
ঝুম বৃষ্টি, টিনের চালে বৃষ্টির মহনীয় শব্দ, জানালার গ্রিল ধরে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপলক বৃষ্টি দেখা, ভরা বর্ষায় নদী-খালবিল পানিতে থৈথৈ, নদীর বুকে পালতোলা নৌকা এসব ভাবলেই আমরা অধিকমাত্রায় রোমান্টিক হয়ে যাই। কবি-লেখকরাও তাই হতেন হয়তো; আর তাইতো তারা ভরা বর্ষা আর বৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে, অগণিত গল্প-কবিতা রচনাও করেছেন।
পৃথিবীতে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম যারা বৃষ্টি পছন্দ পছন্দ করেন না। আমি নিজেও বৃষ্টিতে আসক্ত। স্কুল-কলেজে থাকতে বৃষ্টি হলে অনেক ভিজতাম, কারণে-অকারণে ভিজতাম, সময়ে-অসময়ে ভিজতাম। এমন অনেক হয়েছে, বৃষ্টিতে বাড়ি ফেরার গাড়ি অথবা দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা থাকা সত্বেও আমি ব্যাগ কাঁধে এবং চটি যুগল হাতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতাম। চায়ের দোকান, শপিং কমপ্লেক্স কিংবা যানবাহনে থাকা উৎসুক জনতারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ভেবে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো; অবশ্য সেই সময় আমাকে নিয়ে কে কি ভাবছে তা নিয়ে ভাবার ফুরসত আমার ছিলো না। আমি তখন এক মনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমার গন্তব্যের দিকে হাঁটতে থাকতাম। এসব নিয়ে কত যে আব্বা মা'র বকা খেয়েছি তার হিসেব নেই।
সময় টা ২০১৬ সালের জুন মাস, রোযার ঈদের পর আমাদের মা মারা গেলেন। জগতের সাধারণ নিয়মেই আমাদের পুরো পরিবার কালো মেঘের ন্যায় শোকের ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে, দিনমান ঝরতে শুরু করলো শ্রাবণের ধারার মতো। আমাদের এভাবে ঝরতে দেখে, আমাদের সাথে দুঃখের শামিল হয়ে ঝরতে শুরু করলো আকাশ। দিনমান ঝরছে তো ঝরছেই থামবার কোন নাম-গন্ধ নেই। বৃষ্টিতে ঘরবন্দী মানুষ মুখরোচক খাবারের উৎসবে মেতো উঠলো। কারো বাড়িতে গরুর মাংস কষা আর ভুনাখিচুড়ি তো কারো বাড়িতে ধোঁয়া উঠা সাদা ভাতের সাথে গরম গরম ইলিশ ও বেগুন ভাজা; আবার হয়তো কোনো দিনমুজুরের বাড়িতে শাক-লতাপার অভাবেই চুলায়ই জ্বলেনি।
এভাবে কয়েকদিন চলার পরে, সকলে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বৃষ্টি কে উপেক্ষা করেই বেড়িয়ে পরলেন যে যার কাজে; এদিকে বৃষ্টি আর বানের পানি মিলে নদীর দুকূল ছাপিয়ে শুরু হলো বন্য। নতুন পানির আগমনে পাড়ায় মাছ ধরার ধুম পড়ে গেলো। একদিকে যখন বৃষ্টিবন্দী ঝিমিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছিলো অন্যদিকে তখন নদী পাড়ার মানুষ গুলোর মুখে চিন্তার ভাঁজ। ঘর-বাড়ি ডুবে গেলে কোথায় গিয়ে উঠবেন! কিন্তু পানি কি আর এসব বুঝে? সে তারমতো ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকলো। যাদের টান পাড়ায় স্বজন আছেন তারা বাড়িঘর ছেড়ে সেখানে গিয়ে উঠলেন কিন্তু যাদের ঠাঁই দেবার কেউ নেই তাদের শেষ আশ্রয় হয় ইট দিয়ে উঁচু করা চৌকির উপড়।
আমাদের এক প্রতিবেশীর বাড়ি ছিলো নদীর কাছের নিচু জায়গায়। তারা আগে আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন, ভাইয়েদের মধ্যে জায়গাজমি ভাগবাটোয়ারা হওয়ায় তারা নদী পাড়ায় জায়গা পেয়ে সেখানেই কোনমতে ঘর তুলে থাকতে শুরু করলেন। এর দুই-এক মাসের মধ্যেই আমাদের সেই প্রতিবেশী বোউ বাচ্চা রেখে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্তকালের জগতে পাড়ি জমালেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এভাবে আচানক চলে যাওয়ায় তার বোউ ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে পড়ে গেলেন অথৈজলে। আমরা এবং আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশীরা তাদের যথাযথ সাহায্য সহযোগিতা করতাম, সেই মহিলাও এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করতেন।
সেই ভরা বর্ষায় মহিলার বাড়িতে বন্যার পানি উঠোন এবং উঠোন থেকে ঘরে উঠে গেলো। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার উপক্রম তখনও তার শ্বশুরবাড়ির কেউ তাদের খবর নিতে আসেনি অথচ তার শ্বশুরবাড়ির অঢেল অবস্থা তারা মাসের পর মাস সেখানে থাকলেও তাদের থাকা-খাওয়ার অভাব হবেনা; কিন্তু পাষাণ মানুষ গুলো তাদের খবরই নিতে আসেনি।
এই কথা গুলো যখন আমাদের কানে আসলো তখন আমরা বাড়ির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, মা যেহেতু নেই তাহলে ওরা এসে আমাদের মায়ের রুমে থাকুক। যেই ভাবা সেই কাজ, আমরা সবাই মিলে তাদের বাড়ি গিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও তাদের সঙ্গে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। মহিলার চোখে তখন আনন্দ অশ্রু, বাচ্চা গুলোর চোখ থেকে ভয় উবে গেছে ততক্ষণে। তারা আমাদের মায়ের রুমে থাকতে শুরু করলেন। আমাদের একসঙ্গে রান্না হতো আমরা একসঙ্গে বসে খেতাম, গল্প করতাম। তারা আসার পর ধীর ধীরে মাতৃবিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠে আমরা স্বাভাবিক জীবনের পথে হাঁটতে শুরু করলাম।
অনেক গুলো বছর হয়েগেছে আমারা সেই দিনগুলো ফেলে এসেছি, মহিলার দিন বদলেছে কিন্তু সেই মহিলা আজও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সেই দিনগুলো মনে করেন।
ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


