somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাখাওয়াত হোসেন  বাবন
ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে "আমার কবিতা নামে" আমি ব্লগিং করি মূলত নিজের ভেতরে জেগে উঠা ব্যর্থতা গুলোকে ঢেকে রাখার জন্য । দুনীতিবাজ, হারামখোর ও ধর্ম ব্যবসায়িদের অপছন্দ করি ।

চেরাগ আলী ও কালো যাদু - ৪র্থ পর্ব (চেরাগ আলী সিক্যুয়েল)

০৯ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নির্ঘাত যমের মুখ দেখে ফিরে এসে কিছুক্ষণ মন্দিরে ঢোকার পথে বিশাল কাঠের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।  এতোক্ষণ যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিলাম ।  গরুর গাড়িটি অদৃশ্য হয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে বোধ শক্তি  ফিরে পাচ্ছি । তারপরেও  কি করব, কোথায় যাব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

চাইলে লোকটার কথামতো মন্দিরের চাতালে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারি। আশপাশে তাকিয়ে যতটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হলো, একটা বাজারের মধ্যে এসে পড়েছি। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বন্ধ দোকান পাট দেখা যাচ্ছে ।চারপাশের ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে,  রাত বেশ গভীর ।  

আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে চোখে পড়ছে না । কোথাও লোকজন নেই । রাস্তার দু ধারের দোকানের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কাঠের ঝাঁপগুলো যেন আমার দিকে তাকিয়ে উপহাস করে ভেংচি কাটছে।

গরুর গাড়িতে উঠার পর সম্ভবত ঘণ্টা খানেক সময় পেরিয়ে গেছে  । সে অনুযায়ী এখন বড়জোর সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা বাজার কথা। সন্ধ্যার আলো সবে মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকার নামছে। গ্রাম-গঞ্জের দোকানপাট একটু আগেভাগেই বন্ধ হয় ঠিক, কিন্তু তাই বলে সাতটা বা সাড়ে সাতটার মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যাবে—এটা ভাবা যায় না।
কোথাও যেন এক সূক্ষ্ম অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে, যা স্পষ্ট করে ধরতে পারছি না। রহস্যটা বুঝতে না পারার অস্থিরতায় মনের ভেতর অদ্ভুত এক অস্বস্তি দানা বাঁধতে লাগল। সাধু সন্যাসীদের অল্প বিচলিত হতে হয় না । কিন্তু ইদানিং অল্পতেই বিচলিত হয়ে উঠছি । নিজের উপর ঠিক নিয়ন্ত্রন রাখতে পারছি না । 

মন্দিরে বন্ধ দরজার দু পাল্লার দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ডান পাশে ছোট একটা পকেট দরজা রয়েছে । অগত্যা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে হাত ছোঁয়াতেই সেটা খুলে গেলো । 

মন্দিরের ভেতরে পা রাখতেই আবছা আলোয় চোখে পড়ল এক বিশাল প্রাঙ্গণ। গেট পেরিয়েই দু’পাশে ছোট ছোট ছ’টি দোচালা ঘর সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাঙ্গণের মাঝ দিয়ে ইট বিছানো সরু পথটি সোজা গিয়ে মিশেছে ইট বাঁধানো মন্দিরের উঁচু চাতালের সিঁড়িতে। গেট আর মন্দিরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বিশাল গাছ, যার চারপাশ ইট দিয়ে গোল করে বাঁধানো।  চাতালের ঠিক মাঝমাঝি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কালী মন্দির। শিক দেওয়া মন্দিরের বন্ধ দুয়ারটি যেন হঠাৎ আগন্তুকের উপস্থিতি টের পেয়ে নিস্প্রভ দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। দোচালা ঘরগুলোর দরজাগুলো বন্ধ । চারপাশের নিস্তব্ধ, নীরবতায় বুকের ভেতরটা ক্যামন জানি টিপটিপ করতে লাগলো ।  ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম, মন্দিরের ভেতরে কেউ নেই। সম্ভবত সন্ধ্যার আরতি শেষ করে পূজারীরা চলে গেছেন। তারপরেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাঁক দিলাম, “ভেতরে কেউ কি আছেন?” কোনো সাড়া পেলাম না, শুধু নীরবতাই তাতে যেনো আরও গভীর হয়ে উঠল। অনেক সময় মন্দিরের সেবকেরা রাতের বেলাতেও মন্দিরে অবস্থান করে। কেউ ভেতরে থেকে থাকলে আমার ডাক শুনে তার বের হয়ে আসার কথা। কিন্তু কেউ বের হয়ে এলো না দেখে নিশ্চিত হলাম ভেতরে কেউ নেই । মন্দিরের চাতালের দিকে লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। মন্দিরে যাওয়ার পথে বা'পাশের মাঝামাঝি দানবের মতো দাড়িয়ে থাকা গাছটি চিনতে পারলাম । এটি একটি  নিম গাছ । অন্ধকারে জবুথুবু হয়ে নি:সঙ্গ নিথর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।  গাছটির পাশেই  যে দোচালা ঘরটি রয়েছে তার সামনের অংশটি বেশ উঁচু করে বাঁধানো । মনে হলো এখানে শুয়ে্ই রাতটি কাটিয়ে দেয়া যাবে ।

