প্রজন্মান্তর
১৫ ই মার্চ, ২০১০ রাত ৯:২৬
ঢাকা এয়ারপোর্ট
আট বছর পর দেশীয় কোলাহলটা ঝাটকা দেয় কানের ভেতর, ঠিক দেশটার গরমের মতই। আরো একবার ভাবে, এই সময়ে দেশে আসাটা কি ঠিক হলো?
এয়ারপর্টের লাগেজ কনভয় বেল্টের সামনে চার বছরের ছোটো মেয়েকে কোলে নিয়ে স্ত্রী আর এমনকি ছেলেটার কাছ থেকেও মানসিক ভাবে হারিয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য হারুন, হারুন রশীদ।
আট বছর আগে শেষবার যখন এসেছিলো, একাই, তখন ফিরে যাওয়াটাও উল্লেখযোগ্য নাটকীয়তা ছাড়াই পার করতে পেরেছিলো। দেশ ছেড়ে যাবার মমতা যতটা না ছিলো, তার চাইতে বেশিই ছিলো নিজের আরামের কর্মক্ষেত্র, স্ত্রী আর ছেলেটার কাছে ফিরে যাবার তাগিদ। তাই বাবার গাম্ভীর্যের আড়ালে স্নেহ ছিলো কিনা সেই খোঁজ নেয়া হয়নি তখন আর। এই জীবনে কোনোদিনই জানা হয়নি, বাবার স্নেহ জিনিষ টা সাথে ছিলো কিনা...অন্য ছেলেপিলেদের বাবা'র সাথে আদিখ্যেতে দেখে আফসোস হবার দিনও তাই খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি...
:...পাপা, আমরা কি এখন বান্লা বলবো?
চশমা ধরে টান দিয়ে জানতে চায় রিমঝিম।
"আহ, মামুনি, পাপার চশমা নিয়ে খেলতে নেই, আম্মু বলেনি?"..বিচ্ছিন্ন হয় হারুনের চিন্তার উল্টোস্রোত ।
:খেলিনিতো, তুমি তো কথা বলো না..পাপা, আমরা এখন বান্লা বলবো সবাই?
:হুম, বাংলা বলোবো।
:সব সময় বলবো?
:হ্যা মা, সবসময়..
:আমরা দেশে যাবার পরও বানলাই বলবো, পাপা?
হোঁচোট খায় হারুন। যখন দেশে থাকতো, তখন, দেশ বললে মানুষ গ্রামের বাড়ীর কথাই বুঝাতো।
তাই দেশে যাওয়ার কথা বলতেই মাথায় এলো গ্রামের বাড়ীর কথাই। কিন্তু মেয়ে নিশ্চই দেশ বলতে বুঝিয়েছে তার নিজের জন্ম নেয়া শহর পাভিয়া'র কথাই, তার বেড়ে উঠা যেই ইটালীতে।
আচ্ছা, তার মেয়ের কি একটাই দেশ? ইটালী? বাবার দেশটা কি তার দেশ নয়? এমনকি ২২ বছর আগের রিমঝিমের মায়ের দেশ টাও তো ছিলো বাংলাদেশ।
সংবিত ফিরে পেতে দেখে, ছেলে শায়েখও উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে, উত্তরটা পাবার আশায়। আগামী দেড়/ দুই মাস প্রতিনিয়ত বাংলা বলতে হবে, এই টেনশনে ছেলেটা কিছু চিন্তিত।
: এইতো, এলো এতক্ষনে, দেখতো, পাশাপাশি তিনটাই তো আমাদের না? বাকী দুটো দেখো ।
যে দেশের যে ভাব। লাগেজ বেল্ট নাকি আবার নষ্ট হয়ে থাকে অপারেটরের অভাবে।
তাড়া লাগায় মিলি, হারুনের স্ত্রী, হারুনকে আপাতত ছেলেমেয়ের প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচিয়ে।
দুই
"হারুন মিয়া, টাকা পয়সা তো আল্লাহ'র রহমতে ভালোই কামাইতাছো, ঠিক না?"
