আমি জানি না, এখন দেশে একাত্তরে পাকিসত্দানের দালালদের রাজাকার বললে আবার আমার বিরুদ্ধে কেউ মানহানির মামলা করবে কি না। আমি এও জানি না, আমাদের চেয়েও নতুন প্রজন্ম আসলে রাজাকার বলে কিছু ছিলো তা জানবে কি না। কিন্তু সেই দায়িত্বটা ছিলো কাদের? আমরা কি আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছি? আমরা নতুন সুর ধরেছি, বিভাজন নয়, মুক্তিযুদ্ধের প-বিপ বলে কিছু নেই, আমরা সবাই ভাই ভাই! মুক্তিযুদ্ধের প-বিপ, আজ এই কথাটাও শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজানো হয়। কিন্তু কীসের বিভাজন নেই? পাকিসত্দানের প আর বাংলাদেশের প- এই ব্যবধান রাখা যাবে না? ঠিক আছে, তা নাহয় নাই রাখলেন, তাহলে আপনাকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, আপনি কি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার প েনা বিপ?ে বুঝতে হবে পাকিসত্দান রায় লড়াই করাই সেই দানবদের্ মূল ল্য ছিলো না। ছিলো আরো পরিস্কার ল্য। আর সেটি হলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে সহজ পথে শোষক হওয়া। এখন যখন তাদেরই পুণরুত্থান ঘটছে তখন দেখার বিষয় হলো, তাদের সেই ল্য থেকে তারা কতো দূর?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলোর আশ্রয় নিতে হয়। বর্তমান সরকারের শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী সেই সময় পাকিসত্দান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। আজাদী দিবস উপল্যে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, পাকিসত্দান শুধু কোনো ভূখণ্ড নয়, একটি আদর্শের নাম। ইসলামী আদর্শের প্রেরণাই পাকিসত্দান সৃষ্টি করেছে এবং সেই আদর্শই পাকিসত্দানকে টিকিয়ে রাখতে সম। এরপর তিনি ইসলামপ্রিয় ছাত্র সমাজ বেঁচে থাকা পর্যনত্দ পাকিসত্দান টিকে থাকবে বলে উল্লেখ করেন। নিজামীর এই বর্ক্তৃতা প্রকাশিত হয় 1971 সালের 16 আগস্টের দৈনিক সংগ্রামে। অর্থ্যাৎ পাকিসত্দান রাষ্ট্রকে রা করতে হবে কারণ ধর্ম নিয়ে রাজনীতির পথ সুগম করতে হবে। নিজামীর ইসলামপ্রিয় ছাত্র সমাজ যদি তখন হয় ইসলামী ছাত্র সংঘ তাহলে তাদের উত্তরসুরী ইসলামী ছাত্র শিবির তো আজো টিকে আছে। তবে সেই পাকিসত্দান টিকে নেই। তারা দাবি করেন, ইসলামী আদর্শ তারা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। তারা সেই আদর্শের প্রেরণা দিয়ে কী সৃষ্টি করতে চান, সেই প্রশ্ন কি তাদেরকে শক্ত ভাষায় করার সময় আসেনি? একাত্তরের 7 নভেম্বর বিকেলে ঢাকা শহর ইসলামী ছাত্র সংঘের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত গণজমায়েতে পূর্ব পাকিসত্দান ইসলামী ছাত্র সংঘের তখনকার সভাপতি বর্তমানে জামাতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যে 4 দফা উত্থাপন করেছিলেন তার দ্বিতীয় দফা ছিলো, 'আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের কোনো বই কিংবা হিন্দুদের দালালি করে লেখা কোনো বই লাইব্রেরিতে স্থান দিতে পারবে না।' আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সেই দাবি এখন তার মনের কোন কোণে লুকিয়ে আছে তা বলা দুষ্কর। তবে অন্য ধর্মকে শত্রু বানিয়ে জনতার পরিচয় ধর্মের বৃত্তে আবদ্ধ করার যে মানসিকতা তার এই বক্তব্যে লুকিয়ে আছে তা কি তিনি ত্যাগ করেছেন এখনো?