ভিন্ন ধর্মের মানুষ আমি। মন্দিরে প্রবেশ করে যত্রতত্র ঘোরাফেরা করা ঠিক হবে না। তবে দীর্ঘদিন বাড়ি ছেড়ে পথে প্রান্তরে ঘুরে যে বেশভূষা হয়েছে তাতে আমি যে, কোন ধর্মের তা দেখে বোঝা কঠিন। মুখের ওপর ঝুলে থাকা দীর্ঘ দাড়ি , কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা বাবরি চুল  সন্ন্যাসী ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে হলে অতি পাকা জহরীকেও দশবার চিন্তা করতে হবে। 

তারপরেও সর্তক থাকছি কারণ, অনেক পূজারী আছে যারা জাত,পাত,ধর্ম নিয়ে খুঁতখুঁতানিতে ভোগে । সামান্য একটু বাহানা পেলে তা নিয়ে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান মজবুদ করে সবকিছু পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলে । 

তারচেয়ে এ ঘরটির বারা্ন্দার ওই উচু স্থানটুকুতে রাতটা কাটিয়ে দিলে কেউ কিছু বলবে বলে মনে হয় না ।  তারপরেও কৌহুতল নিবারনের জন্য সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের চাতাল ধরে চারপাশ একবার দেখে এসে দাঁড়ালাম মন্দিরের মুল দরজার সামনে ।

পুরোনো দিনের শিল কাঠের ভারী দরজা । দরজার পাল্লার জায়গায় কাঠের পরিবর্তে মোটা লোহার শিক দেওয়া ।  দু হাত প্রশস্ত করে আধ হাত লম্বা জিহ্বা বের করে মন্দিরের বেদীতে দাড়িয়ে আছেন কালী দেবী। রাত্রির এ নির্জনতায় মূর্তিটিকে এতো বেশি জীবন্ত মনে হচ্ছে যে, দেখে মনে হচ্ছে, দেবী কালী যেন কৌতূহল দৃপ্ত দৃষ্টিতে আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন । সদা রুষ্ট দেবীর চোখে মুখে প্রশান্তির ছায়া । 

মন্দিরের চাতাল থেকে নেমে এসে নিমগাছের বাঁধানো দেয়ালের উপরের কিছুটা অংশ পরিষ্কার করে ঝুলিটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। সামান্য ক্ষুধা পেয়েছে, পেটের ভেতরটা চিনচিন করছে। ঝুলির ভেতরে এখনো কিছু চিঁড়া আর গুড় পড়ে আছে। ইচ্ছে করলে তা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করা যায়, কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে করছে না। তাই ক্ষুধাকে আমলে না নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, বলতে পারবো না।
হঠাৎ ক্ষীণ হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, একসঙ্গে অনেক নারী ফিসফিসে কণ্ঠে কথা বলছে আর মুখ টিপে হাসছে। তাদের সেই উচ্ছ্বাস স্বপ্ন মধুর হিল্লোল হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি চোখ খুলে তাকাতেই সব বন্ধ হয়ে গেলো । শুয়ে থেকে মনে হল, হয়তো স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু না, না এ যে স্বপ্ন নয়। চোখ খুলে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পরিস্কার খোলা আকাশ দেখতে পাচ্ছি । শুভ্র মেঘের দল পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভেসে যাচ্ছে । তাদের ফাকে বিশাল চাঁদ ঠায় দাড়িয়ে আছে । জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছে দশ দিগন্ত । কোথাও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লো না ।  তারপরেও আমি কান পেতে রইলাম । কিছুক্ষণ সব নীরব নিথর । চোখটা লেগে এসেছিলো এমন সময় আবারো শোনা গেলো সেই খিলখিলে হাসির শব্দ । এবার হাসির শব্দ আর এক জায়গায় স্থির নেই । যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, আবার মুহুর্মুহু কলতানে ফিরে আসছে। মনে হলো ভ্রম হচ্ছে, তাড়াতাড়ি উঠে বসে চারদিকে তাকালাম। তবে কাউকে দেখতে পেলাম না । 