হারুনের গ্রামের বাড়িতে বসে মনে মনে হাসে হারুন। কিছু জিনিষ কখনোই বদলায় না একটা সমাজের মানুষের স্বভাব থেকে। তার নামে মিয়া না থাকলেও, নামের পরে মিয়া বলে সম্বোধন করে মুরুব্বী ভাবটা বুঝাতে পছন্দ করে লোকজন। আর আলোচনার শুরুতেই, বা শুরুর কাছাকাছি সময়েই বিদেশে অবস্থানরত অবস্থায় টাকা উপার্জনের পরিমানটা আন্দাজ পাওয়ার এ্যটেম্পট নেয় লোকজন।
:জ্বি, মোটামুটি। কিন্তু ঐখানেতো খরচও অনেক,ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি।
চাতুরীতে অভ্যস্ত হতে খুব বেশি সময় নেয়না হারুনও, অন্তত তাই সে ভাবে। কোনোভাবেই টাকার অংকটা জানায় না। তার ভদ্রতা বোধ তাকে টাকার অংক জানাতে বাঁধা দেয়, আবার সরাসরি না করারও উপায় নেই এখানে। দেশের মানুষের ভদ্রতা বোধ আবার উল্টো। তারা চাতুরী করতে চায়, কিন্তু কোনো প্রশনের উত্তর পাবেনা, এটাকে অভদ্রতা আর বেয়াদবী ছাড়া কিছু ভাবেনা ।
এমন সময় রিমঝিম বের হয়ে আসে ভেতরের ঘর থেকে, হাতে ইঞ্চিখানেক সাইযের একটা কাঁচা আম, সদ্য বোঁটা ছাড়ানো, এখনো কষ গড়িয়ে পড়ছে
হা হা করে ছুটে গিয়ে মেয়েটার হাত থেকে আমটা নিয়ে নেয় হারুন।
:ছিহ, মামুনি, বলেছিনা, যা খুশি তাই ধরবে না, আগে পাপাকে বা মামুনিকে জিগ্ঞেস করে নেবে?
: বুবুটা দিলো যে, পাপা? আর দেখো পাপা, কি সুন্দর উম..(হাতটা নাকের কাছে নিয়ে আমের লেগে থাকা গন্ধ শুঁকে বলে, গন্ধের বাংলা টা না জানাটা আটকাতে পারেনা, ভাব বিনিময়ের।)
বাবাকেও শোঁকার জন্য ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় রিমঝিম, চোখমুখ অদ্ভুত কিছু আবিষ্কারের আনন্দে চকচকে।
আলগোছে গন্ধটা শুঁকে নেয় হারুনও। সে পুন:আবিষ্কার করে, তার শৈশবের স্মৃতি আরেকবার। অনেক কাল পরিপাটি জীবনে হারিয়ে গিয়েছিলো অগোছালো শৈশব কৈশর।
মিলিও বের হয়ে আসলো উত্তেজিত হয়ে,
: দেখো, ছেলেটার কোনো খবর নাই। মা পর্যন্ত বললো, আকাশের অবস্থা ভালো না, ছেলেটাকে বাইরে না নিতে। কিন্তু নিয়ে গেলো ছেলেটাকে।
হারুন জানে, ছেলেটা তার ছোটো ভাই মহসিনের ছেলেটার সাথে গ্রাম দেখতে বের হয়েছে। আরো জানে, তার মা কেনো সেই সময় যেতে না করেছিলো। এক নাতি আরেক নাতির সাথে বাইরে যাবে, এটাতে মায়ের আপত্তি থাকার কথা না, কিন্তু বিদেশ ফেরৎ ছেলে আর বিশেষত ছেলের বউ এর চাপা রাগের অস্ব:স্থিকর পরিবেশের সম্মুখিন হতে চায়না। এম্নিতেইও প্রথম দিন খাবার নিয়ে জোরাজুরি করা নিয়ে সামান্য মন কষাকষি হয়ে গেছে। অল্প শিক্ষিত মা'ও বুঝে গেছেন, ওরা পরিবার না যতটা, তার চেয়ে বেশি, প্রবাসী আত্মীয়। প্রবাস টা অনেক খানি, আত্মীয়টা খানিক টুকু ইদানীং, এতদিন পর।
:এখন, ঝড় বাতাস শুরু হয়েছে, বাংলাদেশি চৈত্র মাসের ঝড়, এর মাঝে ছেলে কোথায় আছে, খবর নেই।
:হুম, দেখছি..
:তাইলে হারুন, আমরা আজকা উঠি, আকাশে অবস্থা তো ভালো না। তোমার পোলারে দেখলে পাঠাইয়া দিবোনে । আর অতি অবশ্যই বৌরে নিয়া, ছেলেমেয়ে নিয়া আমার বাড়িতে একবেলা.....
