
আমি তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, আমাদের শ্রেণিকক্ষে ১০০ ঊর্ধ্ব ছাত্র-ছাত্রীর সমাগম ছিলো। আমাদের ক্লাস সহ পুরো স্কুল জুড়ে আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রীর সমাগম ছিলো। এতো-এতো ছাত্র-ছাত্রীর ভীড়ে কিছু দিনের মধ্যেই পুরো স্কুল এক অস্বাভাবিক ছাত্র কে খুঁজে বের করল; যাকে নিয়ে পুরো স্কুল মজা করে বেড়াতো, শিক্ষক-শিক্ষীকারাও এর বাইরে ছিলেন না। পুরো স্কুল যেনো একটা টয় খুঁজে পেয়েছিলো; যাকে নিয়ে নিজের খেয়াল খুশিমতো খেলাধুলা করতো।
ছেলেটা অস্বাভাবিক ছিলো কারণ সে স্কুলের অন্য ছাত্রদের মতো ছিলো না। আসলে ছেলে বলতে আমাদের সমাজ যা বুঝে সে তার উল্টো ছিলো। ছেলে বলতে আমাদের সমাজ বুঝে, ছেলেরা হবে ডানপিটে, দূরন্ত, মারদাঙ্গা যাদের সমস্ত জড়ঝাপ্টা সহ্য করার ক্ষমতা থাকবে, যে কখনোই কান্না করবেনা, ভারী স্বরে কথা বলবে, বুক উঁচিয়ে হাঁটবে, ব্যাথা পেলে উহ-আহ করবেনা, সকল পরিস্থীতে যে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে সে বা তারাই আসল পুরুষ। কিছু-কিছু সমাজে পুরুষের সংজ্ঞা আরও ভয়াবহ। যাকগে, তো যা বছিলাম, সেই ছেলের নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করার জন্য এসব কোনো গুণই তার মধ্যে উপস্থিত ছিলো না। আর এগুলোই তাকে সবার কাছে অস্বাভাবিক করে উপস্থাপন করছিলো। তার আচরণ মেয়েদের মতো ছিলো, চাল-চলন বলন সবই মেয়েদের মতো ছিলো; আর এসব কিছুই তার জীবনে কাল হয়ে দাড়িয়েছিলো, তার জীবন কে করে তুলেছিলো দূর্বিষহ আর বিবিশিখাময়।
ছেলেটাকে শিক্ষকরা তুচ্ছ মনে করতেন; নানান ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলতেন, অন্যদের চেয়ে তার প্রতি শাস্তি আর কটাক্ষ করার ভাষাও আলাদা ছিলো। কোনো কোনো শিক্ষক তো তাকে আপা, মহিলা বলেও সম্বোধন করতেন, আবার কেউ কেউ তাকে পিটিয়ে ছেলে বানানোর গুরুদায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যখন স্কুলের শিক্ষকদেরই তার প্রতি এমন বিপরীত আচরণ ছিলো; সেখানে সেই স্কুলের অন্য ছাত্ররা তার প্রতি কেমন আচরণ করতো তা খুব সহযেই অনুমান করা যায়। ক্লাস শেষে, ক্লাস-রুম থেকে টিচার চলে যাবার পরই আমাদের রুমে উপরের ক্লাসের ভাইয়েরা এসে তার উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো; কেউ তার বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিতো, কেউ দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে তার মুখে-গলায় কামড় বা চুমু খেতো। সে এদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতো কিন্তু একা এদের সাথে পেরে উঠতো না। প্রতিদিন নিয়ম করে এই কাহিনীই চলতো আমরা শুধু তাকিয়ে দেখতাম, কেউ আবার এসব দেখে আনন্দে হৈ-হুল্লড় করতো, হাতে তালি দিতো এ যেনো এক মহা উৎসব, আনন্দের খেলা!
সারা স্কুলে ছেলেটার কোনো কাছের মানুষ বা বন্ধু ছিলো না; কেউ তাকে বন্ধু হিসেবে কল্পনাই করতে পারতো না। সে ক্লাসের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে থাকতো, কারো সাথে কথাও বলতো না অবশ্য কথা বলতে গেলেই শুনতে হতো তুই মেয়েদের মতো করে কথা বলিস ক্যান? এই তোর কন্ঠ মেয়েদের মতো ক্যান? ইত্যাদি। রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটতেও পারতো না। গলির মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে বসা মানুষ গুলো পিছন থেকে এই হাফ-লেডিস? বলে চিৎকার করে ডাকতো। এসব শুনে ছেলেটা লজ্জায় লাল হতো, মুখ চেপে কান্না করতো আর এজন্যও শুনতে হতো এই মেয়দের মতো কাঁদিস কেনো? তার সবকিছুতেই যেনো মানুষ দোষ খুঁজে মজা পেতো, তাকে নিয়ে মজা করাই যেনো মানুষের মূল কাজ ছিলো। ছেলেটা এসব কথা শোনার ভয়ে শর্টকাট লোকালয়ের রাস্তা রেখে মানুষহীন দীর্ঘপথ বেছে নিতো নিজের চলার ফেরার জন্য; যাতে করে মানুষ তাকে কিছু না বলতে পারে। কারো সঙ্গে দেখা হলে সে সবসময় এই ভয়ে থাকতো; এই বুঝি কেউ তাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলে বসে যা তার শুনতে কষ্ট হয়। ছেলেটার জন্য আমার বেশ মায়া হতো; কিন্তু প্রকাশ করতে বা তার কাছে যেতে পারতাম না এই ভয়ে যে, অন্যকেউ আবার আমাকে নিয়ে বাজে কিছু বলে।স্কুলে থাকা অবস্থায় আচানক তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কোনো একটা কাজে ঢুকে যায়; এরপর তার সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
