বিজ্ঞাপনটা একেবারেই ছোট, তবে সবার থেকে আলাদা। রাজশাহীর একটি স্থানীয় দৈনিকে গত 3 দিন ধরে ভেতরের পাতায় প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটির সারকথা হলো, ঋণের ভারে নু্যব্জ একজন মানুষ কিডনি বেচতে চান। নিজের মোবাইল নেই, তাই বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করেছেন প্রতিবেশীর মোবাইল ফোন নম্বর। ঋণের ভার থেকে মুক্তি খুঁজতে নিজের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ বিক্রির বিজ্ঞাপন দেয়া এই মানুষটির নাম আবদুস সাত্তার। রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ভাতুড়িয়া গ্রামের সাত্তার পেশায় সাইকেল মেকার। প্রায় লাখ টাকার ঋণের বোঝা তাকে আকণ্ঠ এভাবেই গ্রাস করেছে যে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের একটি কিডনি বেচে হলেও সেই দুর্দশা থেকে মুক্তি চান।
রাজশাহী মহানগরী থেকে প্রায় 25 কিলোমিটার দূরে মোহনপুর বাজার। সেখান থেকে আরো প্রায় 3 কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে বাকশিমইল ইউনিয়নের ভাতুড়িয়া গ্রাম। 30 বছর বয়সী সাত্তার মেকারের বাড়ি সেখানেই। 3 ভাইয়ের আলাদা সংসার। সাত্তার সবার বড়। বাবা আবদুল গাফফার কৃষিকাজ করেন। প্রায় 15 বছর আগে বড় ছেলে হিসেবে এই সংসারটির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন সাত্তার। প্রথমে ভ্যান চালাতেন। পরে পয়সা জমিয়ে মোহনপুর বাজারে সাইকেল সারাইয়ের দোকান খোলেন। সেই থেকে তার পরিচিতি সাত্তার মেকার হিসেবে।
শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেলো, নিজের বাড়িতে দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে বসে আছেন সাত্তার মেকার। ভাতুড়িয়া গ্রামের মূল রাস্তার পাশের বাঁশঝাড় পেরিয়ে পুকুরের পাড় দিয়ে যেতে হয় সেখানে। সাত্তার জানালেন, 1994 সালে নিজের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য তিনি আশা থেকে 5 হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই ঋণ নিয়ে ব্যবসাও বাড়িয়েছিলেন ভালোই। কিন্তু মোহনপুর বাজারে জুয়ার আসরে বসার বদঅভ্যেস গড়ে ওঠে 1998 সালের দিকে। সেই আড্ডাই তার কাল হয়। ব্যবসা যা বাড়িয়েছিলেন, তার সব টাকা ঢোকে সর্বনাশা জুয়ার আসরে। সাত্তারের হুঁশ ফেরে। কিন্তু ততোদিনে ঋণের টাকা পরিশোধের তাগাদা শুরু হয়েছে। সেই ঋণ শুধতে সনখেজুর গ্রামের দুলালের কাছ থেকে সুদের ওপর 8 হাজার টাকা নিয়ে সামাল দেন। কিন্তু ব্যবসা করতে হলে যে আরো টাকা দরকার! সেই টাকার জন্য আবারো ঋণ। এবার প্রত্যাশা গ্রামসমিতির কাছ থেকে 10 হাজার টাকা। কিন্তু ব্যবসায় যে কামাই সেই টাকা সুদেই যায়। আসল শুধবে কোত্থেকে? সংসারের খরচও বা জুটবে কীভাবে? তাই চলতে থাকে এলাকার সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করা। এর টাকা নিয়ে ওকে বুঝ দেন, এর টাকা নিয়ে তাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে সুদাসল হিসাবের এক সর্বনাশের জালে বাঁধা পড়েন সাত্তার। সর্বশেষ এ বছর তিনি কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিজের ব্যবসা দেখিয়ে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে 35 হাজার ও ভার্ক নামের এক এনজিওর কাছ থেকে 10 হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন।
সাত্তার জানান, সুদখোর মহাজনরা তো রয়েছেই, এখন এনজিওর কর্মকর্তারাও ঋণের টাকার জন্য তার ওপর চাপ দিচ্ছে নিয়মিত। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে গত 8 দিন ধরে তিনি পাওনাদারদের ভয়ে দোকান খুলতে পারছেন না। ফলে তার দিন কাটছে অনাহার-অর্ধাহারে। নিজের জমিও কিছুই নেই যে তা বিক্রি করে ঋণ শুধবেন। সাত্তার বললেন, গত মাসে পাওনাদারদের চাপ এতোটাই অসহ্য হয়ে গিয়েছিলো যে তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুই শিশু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজশাহীতে গিয়ে স্থানীয় এক দৈনিকের অফিসে 2শ টাকার বিনিময়ে 3 দিন বিজ্ঞাপন প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। কিডনি বিক্রি করলে অনেক পাশর্্বপ্রতিক্রিয়া আছে জানার পরেও কোনো পথ না থাকায় সেই পথই বেছে নেন তিনি। স্ত্রী মাহফুজা জানান, দুই সন্তানকে নিয়ে তাদের দিন কাটছে মানবেতরভাবে। প্রতিবেশী সোয়েম উদ্দিন জানান, তারা সবকিছু জেনেও কিছুই করতে পারছেন না। কারণ তাদের সামর্থ নেই। স্থানীয় ইউপি মেম্বার মোনশেদ হোসেন মিঠুও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না এখনো।
কথা বলতে বলতে সাত্তারের গলা ধরে এলো। 10 বছরের শিশুপুত্র ও 3 বছরের শিশুকন্যাকে দেখিয়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'আমার না হয় কিছু ভুল হয়েছে। কিন্তু আমার দুই সন্তানের তো কোনো ভুল নেই। আমার এই দুই বাচ্চা নিয়ে আমরা যেনো একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারি এই ব্যবস্থা কি কেউই করতে পারবেন না? 10 বছর ধরে টানা ঋণের ঘানি থেকে কি আমি কোনোদিন মুক্ত হতে পারবো না?'
প্রিয় পাঠক, প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। অনেকেই সাত্তার মেকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। চেষ্টা করে দেখুন তো আপনিও কিছু পারেন কি না।
ছবি : নিজের ঘরের বারান্দায় স্ত্রী আর বাচ্চা নিয়ে বসে আছেন সাত্তার মেকার।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



