somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি-বিস্মৃতি আর দুঃস্বপ্নের উত্তরাধিকার

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ সকাল ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায়, যেসময়ের স্মৃতি আসলে আমার খুব বেশি মনেও নেই, আমরা থাকতাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে। বাবা সরকারি চাকুরে। সরকারি কোয়ার্টারে থাকা। ওই সময়ের যে টুকরো স্মৃতিগুলো মনে আছে সেগুলোর মধ্যে একটি স্মৃতি ছবির মতো এখনো দেখতে পাই। সেই ছবিটি একটি বড় গাছের নিচে এক ট্রাক শ্রমিককে নির্মমভাবে পেটানোর দৃশ্য। যারা পেটাচ্ছিলেন তাদের শরীরে ছিলো জলপাই রঙের পোশাক। জানি না, ট্রাক শ্রমিকটা বোধহয় মহা অপরাধ করেছিলো!
একটু বড় হবার পর, যখনকার স্মৃতি হাতড়ে অনেককিছুই বের করা যায়, বাবা বদলি হলেন নওগাঁর পোরশায়। আবারো সরকারি কোয়ার্টারে থাকা। পার্ক ছিলো, খেলতাম। তবে আমার নিজের একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিলো নদীর প্রতি। কারণও আছে। পোরশায় যাবার পর পারিবারি বন্ধুতা গড়ে ওঠে স্বর্ণা আপুদের সঙ্গে। এক সকালে বদলি নিয়ে স্বর্ণা আপুরা তল্পিতল্পা সমেত নাটোরের লালপুরে চলে গেলেন। আমরা বিদায় দিতে নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম। আমার খেলার সঙ্গী হারানোর বেদনায় কেঁদেছিলামও। আমার কান্নাকে থোড়াই কেয়ার করে নদীর বুকে লঞ্চটি ভেপু বাজিয়ে চলে গেলো। সেই থেকে নদী আমাকে টানতো। কী নদী, নাম মনে নেই। নদীর ওপারেই ভারত সীমান্ত। নদীর পাড়ে বিডিআর ক্যাম্প। বাবা-মার সঙ্গে একদিন নদী দেখতে গিয়ে পানি খাবার আবদার করলাম। সঙ্গে করে পানি আনা হয়নি। নদীর ঘাটে সেইরকম কোনো ব্যবস্থাও নেই। কাজেই বাবা বিডিআর ক্যাম্পে পানি খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক কর্মকর্তা শুধু পানি নয়, অনেক কিছুই খাওয়ালেন। তিনি একজন মেজর। বাবা-মা কোনোদিনই বলে দেননি, বড় হয়ে কী হবো। তাই মেজর প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই থতমত খেয়ে জবাব দিলাম, 'মেজর'। খুব আত্মতৃপ্তির সঙ্গে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন কারণটা। আমি শুধু বলেছিলাম মানুষকে পানি খাওয়াতে চাই, তাই মেজর হবো। মানে মেজরদের কাজ কেবল মানুষ পানি খাইয়ে চলা!
আরেকটু বড় হলাম। তখন মাথা জুড়ে মেজরেরা গিজগিজ করে। খেলনায় তার নমুনা। পোশাক-হাবভাবেও মেজর মেজর গন্ধ! জিয়ার সামরিক শাসনের পর দেশে তখন এরশাদের সামরিক শাসনের পালা চলছে। ওই বয়সে জানার কথা নয় আমার। কিন্তু সে কারণেই সেনাবাহিনীর গাড়ি নিয়মিত আসতো-যেতো। আমার বাবার অফিসটা কোয়ার্টার থেকে কিছু দূরে। মাঝে মাঝে ঝাঁকড়া চুলের বাবাকে দেখতে মন চাইলে চলে যেতাম অফিসে, এক দৌড়ে। বাবা দোকান থেকে চকলেট কিনে দিতেন। নিষিদ্ধ 'টিকটিকির ডিম' (গোল বলের মতো চকলেট) মাকে লুকিয়ে কিনে দিতেন বাবা। এমনই একদিন বাবা টিকটিকির ডিম আর চকলেট কিনে দিয়ে আমার হাফপ্যান্টের পকেট ভর্তি করে দিয়েছেন। এমন সময় পেছনে খুব হট্টগোলে ফিরে চাইলাম। দেখলাম সেনাবাহিনীর একটি গাড়ির নিচে সাইকেল দোমড়ানো মোচড়ানো। সারারাস্তা দুধ আর কলার পাতা পড়ে আছে। একজন বয়স্ক মানুষ, একপাশে পড়ে আছেন, হাত দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মানুষ ঘিরে ধরছে তাকে। এমন সময় গাড়ির দরজা খুলে জলপাই রঙের পোশাকে এক কর্মকর্তা নেমে এলেন। ততোদিনে জেনে গেছি, মেজররা এমন ভঙ্গীতে নামেন! ভাবলাম, যাক এবার মেজর লোকটাকে তুলবেন, পানি খাওয়াবেন। কিন্তু হলো উলেটাটা। দূর থেকে কথাগুলো শুনতে পারলাম না। কিন্তু কর্মকর্তা অসহায় বৃদ্ধটিকে জোরে জোরে কেয়কটা লাথি কষলেন। আমার বাবা সে দৃশ্য থেকে আমাকে আড়াল করে নিয়ে এলেন তার অফিসে। এরপর কতোদিন যে আমি স্বপ্নে সেই দোমড়ানো সাইকেলটি দেখেছি!
এখন আমি বাবা হয়েছি। মেজর হওয়া আমার আর হয়নি। না, হতে পারবো কি না সে যোগ্যতার যাচাইয়েও অংশ নিইনি। আমার এক বছর 10 মাসের ছেলেটা সারাবাড়ি দৌড়ে বেড়ায়। দু'দিন আগে ওকে নিয়ে ওর মা'র কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম রিকশায়। আমাদের রিকশার সামনেই দু'টো মেশিনগান তাক করা সেনাবাহিনীর গাড়ি পড়লো। আমার ছেলে জানতে চাইলো ওরা কারা। আমি জবাব দিলাম। আর প্রশ্ন, এগুলো আরমী কেনো? পাশ দিয়ে যাবার সময় সেনা কর্মকর্তা আমার ছেলের গাল টিপে দিলেন সস্নেহে। ছেলেটি আদরে খুশি হয়। আমি দ্রুত রিকশা ছোটাতে বললাম। ভয় হলো, কী জানি, আমার ছেলের না আবার সবাইকে আদরে রাখার জন্য মেজর হবার সাধ হয়! আবার সেই সাধ কয়দিন পরেই চুরমার করে দেয় কোনো দোমড়ানো সাইকেল! সেই দুঃস্বপ্ন দেখার সময় কি খুব কাছে চলে এসেছে?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুসের উচিৎ ভারতকে আক্রমন করা , বিডিআর হত্যাকান্ডের জন্য

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩৭


ইউনুসের উচিৎ ভারতকে আক্রমন করা , বিডিআর হত্যাকান্ডের জন্য

পহেল গাঁয়ে পাকিস্থানি মদদে হত্যাকান্ডের জন্য ভারত পাকিস্থানে আক্রমন করে গুড়িয়ে দেয় , আফগানিস্থান তেহেরিক তালেবানদের মদদ দেওয়ার জন্য, পাকিস্থান... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×