খুন হয়েছে একজন মানুষ। ছুড়ি মেরে খুন করা হয়েছে তাকে। গভীর রাতে। সম্ভাব্য খুনী?? তার ছেলে!!!
সাক্ষী আছে ২ জন। এক মধ্যবয়সী মহিলা এবং একজন বৃদ্ধ। মহিলা ভিক্টিমের প্রতিবেশী। আর বৃদ্ধ থাকে অকুস্থলেই - খুন হওয়া বাড়ির দোতলায়। প্রথমজন (মহিলা) দাবী করছে সে স্পষ্ট দেখেছে ছেলেটাকে খুন করতে।ছুরি মারতে এবং পালিয়ে যেতে। আর বৃদ্ধ নাকি শুনেছে বাপ বেটার ঝগড়া, ছুড়ি মারার পরে লাশ মাটিতে পড়ার আওয়াজ। বৃদ্ধই লাশ আবিষ্কার করেছে, খুনি পালিয়ে যাবার পর। আছে আরো বেশ কিছু প্রমাণ - সবই আসামীর বিপক্ষে। সবগুলো প্রমাণই আপাত দৃষ্টিতে একেবারেই নিখুঁত।
আসামী কি বলতে চায়?? সে নাকি একেবারেই নির্দোষ। কিচ্ছু জানে না এসবের। হ্যা, বাপের সাথে ঝগড়া তার প্রায়ই হয়, কিন্তু সেদিন হয়নি। সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াবার পর সে রাতে গিয়েছিল সিনেমা দেখতে। দেখা শেষ করে ফিরে এসে দেখে তার নিজের জন্যই অপেক্ষা করছে রিয়েল লাইফ সিনেমা। দুই পুলিশ অপেক্ষা করছে তার বাপের লাশের পাশে!!
অ্যারেস্ট হলো সে। আজব ব্যাপার হলো সে মনেই করতে পারল না কোন সিনেমা সে দেখেছে!! অথচ খুনের সময় সে নাকি সিনেমা হলেই ছিল! তারপরো তার দাবী - সে নির্দোষ!!
শুনানী শেষ মামলার। আসামীর পক্ষে - বিপক্ষে সমস্ত ফ্যাক্টস পর্যালোচনা করা হয়েছে। এখন বাকী রায় দেয়া। আসামীর ভাগ্য এখন নির্ভর করছে জুরীদের রায়ের জন্য। ১২ জন জুরী, দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন। মামলার শুনানী শুনেছেন তাঁরা। এখন সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তাঁরা সবাই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলেন- সিদ্ধান্ত নিবেন। আসামী কি খুনি?? নাকি নির্দোষ? আসামীকে কি বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেবেন তাঁরা নাকি দেবেন বেকসুর খালাস? এই নিয়ে তাঁরা আলোচনা শুরু করলেন। আর এই আলোচনাটাই হচ্ছে আমাদের আজকের আলোচ্য মুভি!! পুরোটা রান টাইম জুড়েই দেখানো হবে একই রুমে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে জুরীদের আলাপ আলোচনা, ক্ষেত্রবিশেষে উত্তেজনা এবং যুক্তি তর্ক!!
এই পর্যন্ত পড়ে মনে হচ্ছে না এটা আর ৮-১০ টা সাধারণ মুভির গল্প?? কি আর হবে এই মুভিতে, জুরিরা রায় দিবেন। আসামী হয় মুক্তি পাবে নয়ত শাস্তি পাবে! এটা নিয়ে আর এত মাতামাতি করার কি আছে?? মানব চরিত্রের সাথেই বা এর সম্পর্ক কোথায়?
না প্রিয় পাঠক, এই মুভি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুভির তালিকায় সবসময়ই প্রথমদিকে থাকে। মুভির নাম? 12 Angry Men
উপরে বর্ণিত পুরো ঘটনাই মুভিতে উঠে এসেছে জুরীদের আলোচনার মাধ্যমে! জুরীরা নিজেদের মত দিচ্ছেন - আসামী দোষী বা নির্দোষ। আর দিচ্ছেন সে সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব যুক্তি। একে একে উন্মোচিত হচ্ছে পুরো ঘটনা। শুধুমাত্র একটা কক্ষে ১২ জন মানুষের কথা বার্তা নিয়ে যে একটা মুভি বানানো যায় তা এই মুভি না দেখলে বিশ্বাস হতে চাইবে না!!