মন্দিরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, শিক দেওয়া দরজাটা একই ভাবে বন্ধ। চাঁদের আলোয় মন্দিরের প্রান্তর দিনের আলোর মতো ফকফক করছে । চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে আবার মন্দিরের দরজার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠলো। পরিষ্কার দেখতে পেলাম আবছা এক কালো ছায়া দাড়িয়ে আছে, মন্দিরের ভেতর দরজার আড়ালে । সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে পুরো শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো।

নিজের অজান্তেই অস্পূট শব্দে জিজ্ঞাসা করলাম, "কে , কে ওখানে ?"
কোন উত্তর এল না । সবকিছু একেবারে নীরব,নিস্তব্ধ । কোথাও প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই । একটু আগে ভেসে আসা হাসির শব্দও বন্ধ হয়ে গেছে ।

কিংকর্তব্যবিমুঢ হয়ে আমি বসে রইলাম । অথচ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ছায়া মূর্তিটি তখনো দরজার আড়ালে দাড়িয়ে ঠায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে । বিষয়টা খেয়াল করে আবারো জিজ্ঞাসা করলাম , "কে;কে ওখানে ?"

পরিষ্কার দেখতে পেলাম ছায়া মুতিটি চট করে সরে গেলো । চোখের ভুল কিনা বুঝতে পারছি না । তবে; টের পেলাম ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে । মনে হলো, এক ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যাই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম, পরো শরীর যেন মাটির সঙ্গে চুম্বকের মতো আটকে আছে। এমন পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখা প্রয়োজন। নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে ভালো করে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম, তারপর ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখতে হবে ভেতরে কে আছে। হতে পারে মন্দিরে চোর ঢুকেছে। অনর্থ হওয়ার আগেই মন্দিরটিকে বাঁচাতে হবে।

সিড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে মন্দিরের দুয়ারের সামনে দাঁড়াতেই আবার সেই হাসির শব্দ শোনা গেল, এবার আরও স্পষ্ট। মনে হলো, শব্দটা ঠিক আমার পেছন থেকে আসছে । চট করে ঘুরে তাকালাম পেছনে, সঙ্গে সঙ্গে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার পুরো শরীর জমে গেলো । 

দেখতে পেলাম তিন, চারটি মেয়ে নিম গাছের চত্বরটি ঘিরে একজন আরেক জনের পিছু পিছু  ছুটোছুটি করছে । গাছটিকে ঘিরে তারা গোল হয়ে ঘুরছে । খেলছে,হাসছে আর অদ্ভুত সুরে গান গাইছে। পুরো মন্দির চত্বর যেন মুখরিত হয়ে উঠেছে তাদের সেই উচ্ছ্বাসিত কোলাহলে। মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে আমি অপলক দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম। তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রতিটি নড়াচড়া ,পায়ে বাঁধা নূপুরের ছন্দ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বিচিত্র সুরের এক সঙ্গীত রচনা করছে।  নিম গাছের পাতার ফাঁক গলে চাঁদের আলোর কিরণ তাদের স্নিগ্ধ মুখের ওপর পড়ে যেন এক অনন্ত মায়ার আবেশ সৃষ্টি করেছে। 

অপ্সরাদের পায়ের ছন্দ, গানের সুর, আর হাসির আওয়াজে পুরো পরিবেশটা চোখের সামনে মোহময় হয়ে উঠেছে। নিজের কাছে মনে হলো হুট করে আমি যেন কোনো এক স্বপ্ন পুরীতে এসে পড়েছি ।  আমারও মন চাইছে ছুটে গিয়ে তাদের সেই খুনসুটির অবগাহনে ভেসে যেতে। 

