somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: আমি দোলনচাঁপা হয়ে ফুটবো(শেষ পর্ব)

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(৬)
.
পকেটে মোবাইলের শব্দে বর্তমানে ফিরি। কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে টের পাইনি। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখি অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে। গুটি কয়েক আপনজন আমার নম্বরটা জানে। অচেনা ফোন আমি সাধারণত ধরি না। কি মনে করে ধরলাম।
-হ্যালো।
ও পাশ থেকে শুনতে পেলাম,
-আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকু সালাম, কে বলছেন?
-আমি আজাদ।
-কোন আজাদ?
-কলোনির আজাদ।
-আরো দোস্ত। কেমন আছো? আমার নম্বর পেলে কার কাছ থেকে।
-ভালো আছি। তোমার বড় ভাই সোহেলের কাছ থেকে নম্বরটা পেলাম।
-আচ্ছা।
-উনার কাছেই শুনলাম তুমি অসুস্থ। উনার কাছ থেকেই তোমার হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে তোমার বেডের কাছে অপেক্ষা করছি। তুমি কই?
আমার গলাটা বুজে আসছে, আমি কোন কথা বলতে পারছি না। এখনো বাল্যবন্ধু আমায় মনে রেখেছে।
ও পাশ থেকে আজাদের কথা শুনতে পাচ্ছি,
-দোস্ত, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বলি,
-হু, হূ; আসছি।
ছাদ থেকে দ্রুত নিচে নেমে আসি।
দেখি আমার বেডের কাছে সাদা-কালো চুলের একজন।
ওকে জড়িয়ে ধরি।
ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না আজাদকে।
একটু কপট রাগ দেখিয়ে বলি,
-তুমি এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ কেন? গোঁফ, চুল সব সাদা হয়ে যাচ্ছে।
আজাদ মৃদু হাসে। ঠিক আগের মত। এ হাসি আমার বহু চেনা। তারপর বলে,
--আমার কথা থাক। তুমি দেখছি সেই আগের মতই আছে। চির সবুজ দোলা।
আমি একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
-দোস্ত, বাইরেরটা দেখে ভিতরটা বোঝা যায় না। আমি একিউট লিম্ব ইসকেমিয়ায় আক্রান্ত।
--ওটা আবার কী রোগ?
- মানুষের যেমন হৃদপিন্ডের রক্তনালিতে ব্লক হয়, আমার হয়েছে পায়ের রক্তনালীতে। অপারেশন করার জন্য ভর্তি হয়েছি। পরশু দিন সকালে অপারেশন।
আজাদ চুপ হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি, ও এখনো আগের মত রয়ে গেছে। কম কথা বলে কিন্তু সবকিছু গভীরভাবে উপলব্ধি করে। আমি পরিবেশটা হালকা করার জন্য বলি,
-তোমার কথা বলো? বউ, ছেলে-মেয়ে?
--এক ছেলে।
-তোমার সাথে আমার মিলে গেছে। তবে পার্থক্য একটাই, ওরা আমার সাথে থাকে না।
আজাদের মুখ থেকে হাসিটা উবে গেল। একটা বেদনার দৃষ্টি নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের কেউ কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি মিথ্যে একটা হাই তুলে বললাম,
-আমার ঘুম পাচ্ছে।
আজাদ উঠে দাঁড়াল। আমার বেডের পাশে এসে আমার হাতটা জোরে চেপে ধরল। দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ও ধরা গলায় বলল,
--আমি আসব।
হাত ছেড়ে দিয়ে হন হন করে হাঁটা দিল। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। আমি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলাম।
.
.......................
(৭)
.
হাসপাতালের রাতগুলো দু:সহ মনে হয়। চোখ বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে আছি। আজ ঘুমাতে ভয় করছে। গতরাতে বাবাকে স্বপ্নে দেখেছি। বাবা আমাকে ডাকছে। বাবার মৃত্যুর সময় আমি দেশে ছিলাম না। সৌদি আরবে ছিলাম। বেশ ভাল বেতনের একটা চাকরি করতাম। সাত বছর ছিলাম। মা আমাকে নেশার জগত থেকে না ফেরালে আমার সৌদি আরব যাওয়া হত না। সৌদি আরব থেকে ফিরে মার পছন্দেই নায়লার সাথে বিয়ে।
মা আমাকে নেশার জগত থেকে ফেরাতে কত কষ্ট করেছে? একদিকে প্যারালাইজড বাবার সেবা করেছেন ।
অন্যদিকে বিভিন্ন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জেনেছেন। একদিন বাসায় ফিরে দেখি, মার কোলে একটা এ্যালবাম। আমাদের পারিবারিক অনেক ছবি আছে ওতে। আমাকে কাছে ডাকলেন। এ্যালবাম থেকে আমার কতগুলো ছবি বের করে দেখালেন। তারপর বললেন,
-নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখিস?
আমাকে টেনে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে নিয়ে দাঁড় করালেন।
আমার মুখটা দু’হাতে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
মার কান্না আমাকে নাড়িয়ে দিল।
আমি কাতর গলায় বললাম,
--মা, আমি তোমার সেই আগের দোলন হতে চাই।
মা আমাকে নিয়ে বিছানায় বসায়। তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
-দোলন, বাবা আমার। আমি তোমাকে আজ এক জায়গায় নিয়ে যাব। তুমি যাবে আমার সাথে?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দেই। মা আমাকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
সেখানে চিকিৎসা করে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরি।
পুরনো নেশা জগতের বন্ধুরা প্রায় চেষ্টা করে আমাকে আবার ওদের দলে নিতে। এই সময় পত্রিকায় একটা বিজ্ঞপ্তি দেখে সৌদি আরবে চাকরির জন্য আবেদন করি। মার কাছে আমার অনেক ঋণ।
.
(৮)
.
নায়লার সাথে বিয়ের পর চমৎকার সময় কাটছিল। একটু বেশি বয়সে বিয়ে। তাই মা চাইছিলেন আমরা সন্তান নেই। সৌদি রিয়েল খরচ করে কক্সবাজার, ব্যাংকক ঘুরে এলাম নায়লাকে নিয়ে। কী মধুর সময় কেটেছে দুজনের। বছর ঘুরতেই নায়লার কোল আলো করে এলো আকাশ। সংসারে খরচ বাড়ছে। আমি ব্যবসার চেষ্টা করি।
আমার রাগটা অত্যন্ত বেশি। গোয়ার গোবিন্দ বলতে যা বোঝায়, আমি তাই। ব্যবসার জন্য চাই চিকন বুদ্ধি।
বছর খানেক ব্যবসার চেষ্টা করলাম। অনেক টাকার ক্ষতি হলো। বাসায় ফিরি রাত করে। নায়লা অভিমান করে। আমি নিজের ব্যর্থতার গণ্ডিতে ঘুরপাক খেতে থাকি। এদিকে নেশার জগতের অনেক পুরনো বন্ধুর সাথে আবার নতুন করে যোগাযোগ হয়। ক্যারিয়ারটাকে ঠিক মত গড়তে না পেরে আবার চোরাবালিতে ডুবতে থাকি
– আস্তে, আস্তে। নায়লা যখন সর্বনাশটা টের পায়, তত দিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। মা চেষ্টা করেছিল ডিভোর্সটা ঠেকাতে। কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁদের মেয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মেয়েকে আমার থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেন। আমি তাদের দোষ দেই না। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাই নি।
.
..............................
(৯)
.
আগামীকাল আমার অপারেশন। প্রায় ষোল বছর আগে হার্টের আর একটা অপারেশন হয়েছিল আমার। হার্টে ব্লক ধরা পড়েছিল। বয়স বেড়েছে অনেক। তাই এবার ঝুঁকিটাও বেশি। আমি অবশ্য অপারেশনটা কাল করাতে চাই নি। কারণ কাল একটা বিশেষ দিন। সোহেল বোধ হয় ভুলে গেছে। তাই কালকের দিনে অপারেশনটা করাতে রাজি হয়েছে। মাকে এই অপারেশনের কথা জানাতে আমি সোহেলকে নিষেধ করেছি। স্বামীর সেবা করে, নেশাখোর ছেলের জন্য দুশ্চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত উনি নিজেই উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র সহ নানা রোগে জর্জরিত।
কুমিল্লা শহরে শ্বশুরের বিশাল জায়গার খোলামেলা পুকুর বেষ্টিত বাড়িতে উনি থাকেন। আমিও মার সাথেই থাকি। সোহেলের ঢাকার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি – এই বলে ঢাকা আসা।
একজন আমাকে কাল মিস করবে। আমার ফেসবুকে তার পাঠানো জন্মদিনের শুভেচ্ছা কি আমি দেখতে পাব?

আমার ফেসবুক এ্যাকাউন্টটা খুলেছি শুধু তার শুভেচ্ছা পাওয়ার জন্য। এ পৃথিবীতে আপন বলতে তো সেই। আমি যদি মরে যাই? ওর জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না। আকাশ-আকাশ বলে জোরে জোরে ডাকতে ইচ্ছে করছে। মার জন্যও মনটা খারাপ লাগছে। মাকে অপারেশনের কথাটা না জানানো ঠিক হয় নি।
.
(১০)
.
সকালের নাস্তা করে ছাদে গেলাম। সকালে সোনা রোদে শিশু পার্কটা হাসছে। আমার ছেলে আকাশ এখানে এলে খুব খুশি হতো। বুক ভরে বাতাস নিলাম। টিএসসির দিকে তাকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিগুলো মন পড়ছে। এতো সুন্দর রৌদ্রময় সকালে আমার মনে ব্যথার পাহাড়। মাকে কিছু একটা লিখে যেতে চাই – যদি মরে যাই।
লেখাটা আজাদকে দিয়ে যেতে চাই। ও মার কাছে পৌঁছে দিবে। অস্থির মন । কী লিখবো ভেবে পাচ্ছি না। ছাদের উপর উবু হয়ে বসে খাতায় লিখছি:
মা,
আমার আকাশকে তুমি দেখ। আমি ওর জন্য কিছুই করে যেতে পারলাম না।
কুমিল্লায় বাবার কবরের পাশে আমাকে শুইয়ে দিও। কবরের পাশে একটা দোলনচাঁপা গাছ লাগিয়ো। আমি দোলনচাঁপা হয়ে ফুটবো।
-তোমার দোলন।
লিখতে লিখতে কখন চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে টের পাই নি। মা লেখাটা চোখের জলে লেপ্টে গেছে। আর একটা চিরকুট লিখবো? না থাক।
.
মো. শামছুল ইসলাম

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৩৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×