একবার আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে অনেক বছর পর সেই ছেলেকে আবিষ্কার করি; এরপর কাছে ডেকে কথা বলে জানতে পারি সে এই রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সে আমাদের খাবারের অর্ডার নিবে এমন সময় আরকজন ওয়েটার এসে তাকে বললেন, 'আপনি গিয়ে ওই টেবিল টা পরিষ্কার করে দিন আমি উনাদের অর্ডার নিচ্ছি, সে কিছু না বলে টেবিল পরিষ্কার করতে চলে গেলো। বুঝতে বাকি রইলো না সে এখানেও অবহেলা আর তুচ্ছ বস্তু যাকে দিয়ে সব করিয়ে নেয়া যায়। খবার শেষ করে বেরিয়ে আসার সময় তার সাথে আবার আমাদের দেখা হলো; তখন সে নিজেই আমাদের কাছে স্যরি হলো আর বললো এখানে সবাই তাকে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করায়। আমি এর বিপরীতে দীর্ঘশ্বাসের একটা হাসি দিয়ে চলে এলাম, কিছুই বলতে পারলাম না।এর দুই থেকে এক বছর পর তার সাথে আবার আমার একটা ফুড ক্যাফেতে দেখা হলো, সেখানেও সেইম চিত্র দেখলাম। কেউ একজন তাকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে আর সে সেটা শুনে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে প্রতিবাদের স্বরে দু-একটা উত্তরও দিচ্ছে। দেখে ভালো লাগলো যে সে প্রতিবাদ করতে শিখেছে। অবশ্য সেদিন সে প্রতিবাদ না করলে আমি নিজেই তার হয়ে প্রতিবাদ করতাম।
এরমধ্যে একবার ছুটিতে বাসায় গিয়ে আমার এক ফ্রেন্ডের কাছে শুনলাম, সে নাকি তার বাসার সামনে নিজস্ব একটা রেস্তোরা খুলেছে; ভালোই নাকি বেচা-বিক্রি হয় সেখানে আর মানুষের আড্ডাও হয় বেশ। আমার বন্ধুরাও নাকি সেখানে গিয়ে আড্ডা দিয়ে আসে। শুনে বেশ ভালো লাগলো; যে ছেলেটা আড্ডা আর মোড়ের দোকান থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতো বিদ্রুপ শোনার ভয়ে, সেই ছেলের রেস্তোরাতেই নাকি এখন আড্ডাখানা আর বিকিকিনি চলে। হয়তো কিছুকিছু মানুষ এখনো তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে হয়তো এখনো কেউ তাকে জড়িয়ে ধরতে চায়, বাজে প্রস্তাব দেয় তবুও সে ঘুরে দাড়িয়েছে, সে বাঁচতে শিখেছে এটাই আমাকে ভীষণ আনন্দ দিয়েছে। ভেবেছি একবার সময় করে ওর রেস্তোরায় ঢুঁ মেরে আসব, দেখে আসব ঘুরে দাঁড়ানো ছেলেটাকে।
আমরা মানুষেরা অন্যকাউকে আমাদের মতো হতে না দেখলেই তাকে অস্বাভাবিক তকমা লাগিয়ে দেই, কেউ একটু সহজ সরল হলেই তাকে বোকা মনে করে ঠকানোর পথ খুঁজি বা তার উপর জুলুম করি, পরিবার থেকেই আমরা সাদা-কালোর পার্থক্য শিখি, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ শিখি। আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবার আমাদের ভেতরে এমন ভাবনা জাগাতে অনেকটাই দায়ী। যে ছেলেকে নিয়ে আমি কথা বলছিলাম, আমাদের সমাজে এরকম অনেক ছেলে আছে যাদের জীবন গল্প হুবুহু একরকম। তারা সবাই এই ঠাট্টা-বিদ্রুপের মধ্যেই বেড়ে উঠে, পালিয়ে বেড়ায় লোকালয় থেকে। এই মানুষ গুলোকে তাদের পরিবারও তুচ্ছ-তাচ্ছ্যিলের চোখে দেখে, এরা নিজের কাছের মানুষ কিংবা আত্মীয়দের মাধ্যমে সেক্সুয়াল হ্যারেজমেন্টের শিকার হয়, আত্মীয়রা এদের নিয়ে ফিসফিস করে কিন্তু কেনো? এই মানুষ গুলো কি নিজের ইচ্ছেতে এভাবে জন্মেছে? সে কি নিজে ইচ্ছে করে এভাবে চলা-ফেরা বা কথাবার্তা বলছে? যদি তা নাই হয় তবে আমাদের তাদের নিয়ে এতো সমস্যা কেনো? আমাদের কি তাদের সাথে কোনো শত্রুতা আছে? যদি তাও না থাকে তবে তাদের কষ্ট দিয়ে কথা বলার, বাজে প্রস্তাব দেয়ার, সেক্সুয়ালি হ্যারেজ করার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? আমরা একজন কে একটা কথা বলতে পারলেই নিজেকে বড় মনে করি; কিন্তু একটাবার ভেবে দেখিনা এই কথাটি সেই মানুষ টাকে কতোটা বিধ্বস্ত করছে, কতোটা যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবী করে থাকি অথচ আমাদের কাজ অসভ্য আর বর্বরদের মতো। আমারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারলেও এখনো পর্যন্ত নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারিনি!
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২৩ বিকাল ৩:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