বিমোহিত হয়ে আমি যখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি ঠিক তখন হঠাৎ এক অপ্সরার সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেলো । এতক্ষন তারা যেন আমায় আমার উপস্থিতি টের পায়নি । হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে থমকে গেলো সবাই। স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলো ।

তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো আমার দিকে । সিঁড়ির কাছাকাছি এসে নারীটি আমার চোখে চোখ রেখে ঈষৎ করে হেসে উঠলো । সে হাসিতে এমন মাধুর্য ছিল যে, তা যেন হাজারো ফুলের ফুলঝুরি হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে । তার নীলাভ চোখের গভীরে এমনি মাদকতা ছিল যে, বুকের কোণে অদ্ভুত এক টান অনুভব করলাম। জড় বস্তুর ন্যায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইলাম, আর ঠিক যেন সেই মুহূর্তে বন্দি হয়ে গেলাম সুগভীর কোন চক্রান্তের বেড়াজালে । 

হঠাৎ করে বিশ্ব চরাচরের সবকিছু যেনো থেমে গেল। নীরব নিথর প্রকৃতির মাঝে আমরা দাড়িয়ে রইলাম মুখোমুখি। মুহূর্ত কাল বয়ে যেতে লাগলো । তারপর মেয়েগুলো ধীরে ধীরে আরো কাছে এগিয়ে এলো। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে নূপুরের ছনছন শব্দে পুরো প্রকৃতি কেপে কেপে উঠতে লাগলো । যে মেয়েটির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হয়েছিলো , সে এবার সিঁড়ির সামনে এসে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করল, "তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?"

তার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত এক সুর, যা শুনে আমার রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। 

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেয়েটি হেসে উঠে বলল, " ভয় পেও না । ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করব না। শুধু একবার বলো, তুমি কি আমাদের সাথে এই চিরন্তন খেলায় সামিল হতে এসেছ?"

আমি তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন আর উত্তর ছোটাছুটি করলেও মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের হচ্ছে না। মেয়েটি এবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "এসো, আমার সাথে। চলো, তোমাকে নিয়ে যাই আমাদের রাজ্যে।" তার পেছনে  ততক্ষণে আরেকটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের সকলের পড়নে শাড়ী জাতীয় পোষাক । পুরো শরীর নানা বাহারি অলংকারে জ্বলমল করছে । অন্য দুটি মেয়ে  তখনো ও  দূরে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তাদের চোখে মুখে খেলা করছে এক গভীর রহস্যময় টান ।  যা আমাকে স্থির হয়ে থাকতে দিচ্ছে না । বারবার ছুটে গিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে । 

আমিও চেরাগ আলী । কুকুর ওয়ালী দেবীর আশীর্বাদে আমিও তখন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছি । ছলনার এসব মোহমায়ায় সহজে জড়াবার পাত্র নই । ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে তাই জিজ্ঞাসা করলাম, "তোমরা কারা? এখানে কি চাও?"

হঠাৎ আমার মুখে প্রশ্ন শুনে কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে দুটি  হাওয়ায় তাদের  শাড়ির আঁচল ভাসিয়ে একই সঙ্গে বলে উঠলো, "আমরা কারা?" তারপর রাত্রির আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে খিল খিল করে হেসে উঠলো । 

সে হাসিতে এমন ভয়ানক কিছু ছিল,  মনে হলো পুরো মন্দির চত্বরটি তাতে থরথর করে কেঁপে উঠল। গাছের পাতা নড়তে শুরু করল, রাত হওয়া স্বত্বেও যেন হাজারো পাখিরা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল, দূর অজানায় । চাঁদ হঠাৎ করে আশ্রয় নিলো মেঘের আড়ালে । ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো চারপাশে । 