1971 সালের 8 নভেম্বর দৈনিক আজাদে বদর দিবসের সংবাদে ইসলামী ছাত্রসংঘের অনুষ্ঠানের যে সংবাদটি ছাপা হয়েছিলো সেখানে পূর্বপাকিসত্দান ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাশেম আলী বলেন, 14 শ বছর পূর্বে কাফেররা রছুলুল্লাহর (সা.) ওপর যেভাবে হামলা চালানো হয়েছিলো হিন্দুয়ানিতে আকৃষ্টরা সেভাবেই ইসলাম ও পাকিসত্দানের ওপর হামলা করছে। 5 আগস্ট দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, চট্টগ্রামের এক সুধী সমাবেশে বর্ক্তৃতা করতে গিয়ে মীর কাশিম আলী বলেন, পাকিসত্দানের বুকে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমেই একে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। মানে ভীষণ সোজা, রাজনীতিটা আসলে হবে ধর্ম নিয়ে এবং সেখানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা বলে একটা ব্যবস্থা চালু করে নিজেদের সেই সিস্টেমের মাতব্বর বলে জাহির করা হবে, যাতে শোষণের পথটা পরিস্কার হয়। প্রকৃত ধর্ম সেখানে কতোটুকু উপস্থিত থাকবে আসলে মূখ্য বিষয় সেটিও নয়। ধর্মীয় আইন, না জানি সেটা কী! বাংলাদেশের মানুষের এই ভাবনার সুযোগ নেয়াটাই মুখ্য। রাষ্ট্রের জনগণের জন্য বৈষম্য তৈরি করাটাই মুখ্য। 1971 সালের 6 জুন জামাতের আমীর সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী পাকিসত্দানের প েসাফাই গেয়ে এক বিবৃতি দেন। দৈনিক পাকিসত্দান পত্রিকায় সেটি ছাপা হয় পরদিন 7 জুন। এতে মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসলামী শিায় শিতি নয় বলেই এক শ্রেণীর চরমপন্থী পাকিসত্দানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। এখনো যেকোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে, নেতিবাচক কোনো সামাজিক অবস্থার কথা উঠলেই জামাতের নেতারা বলেন, মানুষ ইসলামী শিায় শিতি হলে সমাজে কোনো বিপর্যয় ঘটবে না। শিাটাকেও একেকটি বিশেষায়িত শ্রেণীতে ফেলে ফায়দা লোটার চেষ্টা তখন থেকেই তারা পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন।
এই লেখায় শেষবারের মতো পুরানো দৈনিকের সাহায্য নিই। 1971 সালের 25 সেপ্টেম্বর হোটেল এম্পায়ারে সদ্য গঠিত মন্ত্রিসভায় জামাতের দুই নেতা প্রাদেশিক শিামন্ত্রী আব্বাস আলী খান ও রাজস্ব মন্ত্রী মাওলানা একেএম ইউসুফ স্থান পাওয়ায় জামাত তাদের সংবর্ধনা দেয়। এই সংবাদটি পরের দিন 26 সেপ্টেম্বর দৈনিক পাকিসত্দানে ছাপা হয়। এতে জামাতের আমীর গোলাম আজম বলেন, জামাতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে জামাত রাজাকার বাহিনীতে লোক পাঠিয়েছে, শানত্দি কমিটিতে লোক পাঠিয়েছে সেই একই উদ্দেশ্যে জামাত মন্ত্রিসভায় লোক পাঠিয়েছে। প্রশ্ন হলো, জামাতে ইসলামীর কর্মীরা এখন কোন জাতীয়তাবাদ লালন করেন? সেই একাত্তরে পাকিসত্দান সরকারের মন্ত্রিসভার পর এবার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও তারা রয়েছেন। প্রশ্ন হতে পারে, এবার কী উদ্দেশ্যে তারা মন্ত্রিসভায় লোক পাঠিয়েছেন?