আসুন দেখি কি বিশেষত্ব এই মুভির। মুভির নাম 12 Angry Men - ১২ জন রাগী মানুষ। প্রতিটি মানুষের মতাদর্শ ভিন্ন। ভিন্ন তাঁদের জীবন কাহিনী। প্রত্যেকের আছে সম্পূর্ণ আলাদা প্রেক্ষাপট। দুনিয়াকে তাঁরা দেখেন সেই প্রেক্ষাপটে, নিজের মত করে। মুভির কাহিনী এগিয়েছে এই মানুষগুলোর পারস্পরিক আলোচনাকে কেন্দ্র করে। আর এই আলোচনার মধ্য দিয়েই বেরিয়ে এসেছে একেকজনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের মানুষটি। মানুষের বাইরের আবরণ - বাহ্যিক ব্যবহার তার পরিচয় বহন করে না, শুধুমাত্র তার অস্তিত্ব নিশ্চিত করে। আসল মানুষ লুকিয়ে থাকে মনের গহীন কোনে। সেই মানুষ টি কখনো হয় অমানুষ, কখনো হয় মহামানব। আর এই বোধটিই নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুভিতে।
মুভিতে দেখা দিয়ে যায় প্রখর যুক্তিবোধ সম্পন্ন ন্যায়বান মানুষ। ঠিক তেমনি চোখে পরে কান্ডজ্ঞানহীন অবিবেচককে। দেখতে পাই সন্তানের ভালবাসা বঞ্চিত পিতার বুক ফাটা কান্না অথবা প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের বুদ্ধির ঝিলিক। হুট করে রেগে যাওয়া মানুষ যেমন আছে তেমনি আছে মাথা ঠান্ডা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ। আছে অন্যের প্রতি শদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব আবার অন্যদিকে আছে জ্ঞানপাপী! মুভিতে দেখানো হয়েছে কেমন করে গুটিয়ে থাকা ব্যাক্তিত্ব একটু সাহায্য পেলে জেগে উঠতে পারে, আবার আপাত দৃষ্টিতে ব্যাক্তিত্ববান ও দায়িত্ববান মানুষ কিভাবে রূপান্তরিত হয় নিচুশ্রেণির অমানুষে। প্রতিটি মানুষের আবরণে লুকিয়ে থাকা এই আসল মানুষটি শুধু তখনি বেরিয়ে আসে যখন সে নিজের মত করে সিদ্ধান্ত নেয়। তার মনন, তার মস্তিস্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এই দোষ কিংবা গুন গুলোই । আর এই ব্যাপারটিই অনবদ্য ভাবে ফুটে উঠেছে মুভিটাতে।
মুভিটা আমাদের ভাবতে শিখায়। শিখায় নিজেকে মুল্যায়ন করতে। এই মানবীয় দোষ গুন গুলো তো আমাদেরকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। আসলেই কি আমরা মানবীয় গুন গুলো অর্জন করতে পেরেছি?? নাকি বৃথাই মানবতার ধ্বজা উড়িয়ে যাচ্ছি?
অসাধারণ অভিনয় শৈলী দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। চমৎকৃত হবেন পরিচালনার মুন্সিয়ানা দেখে। ক্যামেরার কাজ অনবদ্য। মুভি দেখে শুধু একটা কথাই আপনার মাথায় আসবে - কে বলে সাদাকালো মুভি বোরিং??
আর আপনি পৌঁছে যাবেন সেই চিরন্তন সিদ্ধান্তে - ভাল মুভি বানাতে বিশাল বাজেট, চোখ ধাঁধানো স্পেশাল ইফেক্ট আর নামিদামি অভিনেতা লাগে না। লাগে একটাই মাত্র জিনিস - মেধা এবং ডেডিকেশন। সেই সাথে লাগে অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং প্রখর বাস্তব জ্ঞান।
তো দেখে ফেলুন মুভিটা আর সাদাকালোয় ব্যবচ্ছেদ করুন মানব চরিত্র!!
আমার রেটিং : ৯.৫/১০
ডাউনলোড লিঙ্কঃ 12 Angry Men (1957)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:২৮