একসময় হাসি থামিয়ে প্রথম মেয়েটি মৃদু কণ্ঠে বলল, "তুমি আমাদের কথা জানো না । তাই অহেতুক ভয় পাচ্ছ। ভয় পেও না। আমরা শুধু খেলি—চিরন্তন এক খেলা। এ খেলার শুধু শুরু আছে , শেষ নেই । তাকাও আমার চোখের দিকে ।  ভয় পেও না । এসো , এসো আমাদের সাথে যোগ দাও । চির যৌবন সুধা পান করে অমর হয়ে যাও তুমি ।" সে কণ্ঠে এমন এক আকর্ষণ ছিল যে, ধীরে ধীরে আমার সমস্ত ভয়, সংশয় মিলিয়ে যেতে লাগল। মেয়েটির চোখে চোখ রাখতেই যেন অনির্বচনীয় এক ঘোরে তলিয়ে যেতে লাগলাম। তার গভীর, চঞ্চল দৃষ্টির মধ্যে ছিল এমন এক অদ্ভুত মায়া, যা আমায় প্রশ্নহীনভাবে তার কাছে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো । 

ঠিক তখন পেছন দাড়িয়ে থাকা দ্বিতীয়  রমনীটি বলে উঠল, "তুমি কি জানো, যারা আমাদের খেলার সঙ্গী হয়, তারা আর কখনো তাদের আগের জায়গায় ফিরতে পারে না?" তার কণ্ঠে ছিল বীণার মতো মধুর সুর অথচ তাতে লুকিয়ে ছিল  নিঃশব্দ এক হুমকি বা সর্তকতা।

আমি দ্রুত তার দিকে তাকালাম। ঠিক তখনি মেয়েটির মুখে ফুটে উঠলে সূক্ষ্ণ এক ভয়ানক হাসি। তার চোখের তারার জলমলে আলো মিলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠলো কর্কশ রুক্ষতা ।  মোহ ভঙ্গ হলো আমার । সঙ্গে সঙ্গে সর্তক হয়ে উঠলাম । ঠিক তখনি মনে হলো , কোথায় যেনো শুনেছি এদের কথা । 

সাহস করে প্রশ্ন করলাম, " তোমাদের এ খেলার শেষে কী ঘটে? কেন যারা এতে যোগ দেয় তারা আর ফিরে আসতে পারে না ?" 

সেই প্রথম মেয়েটি এবার  আমার দিকে আবারো হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল, "এসো , এসো আমার সাথে । ভয় নেই , কথা দিচ্ছি কোন ক্ষতি হবে না তোমার ।" 

সে অহব্বাহ উপেক্ষা করে এমন মনের জোড় কার আছে । আমারও কি যেন হলো জানি না । আমি মন্দরের চাতাল থেকে নেমে গিয়ে দাড়ালাম তার সামনে । 

মেয়ে দুটি তাতে খুশি হয়ে উঠলো । অন্য মেয়ে দুটিও ছুটে এলো । তারপর সকলে মিলে আমায় ঘিরে গোল হয়ে হাঁটতে শুরু করল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ মাটিতে যেন এক অশরীরী ধ্বনি সৃষ্টি করছিল।

কানের কাছে মুখে এনে একজন মৃদুস্বরে বলল, "এই খেলা অনন্ত, এর কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। এখানে যারা আসে, তারা নিজের ইচ্ছায় আসে। ফিরতে চাইলেও আর ফিরে যেতে পারে না।"

তার কথা শুনে  শরীর আবারো শিউরে উঠল। নিম গাছের ডালপালাগুলো যেন ঘন হয়ে আমার দিকে ঝুঁকে আসছে। পাতাগুলো হালকা বাতাসে হেলে দুলে এমন এক সুর তৈরি করছিল, তাতে আমার মনের অস্বস্তিটা  বাড়িয়ে তুলছিল।

আমি বললাম, "কিন্তু আমি তো এখানে আমার ইচ্ছায় আসিনি। আমি কিছুই জানি না তোমাদের সর্ম্পকে । আমাকে যেতে দাও। আমি যাবো না তোমাদের সাথে ।  "

প্রথম মেয়েটি এবার হেসে বলল, "তুমি কি সত্যিই জানো না তুমি কেন এখানে এসেছ? এই মন্দির, এই নিম গাছের ছায়া, আমাদের গান—এসব কি তোমাকে এখানে টেনে আনেনি? "

তার কথায় আমি আবারো বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম,  আমি কেন এখানে এসেছি। কিন্তু যত ভাবি, ততই যেন স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়। কিছুই মনে করতে পারছি না। এবার দ্বিতীয় মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, "তোমার দেখি সত্যি সত্যি কিছু মনে নেই। শোন; এটাই আমাদের খেলার নিয়ম। তোমার সব স্মৃতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। তার বদলে নতুন স্মৃতি,চীর যৌবন নিয়ে হয়ে উঠবে আমাদেরই একজন । "

তাদের কথায় আমি ভয় আর রাগে প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে বললাম, " না, না , না । আমি তোমাদের সঙ্গে খেলব না! আমাকে যেতে দাও!" 

