somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

ঈদ এবং আমাদের নানাবাড়ি ভ্রমণ

২৫ শে এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমাদের বাড়ি থেকে আমাদের নানাবাড়ির দূরত্ব বেশি হওয়ায়, বছরে দুইবার মানে দুই ঈদে আমারা কেবল আমাদের নানাবাড়ি যেতাম। অবশ্য আমাদের পড়া-লেখার জীবন শুরু হবার আগে বছরের প্রায় অনেকটা সময় আমরা নানাবাড়িতেই কাটিয়ে দিতাম; তবে পড়া-লেখার জীবন শুরু হবার পর, বছরের দুই ঈদ-ই ছিলো আমাদের নানাবাড়ি যাবার একমাত্র উছিলা।

আমার মামা-খালা আর নানা-নানি এই ব্যাপারে শতভাগের চেয়েও বেশি নিশ্চিত হয়ে বসে থাকতেন যে, হয় আমরা ঈদের দিন কিংবা ঈদের পরদিন সকালের মধ্যেই তাদের উঠানে পা রাখবো। হতোও তাই, হয় আমরা ঈদের দিন কিংবা ঈদের পরদিন সকালবেলা নানাবাড়ির উঠানে গিয়ে হাজির হতাম।

প্রত্যেক ঈদের সাথে আমাদের নানাবাড়ি যাবার আনন্দ যুক্ত হয়ে, ঈদের আনন্দ কে ঢের থেকে ঢের বাড়িয়ে তুলতো। ঈদের মাঠ থেকে বাড়িতে এসে অপেক্ষা করতে থাকতাম; আব্বা কখন ডেকে বলেন, 'এই তোমরা তৈরি হও, আমরা এখন তোমাদের নানাবাড়ি যাব। যখনই এই শব্দগুচ্ছ কানে আসতো, আমরা ভাইয়েরা হুড়মুড় করে নিজেদের তৈরি করতে শশব্যস্ত হয়ে যেতাম।

এরপর আমরা মুড়ির টিন কিসিমে’র বাসে চড়ে রওনা করতাম নানাবাড়ির পথে। পিচ উঠে যাওয়া গর্তে ভরা রাস্তায়; আমাদের বাস লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলতো আমাদের নিয়ে। আমারা ঝাঁকি খেতে-খেতে আর জানালা দিয়ে গাছেদের ছুটে চলা দেখতে-দেখতে, নানাবাড়ির পথে এগিয়ে চলতাম। একটা সময় আমাদের শরীর বাসের ঝাঁকি নামক অত্যাচারের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করতো, ফলশ্রুতিতে আমরা ওয়াক! ওয়াক! বমি বিসর্জন করে ক্লান্ত হয়ে, বাসের সিটে আমাদের শরীর এলিয়ে দিতাম। একটা সময় আমাদের ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে, বাস নানাবাড়ির স্ট্যান্ডে পৌঁছাতো।

আমরা হেলেদুলে বাস থেকে নেমে; সেই এলাকার জাতীয় যানবাহন ভ্যানগাড়িতে চেপে, পা দুলিয়ে দুলিয়ে নানাবাড়ি গিয়ে পৌঁছাতাম। নানাবাড়িতে পা রাখা মাত্রই কোথা থেকে মৌমাছির ঝাঁকের মতো মামা-খালারা এসে, যে যার মতো আমাদের বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিতেন। এদিকে আমাদের দেখে; তনু-মন অস্থির করে, দিনমান বেড়ার ফাঁকে, কিংবা ধুলোমাখা পথের পানে, আমাদের প্রতীক্ষায় চেয়ে থাকা নানীর আঁখি-যুগল প্রশান্তির পলক ফেলতো।

নানীর হাতের সব রকমের খাবার'ই আমাদের কাছে স্পেশাল ছিলো। আমদের আগমের আগেই নানী মানুষ দিয়ে গাছের কলা পেড়ে মাটির কোলায় জাগিয়ে রাখতেন, সাথে থাকতো নানীর হাতের ভাজা গরম গরম খৈ। নানী মাটির চুলায় খৈ ভাজার আয়োজন করতেন; আর আমরা চুলার পাশে পিঁড়ি পেতে বসে, বিষ্ময় নিয়ে খৈ ভাজা দেখতাম। উনুন জ্বালিয়ে তার উপর মাটির পাত্র চাপিয়ে বালি গরম করা হতো; বালি যথাযথ গরম হয়ে গেলে, সেই বালির মধ্যে রোদে শুকিয়ে রাখা সোনা বর্ণের ধান দিয়ে নাড়াচাড়া করতেই ধান গুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খৈ হয়ে যেতো। কি যে চোখ ধাঁধানো ছিলো সেই দৃশ্য! কলা দিয়ে খৈ আমার কাছে অমৃতের মতো লাগতো; বিশেষ করে আমি আর আমার ছোট ভাই বেতে বোনা ছোট পাত্রে কলা ও মুড়ি নিয়ে সারা বাড়ি হেঁটে হেঁটে খেতাম। নানীর হাতের মেরা পিঠার স্বাদও ঘোর লাগলো ছিলো। নানী সিদ্ধ মেরা পিঠা ঠান্ডা করে মাটির চুলায় পুড়িয়ে দিতেন আমাদের, আমরা সেই গরম গরম মেরা পিঠা ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতাম। পিঠার শরীর দিয়ে অদ্ভুত একটা পোড়া গন্ধ আসতো, এই পড়া গন্ধ পিঠার স্বাদ আরও বাড়িয়ে দিতো।

নানাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিলো। মাঝখানে উঠান আর উঠানের পাশ দিয়ে নানার ঘর সহ নানার অন্যান্য ভাইদের ঘরও ছিলো। সকল ভাইয়ের আবার বেশকিছু করে সন্তান-সন্ততিও ছিলো। সবাই আমাদের মামা-খালা ছিলেন। আমরা সবাই মিলে পুরো বাড়িটাকে ঈদের কয়েকদিন হৈ-হুল্লোড় আর উৎসবের আখড়া বানিয়ে রাখতাম। দিনমান দৌড়-ঝাঁপ এমনকি রাতের চাঁদের আলোতেও বিভিন্ন রকমের খেলায় মেতে উঠতাম। চলতো নাচ-গান, গল্প-কবিতা আর হা-হা হি-হির বহর।

দেখতে দেখতে চোখের পলকেই আনন্দের দিনগুলো শেষ হয়ে যেতো, বেজে উঠতো আমাদের বিদায়ের ঘন্টা। বুকের ভেতর টা হু হু করতো চলে আসার কথা শুনে, খুব করে চাইতাম যদি আরও কিছুদিন থেকে যাওয়া যেতো; কিন্তু আমাদের চাওয়ারা পূর্ণতা পেতো না। মাঝেমধ্যে আমারা না আসার জন্য এদিক সেদিক লুকিয়ে থাকতাম, কখনো কখনো কাজের চাপ থাকলে আব্বা আমাদের রেখেই চলে আসতেন; কিন্তু কাজের চাপ না থাকলে আমাদের খুঁজে বের করে সঙ্গে করেই নিয়ে আসতেন।

আমাদের আসার দিন নানীর মনের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যেতো, যা তার মুখ দেখে সহজেই উপলব্ধি করা যেতো। তিনি আমাদের চলে আসার কথা শুনেই নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে দিতেন, তার সাথে আমরাও নাওয়া -খাওয়া শিকেয় তুলে দিতাম। বিদায় বেলায় নানী আঁচলে মুখ ঢেকে, আমাদের পিছনে পিছনে এসে প্রধান সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন। তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে রাখলেও আঁখি যুগলের ঘোর বর্ষা ঢেকে রাখতে পারতেন না। একটা সময় ঠিকই বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেন। নানীর সঙ্গে মা সমেত আমরাও কাঁদতাম। বাসে উঠে মন খারাপ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে নানাবাড়ির স্মৃতি মনে করতাম। বাড়িতে আসার পরেও বেশকিছুদিন সময় লেগে যেতো মন ভালো হতে। একটা সময় সব স্বাভাবিক হয়ে যেতো, আমরা আবার আরও একটি ঈদের স্বপ্ন দেখতাম; উছিলা খুঁজতাম নানাবাড়ি যাবার।

এখন আর নানাবাড়ির সেই চিরচেনা গন্ধ নেই, নেই আর আগের সেই আমেজ। নানা-নানী'রা ইহকালের পাঠ চুকিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরকালের জগতে। খালারাও বিয়ের পাঠ চুকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাদের নিজস্ব সংসার জগতে, কত বছর হয়েগেছে অনেকের সাথেই আর দেখা হয় না! একান্নবর্তী পরিবার প্রথা ভেঙ্গে, সবার নিজস্ব বাড়ির আলাদা দেয়াল উঠেছে। এখন চাইলেই আর এক উঠান মাড়িয়ে সবার বাড়ি যাওয়া যায় না। সবাই হয়তো এখন একা একা থাকতেই ভালোবাসেন। আধুনিকতার মোড়কে নিজদের মোড়াতে ব্যস্ত হওয়া মানুষ গুলো কখন যে সবার থেকে একা হয়ে গেছেন টেরই পাননি। আধুনিকতা আর জীবনের দৌড়ে, দৌড়াতে দৌড়াতে আমরাও হারিয়ে ফেলেছি নানাবাড়ি, মায়া আর বন্ধন। ভালো থাকুক আমাদের নীল ছেলেবেলা, সযত্নে গাঁথা থাকুক আমাদের স্মৃতির মালা।

ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ২:৫৩
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×