কথা শেষ করতে পারেন না, গাঁয়ের চাচা, টার আগেই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠে মিলি,
:পাঠিয়ে দিতে হবেনা চাচা, যদি দেখতে পান, তাহলে আপনাদের বাড়িতে বসিয়ে রাখবেন, ঝড়টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত, প্লীজ।
:ঠিকাছে মা, বসাইয়া রাখবো, ঝড়ে বের হওয়াটা ঠিক হবেনা । আসি তাইলে, আমি তাড়াতাড়ি দেখি...
বের হয়ে গেলেন, গ্রাম সম্পর্কীয় চাচা।
আচ্ছা, শুধু প্রবাসী বলেই কি ছেলটা সম্পর্কে বল্লেন চাচা, ঝড়ে বের হওয়া ঠিক হবেনা? নাইলে বাংলা দেশে, গ্রামে, কে কবে শুনেছে, ঝড়ে ছেলে মানুষ বের হতে পারে না, বা বের হওয়াটা ঠিক হয়না?
আমার ছেলে-মেয়ের কি কোনো শেকড়ই আর নেই এখানে?
আবার হুলুস্থুল শৈশবের আক্রমন ঠেকান হারুন, নিজের ছেলের ফার্মে পোষা নিরাপদ শৈশবটা বাঁচানোর তাগিদে। ছোটো ভাইকে নিয়ে ছোটেন বাইরে। পেছনে পাখির মাকে বসিয়ে রেখে...
আমাদের ছেলেমেয়েদের তো কেবল পাখির মা আর বাবাই, দিদা-দাদুর, ফুফু-চাচুর দিন তো নেই ওদের আধুনিক জীবনে।
তিন
দিদার কোলে বসে রিমঝিম কাঁচা আম নিয়েই পড়ে আছে। বারবার নাকের কাছে নিয়ে আমের গন্ধ নিচ্ছে। একটু কালো আভা এসেছে গায়ে। সারাদিন টইটই করে ঘুরিঘুরির ফলাফল। ছেলেটা শুয়ে আছে পাশেই কাঁথা পায়ের কাছে ফেলে। নরম কাঁথাটা নিয়ে শুরুতে মা আর ছেলে, দুইজনের মনেই কিছুটা আপত্তি ছিলো, কিন্তু হারুনের মায়ের নিশ্চয়তায় সংশয় দূর হয়েছে, মা-ছেলের। ছেলেটা কি জানে, ব্ল্যাংকেটের চাইতে কতটা মায়ায় জড়িয়ে থাকে কাঁথাটা, পরমাত্মীয়ের আদর হয়ে? কাব্য করে নিজের মনে নিজেই হাসে হারুন। একটু জ্বর ভাব শরীরে ছেলেটার। অথচ নাজুক মেয়েটা রাজ হাসের পিছে ছুটে, ঝড়ের পর আমকুরানি দেখে কিংবা সারাদিন দিদার সাথে রান্না ঘরে গিয়েও, গায়ের রং কালো করা ছাড়া অসুস্থতার কোনো লক্ষন দেখায়নি। গ্রামের বাড়ি এত ভালো লেগে যাবে মেয়েটার, বুঝেনি হারুন নিজেও।
চার
যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। এবারও মায়ার বাঁধনে আটকা পড়েনি পুরো পরিবারের কেউই।
:রাতে কি খাবে বাবা?
শান্ত স্বর নিয়ে ঘরে ঢুকেন মা। এতদিন তো ছেলের স্ত্রীর কাছেই খাবারের কথা পাড়তেন মা, আজ তার কাছে জান্তে চাওয়ার কি কারন থাকতে পারে ? দিদার আচল ধরে দাড়িয়ে আছে রিমঝিম, হাতে মনে হচ্ছে পাটিসাপ্টা পিঠা। বাড়িতে পিঠা হচ্ছে তাহলে?
:আপনার বউমাকে জিগ্ঞেস করুন না আম্মা।
:হ্যা, করছি বাবা। কিন্তু তোমার কি কোনো পছন্দ নাই?
