর দেবে । বুঝতে পেরেছো?
আমি কি বলবো বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে অনুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম মেয়েটি এতো সুন্দর কেন? ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে আদর করি। আমার মনোভাব বুঝতে পেরেই যেনো অনু আমায় জোর করে ওয়াশ রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,তুমি গোসল করে এসো, আমি নাস্তা রেডি করছি। আজ তোমাকে গরম গরম পাকোড়া খাওয়াবো।
চলবে ........
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫৪