ভাষা দিবস উপলক্ষে উদযাপিত আমাদের এই একুশের জন্ম আমার জন্মের আগে হলেও এর ব্যাপক উদযাপনের বিষয়টি আমার জন্মের পরে এবং জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর থেকেই শুরু হয়েছে। ’৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তীতে ’৭২ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম আমাদের এলাকা বর্তমান গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানা¯ ’ তুমিলিয়া ইউনিয়নের রাংগামাটিয়া গ্রামে ইট আর মাটি দিয়ে শহীদ মিনার নির্মান করে একুশের প্রভাত ফেরী করা হয়েছিল। যতটা মনে পড়ে সেবার, তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্য মন্ত্রী ফনিভূষণ মজুমদার ছিলেন আমাদের এলাকায় অনুষ্ঠিত সেই প্রথম প্রভাত ফেরীর প্রধান অতিথি। পরবর্তীতে কয়েকবছরই গ্রামে ধারাবাহিক ভাবে প্রভাত ফেরী করা হয়েছে। তখন আমরা খালি পায়ে গ্রামের মাটির কাঁচা রা¯ত্মায় খালি পায়ে ভাষা দিবসের উপর রচিত ও গাওয়া বিভিন্ন কালজয়ী গান গেয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করেছি। প্রভাত ফেরীর সময় আমাদের সাথে তখন থাকতেন মুক্তি যুদ্ধে শহীদ হওয়াদের বিধাব স্ত্রীরাও। পাশা পাশি বুলেট বিদ্ধ হয়ে আহতরাও থাকতেন প্রভাত ফেরীর অগ্র ভাগে। সদ্য বিধাব হওয়াদের বুক ফাঁটা কান্নার সাথে অংশ গ্রহণকারী সকলেরই প্রায় বাধ ভাংগা অশ্রু ঝরতো গাল বেয়ে। কেউই তা সংবরণ করতে পারতো না।
বয়স বাড়ার সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন হওয়ায় কারণে বাধ্য হয়ে আশির দশকে আসতে হয়েছিল ঢাকা শহরে। তারও আগে সম্ভবত আটাত্তরের কথা, অস্থায়ী ভাবে ঢাকা বেড়াতে এসে বড় ভাইয়ের হাত ধরে কয়েকবার গিয়েছি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীতে ফুল দিতে বা দেখতে। তখন কেনদ্রীয় শহীদ মিনারের অবস্থা ছিল ভিন্ন এবং সেখানে প্রভাত ফেরী করতে এসে কেই কোন মারামারি করেনি (আমার চোখে পড়েনি)। আশির পর থেকে আমি যখন কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকা আসি তখন থেকেই বন্ধুবান্ধব মিলে অনেকবার গিয়েছি ফার্মগেইট থেকে প্রভাত ফেরী কওে এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে আমার এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। প্রথম দিকে যে ভাবে ভাব গম্ভীর ভাবে এই প্রভাত ফের করতে দেখেছি, পরবর্তীতে তিক্ততার সাথে ঠেলা ঠেলি আর মারামারির মধ্য দিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া অনেকটা বাদ দিয়ে দিলাম। এরপরতো গেলাম বিদেশে। বিদেশ গেলেও দেশের প্রতি মন পড়ে রয়। বিশেষ করে আমাদের জাতীয় দিবস গুলোতে ইচ্ছে করে দেশে চলে এসে সবার সাথে এক কাতারে শরীক হয়ে কাজ করতে। কিন্তু বা¯ত্মবতা ভিন্ন বলে অনেক সময়ই তা পূরণ হয় না। অনেকবার দেশে অনুষ্ঠিত বই মেলাকে কেন্দ্র করে দেশে চলে আসলেও শেষ পর্যšত্ম নানা কারণে একুশের রাতে আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়া হয়নি।