আচ্ছা, মা কি আগে "তুমি" বলেই ডাকতেন? আর আমি "আপনি" করে? ভাবে হারুন ।
:আমি কবুতরের ঝোল খাবো দিদা, চালের রুটি দিয়ে।
মাঝখান থেকে আব্দার করে উঠে রিমঝিম, একদম আপন লোকের অধিকার নিয়ে।
:ঠিকাছে দিদা, আজকে রাইতে হবেনে তোমার জন্য কবুতরের ঝোল আর চাইলের রুটি।
অবাক হয় হারুন, এই দুই প্রান্তিক প্রজন্মের যোগাযোগটা কখন হলো, টের পায়নিতো সে। চালের রুটি কিংবা কবুতরের ঝোল হারুনের ছোটবেলার প্রিয় খাবার, আর জিনিষটা কি সেই সম্পর্কে ধারনাই থাকার কথা না রিমঝিমের।
ঝড়ের পরে আমকুড়ানিদের দেখে, কিংবা গতরাতের অনেক রাত্রি জাগা যাত্রা আসর দেখেও যেই ছেলেবেলা ফিরিয়ে আনতে পারছিলোনা হারুন, এখন দেখতে পায়, দুই পপ্রান্তিক প্রজন্মের গল্পে, তার ছেলেবেলা হুটোপুটি করে জায়গা করে নিয়েছে।
বুঝতে পারে, তারা চলে যাবার আগে মা, ছেলে ভালোবাসা আর উপড়ানো শিকড়ের দ্বন্দে, ঠিক মত আদর করেও দিতে পারেনা ছেলেক। খুব ইচ্ছা হয় হারুনের, সেও নির্বিকার আব্দার করে, কোনো কিছুর, কোনো ঝামেলার রান্নার। কিন্তু, কেটে যাওয়া তাল আর জোড়া লাগাতে স্বস্থি হয়না।
খুব আফসোস নিয়ে দেখে, নতুন প্রজন্মের মত আর মিশতে পারে না সে, পুরানো'র সাথে। তবুওতো, শেকড় ছিঁড়ে যায়নি, তার আত্মজের তার শেকড়ের সাথে, এইটুকু স্বান্তনা রইলো।
দুবাই এয়ারপোর্ট, ওয়েটিং লাউঞ্জ
:বাবা, আমরা আবার কবে দেশে ফিরবো?
মাকে না শুনিয়ে ফিশ ফিশেয়ে বলে রিমঝিম।
আবারো কানে লাগে হারুনের। মেয়ে পরিষ্কার বাংলায় বাবা বলছে, আর, বলছে দেশে কবে ফিরবো । এই বেলা দেশ বলতে মেয়ে বাংলাদেশ কেই বুঝালো। এত অল্প সময়ে, জীবনে প্রথমবার দেখা বাবার দেশটা কি তার নিজর করে নিলো?
:ফিরবো, মা। আবার যখন তুমি নিয়ে আসবে, আমাকে।
:আমি নিয়ে আসবো বাবা? তোমাকে?
:হ্যা, মা।
:যখন আমি বড় হবো বাবা, তখন?
:হ্যা, মামুনি, তখন।
:তখন কিনতু বাবা, আমাদের পুকুরে বেশি কাঁদা থাকবে না কিন্তু, হ্যা, বাবা?
:তখন মামুনি তুমি তোমার মত করে নিবে পুকুর, বাড়ি, দেশ। যতটুকু দরকার বদলে নিও। কিন্তু অনেকখানি কিন্তু বদলে দিওনা মা- ছেলেবেলা, শহর-গ্রাম, তোমার দিদা..পুরানো সম্পর্কের টান।
হ্যা সূচক মাথা কাত করলো রিমঝিম। খুব বেশি কিছু বুঝলো কিনা কে জানে। শুধু বুঝলো, বাবা এখন একটু মন খারাপ, একটু একটু ।
পরবর্তী প্রজন্মে সমাপ্য
প্রজন্মান্তর
আজকাল, ইদানীং, স্বপ্ন দেখার বাড়াবাড়ি
স্বপ্ন দেখে আজব শরীর - শরীর, সমুদ্র কিংবা সম্পর্ক পাড়ি..
হঠাৎ তাই মধ্যরাতে অচেনা স্বপ্নের মহামারী।
এইসব কর্পোরেট উঠোনে, ক্রমান্বয়ে ক্রীতদাস মগজে
নির্বিকার বিক্রি করি বাকীসব, শুধু,
আমার পাঁজরে আগলে থাকি আত্মজার স্বপ্নবেলা...আর
আমার আত্মজার চোখে, আমার ছেলেবেলা।
আমরা বন্ধু ব্লগের "স্বপ্নের বাংলাদেশ" ই-বুকের জন্য লেখা।