somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গদ্য কবিতার ছন্দ

২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১২:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গদ্য কবিতার ছন্দ/ শেখ জলিল

বাংলা কবিতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যুগে যুগে এর বিষয়, আঙ্গিক, ছন্দেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সেই যে চর্যাপদ থেকে যার যাত্রা শুরু তা এখন ঠেকেছে অতি আধুনিকতায়। আর এ আধুনিক কবিতার মূল বিবর্তন এসে স্থিত হয়েছে গদ্যছন্দে। তাইতো গদ্যছন্দেই লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন আধুনিক কবিরা।

আসলে গদ্য কবিতাই বা কী, গদ্যছন্দই বা কী? এককালে আমরা ছন্দোবদ্ধ অন্তমিলযুক্ত বর্ণনাকে পদ্য বলে জেনেছি। কিন্তু বর্তমানে কবিতার বিশালতায় এর ছন্দ, অন্তমিল, উপমা, চিত্রকল্প কিংবা শারীরিক গঠনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। স্বরবৃত্ত্, মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কতো বিচিত্র প্রয়োগই না করছেন আধুনিক কবিরা। অক্ষরবৃত্তের পয়ার থেকে চতুর্দশপদী, অমিত্রাক্ষর, মুক্তক ছন্দের যে বিবর্তন, সে বিবর্তনের ধারায়ই এসেছে গদ্যছন্দ।

গদ্যকবিতা বা গদ্যছন্দের শুরু হয় রবীন্দ্র যুগেই। রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে এসে যে ক'জন সমাজতন্ত্রী কবি গদ্যছন্দের প্রবর্তন করেন তাদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-ই সবচেয়ে সফল। অবশ্য এর মধ্যেই বিষ্ণু দে প্রবর্তিত এক ধরনের গদ্যরীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মূলত ত্রিশের দশকের কবিদের হাতেই ঘটে গদ্যছন্দের ব্যবহার।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশ প্রথম প্রথম এর বিপক্ষে ছিলেন। প্রতিবাদস্বরূপ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত একটি পত্রিকায় গদ্যছন্দের কবিতা প্রকাশ বন্ধ রাখেন। কাজী নজরুল ইসলামতো ব্যঙ্গ করে একটি কবিতাই লিখে ফেলেন। অথচ জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথ একে অনুমোদন দিয়ে গেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের হাতেও ঘটেছে কবিতায় গদ্যরীতির সাধুবাদ। রবীন্দ্রনাথের 'রূপনারানের কূলে জাগিয়া উঠিলাম', নজরুলের 'লাথি মার, ভাঙরে তালা' কিংবা জীবনানন্দের 'যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে তারা' বাংলা কবিতায় গদ্যরীতির সফল প্রয়োগ। বিশ্বকবির 'হঠাৎ দেখা' বা বিদ্রোহী কবির 'আমার কৈফিয়ত' উৎকৃষ্ট সুন্দর গদ্যকবিতা।

যা বলছিলাম ত্রিশের কবিদের কথা- বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু সবাই ছিলেন গদ্যকবিতার অগ্রযাত্রী। এর মধ্যে সুধীন্দ্রনাথের গদ্যরীতিই কবিতায় সফলতা এনেছে। পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশের দু'জন কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং শহীদ কাদরী কবিতায় গদ্যরীতির প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে শহীদ কাদরীর গদ্যরীতি সবচেয়ে সফল, আটসাঁট এবং উল্লেখযোগ্য।

গদ্যকবিতার ছন্দ বা গদ্যছন্দ আসলে কী? নতুন কবিরা যখন আধুনিক কবিতা পড়েন তখন এর অন্তর্নিহিত ছন্দ খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খান। অনেকে গদ্যকবিতাকে ছন্দহীন কবিতা ভাবতে থাকেন। কিন্তু গদ্যকবিতার ইতিহাস অনেক বিশাল। শুরুতেই বলেছিলাম পয়ার থেকে এর যাত্রা শুরু। অক্ষরবৃত্তের মুক্তক ছন্দে এসে এর নতুন বিবর্তন হয়েছে গদ্যছন্দে। তাই গদ্যছন্দের মূল স্বাদ আস্বাদনে সব কবিকেই চষতে হয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বিশাল জমিন।

গদ্যকবিতার রীতি একেক কবির কাছে একেক রকম। আধুনিক যে কবিরা গদ্যছন্দে সফলতা পেয়েছেন তারা সবাই প্রথম অক্ষরবৃত্তে লিখে হাত পাকিয়েছিলেন। আর তার ফলশ্রুতিতে তারা পেয়েছেন কবিতায় তাদের নিজস্ব গদ্যরীতি। হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী ছাড়াও শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ প্রমুখ কবি গদ্যকবিতার অন্যতম পথিকৃত। ষাট ও সত্তর দশকের আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আবিদ আজাদ ছিলেন বেশ সফল।

কেউ বলেন, উপমাই কবিতা। কেউ বলেন চিত্রকল্প, কেউ বলেন অতীন্দ্রিক ভাবনা; আবার কেউ বলেন বাস্তবের সাথে কল্পনার সংমিশ্রণ। আবার নতুন করে কাউকে কাউকে বলতে শুনি- যা গদ্য নয় তাই কবিতা। এ কথার সাথে অবশ্য ছড়া, পদ্য বা লিরিকের একটা দ্বন্দ চলে আসে তখন। আসলে কবিতা অনেক বিমূর্ত, অনেক ভাবনাবহুল। গদ্যকবিতার বা গদ্যছন্দের কথা বলতে গিয়ে কবি, গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন নাচের আসরের নর্তকীর দেহের অস্থি-মজ্জার কথা। আমি বলবো প্রতিটি মানুষের শারীরিক গঠনের কথা। প্রত্যেক মানুষই হাঁটে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে। এ হাঁটা তার একান্তই নিজের। এ চলায়ও আছে তার নিজস্ব স্টেপ বা পদক্ষেপ এবং চলার নির্দিষ্ট দূরত্ব বা তাল। এ তাল- চলনই হলো একজন কবিতা লেখায় তার গদ্যরীতি। সুন্দর হাঁটা যেমন ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে, সুন্দর গদ্যরীতিও তাই। আর চলতে চলতে যদি ক্লান্তি আসে হঠাৎ-ই থেমে পড়তে হয়- তবে চলারও যেমন ছন্দপতন হয়, কবিতায়ও তেমনি। আসলে পাঠককে ধরে রাখাই গদ্যকবিতার মূল বৈশিষ্ট্য। পড়তে পড়তে পাঠক যাতে ক্লান্ত না হয় সেদিকে খেয়াল করলেই কবিতার গদ্যছন্দে আসবে কবির স্বার্থকতা।

১৩.০৬.২০০৬

** ব্লগের পোস্ট দেখে আধুনিক কবিতা নিয়ে দু'কলম লেখার ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু সময়াভাবে আর নতুন লেখা হলো না। তাই এ লেখাটিই আবার পোস্ট দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০০৮ সকাল ৯:৫০
১২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×