আমরা কি এতোসব প্রশ্ন কখনো তুলেছি? কেনো তুলিনি? প-বিপ রাখবো না, এই খোঁড়া যুক্তির কারণে? আপনি, আমি যে বলছি, প-বিপ রাখবো না, সব এক হয়ে যাবো, ভেবে দেখেছেন, যাদের নির্দেশ করে আপনার-আমার মুখ থেকে এই কথা বের হয়, তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য এখনো একটুকু অনতপ্ত কি না? একাত্তরে তাদের বিতর্কিত ভূমিকা দলিল দসত্দাবেজ সমেত হাজির করা যায়। অথচ তারা একটিবারের জন্যও এ বিষয়ে মা চায়নি। যে রাষ্ট্রে বসবাস করছে, যে রাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা গাড়িতে উড়ছে, সেই রাষ্ট্রের জন্মটাকেই যারা মেনে নেয়নি, তাদেরকে রাষ্ট্রমতার অংশীদার বানিয়ে আমরা আসলে কোন পথে চলেছি? তাহলে নতজানু কি আমরাই হয়ে আছি? যে দানবকে একাত্তরে জনতা আসত্দাকুঁড়ে নিপে করেছিলো, সেই দানবকে যত্ন করে তুলে এনে কি আবার আমাদের সর্বনাশের পথ খুলে দেয়া হচ্ছে?
দানব শুধু এই একটিই নয়। নব্বুইয়ের গণঅভুত্থানে রক্তের বিনিময়ে যে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছিলো, সেই দানবটিকেও আবার আমরা ফিরিয়ে আনছি। একের পর এক মামলা থেকে খালাস পাচ্ছেন এরশাদ। ক'দিন আগেও যার পেছনে লোক হাতে গোনা যেতো কাল দেখলাম আদালত থেকে বের হবার পর তার পেছনেই আবার লোকের শেষ নেই। বাহ! কতো চমৎকার উপায়ে পতিত স্বৈরাচারকে এভাবে আবার জনগণের ঘাড়ে চাপানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে! তিনি আবার বিগলিত হয়ে জানাচ্ছেন, তিনি পতিত স্বৈরাচার নন এবং তাকে রাজনৈতিক দলগুলোর দরকার।
জোটের রাজনীতি আর ভোটের রাজনীতির স্বার্থে এই দানবদের রাষ্ট্রীয় মতার অংশীদার বানানো কিংবা তার খুব কাছাকাছি নিয়ে সুবাস পেতে দেয়া- এসবের মধ্যে জনগণের স্থান কোথায়? পুরো প্রক্রিয়াটাই গদিটা নিজের দখলে রাখার জন্য। জামাত সরকারের শরীক হবার কারণে কি বিদু্যৎ উৎপাদন বেড়েছে? সব মানুষ কি এখন পেটপুরে খেতে পারছে? এখন কি পুলিশের গুলি খেয়ে মানুষ মরছে না? এখন কি ঘুষ ছাড়া সব কাজ হয়? এখন কি পানি সংকট দূর হয়েছে? দ্রব্যমূল্যের আকাশ ছোঁয়া দাম কি একটানে মাটিতে এসে ঠেকেছে? এসবের কিছুই হয়নি। কিংবা এরশাদ যে নতুন করে চাঙা হচ্ছেন, তাতে কি খুব বেশি কিছু আসছে যাচ্ছে মানুষের? না। তাহলে জনগণ এই পুরো প্রক্রিয়ার কোথাও যখন নেই, তখন তাদেরকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়ার অধিকার কি তথাকথিত বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আছে? নিজের গদি রা করতেই যদি দানব ডাকতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, সেই দানব ডাকা হচ্ছে, মানব ধ্বংস করতে। জনতার ওপর শোষণের ছড়ি আরেকটু জোরে ঘোরাতে। আবার সেই পুরানো কথা বলতে হয়, আসলে শিাটা ইতিহাস থেকেই নিতে হয়। সেখানেই সবার পরিণতি লেখা আছে। #

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