আমার চিৎকার বা প্রতিবাদে তারা মোটেও বিচলিত হলো না । উল্টো একসঙ্গে হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দে যেন চারপাশ আবারো  অন্ধকার হয়ে গেল।  হাসির শব্দ মিলিয়ে যেতেই চারদিকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নেমে এলো।  হুট করেই যেনো যাবনিকা ঘটলো সব কিছুর । 

ঠিক সেই মুহূর্তে টের পেলাম, আমার ভেতর অন্য এক শক্তি জেগে উঠছে।  নিজের মনকে শক্ত করে চিৎকার করে বললাম, " না; আমি এখানে বন্দি হব না ! আমাকে যেতে দাও! তোমরা পারবে না আমায় আটকে রাখতে । সে শক্তি তোমাদের নেই।  "

আমার কথায় মেয়েগুলো হুট করে থমকে দাঁড়ালো। তাদের হাসি থেমে গেছে । মুহূর্তে নিঃশব্দ স্তব্ধতা নেমে এলো চারপাশে । প্রথম মেয়েটি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, " যেতে চাও ? ঠিক আছে,  একটা সুযোগ তোমাকে দেবো। তবে মনে রেখো, যাবার সময় যদি একবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাও তাহলে  তুমি আর নিজেকে কোনদিন মুক্ত করতে পারবে না।"

আমি আর দেরি করলাম না । মেয়েগুলোর মধ্যে দিয়ে ছুটে গেলাম। তারপর পেছনে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলাম মন্দিরের বন্ধ দরজা লক্ষ্য করে।

মনের মধ্যে তখন একটাই ভয়—যদি ভুল করে পেছন ফিরে তাকাই, তবে আর কখনো ফিরে আসতে পারবো না আমার এ পৃথিবীতে ।

তখনো "হাসির শব্দ, বাতাসে ভেসে বেড়ানো গানের সুর , আনন্দ ও উৎফুল্লের কলতান ছায়ার মতো অনুসরণ করছে আমায়। মনে চারপাশে শত সহস্র অপ্সরা রমণী অপার্থিব মহানন্দে বিহ্বল হয়ে উদ্যম নৃত্যে উজাড় করে দিচ্ছে তাদের যৌবন।" সে নৃত্য দেখার তীব্র বাসনা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ।

প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য এক শক্তি টেনে ধরে রাখতে চাইছে আমায়। কানের কাছে এসে ফিসফিস করে আমার নাম ধরে ডাকছে । আমি কিছুতেই সম্মুখে অগ্রসর হতে পারছি না । চোখ বন্ধ করে এবার তাই কুকুর ওয়ালী দেবীর কথা ভাবতে লাগলাম ।

মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার আয়ত নেত্র যুগল । দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলাম গোলাকৃতি অকৃত্রিম মাধুর্য মিশ্রিত সেই মুখের হাসি । স্ফীত হাসি হেসে তিনি বললেন, "খবরদার চেরাগ, পেছনে ফিরে তাকিও না । ওরা কেউ না । এরা সকলে মিছে, মোহ মায়া । ওরা তোমার জন্য নয় । দ্রুত বের হয়ে যাও এখান থেকে । যাও ...যাও .... এখুনি চলে যাও এখান থেকে। " 

দেবীর কথা শেষ হতেই দ্রুত পৌঁছে গেলাম মন্দিরের দরজার কাছে। মনে কেউ যেন আমায় হাতে তুলে এনে রেখে গেলো । ঠিক তখনি চারপাশের অন্ধকার ভেদ করে আলো দেখা দিল। মেঘের আড়াল হতে বের হয়ে এলো চাঁদ । সকল প্রহেলিকার দেয়াল চিড়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম সেই আলোর দিকে। ঠিক তখনি পেছন থেকে তীক্ষ্ণ আর্তনাদের শব্দ ভেসে এলো । সেই সঙ্গে অনেকগুলো পদ শব্দ ছুটে আসতে লাগলো আমার দিকে ।

চলবে ................। 
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:২০
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×