এবছর একুশের বই মেলার মাঝামাঝি আমার ‘একটি লাল গোলাপের জন্য ’ ও ‘ সিঁড়ি ’ দুইটি বই আসার কথা ছিল। কাজের ব্য¯ত্মতার জন্য এবারের বই মেলাতে আমার আসার কথা ছিল না। হঠাত করেই চলে এলাম দেশে। এসে বই দুইটি বাজারে আসার সম্ভাবনা জানতে চেয়েছিলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি কোন প্রকারেইবই দুইটি ২০ তারিখের মধ্যে আসছে না, এ দেখে মন খারাপ হলো। ভেবেছিলাম বিশ একুশ দুই দিন বই মেলাতে থেকে একই দিনে নটর ডেম কলেজে একটা পোগ্রাম ছিল সেটাতে অংশ গ্রহণ করে রাতের কোচে চলে যাবো খুলনা। এবছর জাপানের একটি টিভি চ্যানেলের হয়ে একটি ডকুমেন্টারীর কাজ করতে এসেছি মূলত: দেশে। কাজ বলতে জাষ্ট লোকেশন দেখার জন্য। কিন্তু সময় মত বাজারে বই না আসাতে সব দু;খ মনে চাপা দিয়ে বিশ তারিখ শেষ সময় পর্যšত্ম এবারে সাইড অভিনয়ে জাতীয় পুরুষ্কার প্রাপ্ত অভিনেত্রী লুসী গমেজকে নিয়ে বই মেলায় ঘুরেছি। গেইটে দেখা হওয়া জনপ্রিয় লেখক সাংবাদিক ও টিভি নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলককে আমার লেখা নিশিগুচি পার্ক (প্রথমখন্ড) উপন্যাসটি দিয়ে চলে গেলাম মালিবাগ।
রাত প্রায় পৌনে বারটা পর্যšত্ম বাসে বসে রা¯ত্মায় একুশের প্রভাত ফেরী উপলক্ষে কিছু পথচারীর প্রস্তুতী দেখে মন জুড়ালাম। ঘড়ির কাটায় বারটা বাজার সাথে সাথে ঢাকা ত্যাগ করছিলাম সোহাগ পরিবহনের শেষ বাসে চড়ে আর ভাবছিলাম প্রভাত ফেরীর কথা। অনেকক্ষণ টেলিফোনে অনেকের সাথে কথা বলে বাসের ঝাকুনিতে ঘুমিয়ে গেলাম। শেষে আমার এই ঘুম ভাংলো দৌলদিয়া ফেরী ঘাট পার হবার সময়্ । ফেরী পার হবার কিছু সময় পর থেকে খুলনা শহর পর্যন্ত জাগায় জাগায় বাস বেশ আস্তে চলেছিল। বাস এই আস্তে চলার কারণ ছিল, রাস্তার ধারে অবস্থিত বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রভাতফেরী করার জন্য রাস্তার দুই ধারে লাইন করে হেটে চলা। খুলনা শহর পর্যন্ত আমি গিয়েছি আর রাস্তার দুই ধারের দৃশ্য দেখেছি। এসব দৃশ্যর পুরোটাই ছিল আমার কাছে নতুন আর আনন্দের। এই আনন্দ আমার রক্তে যেন বিদ্যুত সঞ্চালন কয়েছে সারাক্ষণ। স্কুলের ছেলে মেয়েদের মুখে শুনেছি “আমার ভাইয়ের রক্তে রাংগানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি”, “সালাম সালাম হাজার সালাম” এই ধরনের কালোজয়ী সব গান। মাইকেও বাজছিল একই ভাবে যুদ্ধের সময়ের কালোজয়ী সব গান।
চলার পথে বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েদের যে ভাবে ভাব গম্ভীর ভাবে বাংলাদেশের ছোট ছোট পতাকা হাতে নিয়ে গান গেয়ে চলতে দেখেছি এসব দেখে আমার স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের গ্রামের সেই প্রভাত ভেরী করার কথাই মনে হয়েছে খুব। আমরাও ছোট সময়ে সেই একই ভাবে সাদা কাগজে সিম পাতা আর জবা ফুল ঘষে লাল সবুজের পতাকা বানিয়ে পাট শোরার মাথায় লাগিয়ে একই ভাবে গান গেয়ে ঘুরেছি। বিগত বিএনপি-জামাত সরকারের অধিনে বা এরশাদ শাসকের আমলে এমন কিছু হয়েছে বলে আমার জানা ছিল না। আমি যা দেখেছি আজ পর্যন্ত অন্ধের হাতি দেখার মতই ছিল বিষয়টি। যে কারণে এ পর্যত্ম এই একুশের ভাষা দিবস উপলক্ষে ছেলে মেয়েদের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে না ধরার কারণে এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করছিলাম মনে। এই পরি প্রেক্ষিতে আমার এবারের বই ‘সিঁড়ি’ লেখা হয়েছে। বই প্রকাশের আগে এই দৃশ্য চোখে পড়লে হয়তো আমার সিঁড়ি বইয়ের দৃশ্যপট হতো ভিন্ন।
খুলনা শহরে গিয়ে দেখা হলো লেখিকা ও সমাজ সেবী ম্যাগদালিনা কত্মার সাথে। তার কাছেই জানতে পারি খুলনাতে বই মেলা চলছে। বই আর বই মেলা আমার কাছে অন্য সব কিছু থেকেই টানে বেশী। তাই তাকে নিয়ে গেলাম খুলনা গণ গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত বই মেলাতে। তখন প্রচন্ড রোদ। মেলা স্থলে অল্প সংখক ছাত্রছাত্রী ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পাইনি। আমরা সেখানে কিছু সময় ঘুরে পছন্দনীয় খাবার খেয়ে আসার সময় কিছু বই কিনে চলে এলাম বের হয়ে। গত্মব্য রেইলী গেইট কালীবাড়ি। সেখান থেকে আসার পথেও দেখলাম বেশ কিছু স্থানে একুশের অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রস্তুতি চলছিল।
মেলায় আমি আর ম্যাগদালিন ঘুরতে ঘুরতে অনেক গুলো বিদেশী লেখকের লেখা বইয়ের অনুবাদ বই কিনে নিলাম। দিলামও ম্যাগদালিনাকে। এক পর্যায় সেও আমাকে একটি বই কিনে দেবার জন্য ভালো বই খুঁজছিল। ভালো বই খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, টিভি নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ‘ও বন্ধু আমার’ বই। বইটি হাতে নিয়ে ম্যাগদালিনা দেখে বইটি আমাকেই উৎসর্গ করা। বইয়ের গায়ে আমার নাম দেখে সে আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। পারলে যেন লেখকের লেখা সব বই কিনে নিয়ে যায় ।
সেখানে বই বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে আমার এক ধরণের ভাব হলো। ভাব বলতে বেশ ভালোই ভাব। মনে হলো আর এক নতুন দিগত্ম উন্মোচন হলো যেন আমার এখানে এই একুশের বই মেলায় এসে। বিকালে আবার গেলাম বই মেলাতে। আইরিন পারভিন ফোন করে জানালো সে বই মেলাতে আছে, দেখা করতে চাইলে যেন সেখানে যাই। সাথে সাথে রেইলী গেইট থেকে চলে গেলাম বেবী ট্যাক্সি নিয়ে বই মেলায়। বিকালে বই মেলাতে গিয়ে দেখি এক ভিন্ন চিত্র। সেখান কেবল মানুষ আর মানুষ। খুলনা শহরে একুশ উপলক্ষে আয়োজিত এই বই মেলাতে যে এত মানুষ এসে উপস্থিত হয়, তা না দেখলে কল্পনা করা যাবে না। মলাস্থল ঘুরে দেখে মনে হল, এই মেলার বিষয়ে আরো বেশী মিডিয়াতে সুযোগ করে দেওয়া দরকার।
মেলা প্রাংগণে ঘুরে আমি বিভিন্ন জনের সাথে এই মেলা এবং মেলার বেচা কেনা ও অংশ গ্রহণ প্রসংগে অনেকের সাথেই কথা বলেছি। প্রত্যেকেই মেলার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তবে দোকানদারদের কথা এখানে যারা লেখালেখি করেন তাদের দিকেও আরো বেশী নজর দেওয়া দরকার। ছাত্রছাত্রী আর বিভিন্ন প্রেমক জুটির সাথে কথা বলে শুনলাম, তাদের ভাষ্য, খুলনাতে মনোরঞ্জন করার তেমন ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। যে কারণে ফেব্রুয়ারী মাসের এই বই মেলাতে মানুষের এত বেশী ঢল নামে। আমি যা দেখেছি, মেলা স্থলে তিল ধারণের কোন ফাঁকা জায়গা যেন ছিল না।
মেলা থেকে দু’জনে হাটতে হাটতে বিএল কলেজের দিকে চলে গেলাম। সেখানেও যেতে যেতে হালো আমার নতুন অভিজ্ঞতা। দেখলা পথে পথে আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। যতটুকু দেখলাম মনে হলো না ঢাকার বাইরে কোন অনুষ্ঠান দেখছি আমি সেখানে। এরপর গরম চা খেতে খেতে দুজনে আলোচনা করলাম আমার একুশের এই অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে। আমার আলোচনার সংগী আইরিন পারভীন প্রততত্ব বিভাগের একজন অফিসার।
বাড়ি তার গোপালগঞ্জ। সে স্বভাবত ভাবেই যেন বর্তমান সরকারের কিছু ভালোদিক নিয়ে আমার সাথে কথা বলছিলেন। আমি তাকে বললাম, বর্তমান সরকার আর যাই করুক না কেন যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার করতে বদ্ধ পরিকর, তেমনি ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সহ সকল জাতীয় দিবসের সঠিক ইতিহাস অত্মত আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে কারো সাথে কম্প্রোমাইজ করবে না। এটাই আমার কাছে নতুন করে বিশ্বাস জন্মালো পথে পথে আমার ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ে ভাষা দিবসের ভাব গম্ভীর পরিবেশে দিবসটি উদযাপন করতে দেখে।
তথ্য সূত্র: http://www.comillardak.com