somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাবাতিয়ান লাল পাথর

২২ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আরব সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের সময়কার কথা । সেই সময়টিতে ছিল নাবাতিয়ান নামক এক যাযাবর জাতির দৌরাত্ম্য। তবে ইতিহাসবিদদের কাছে নাবাতিয়ানদের সম্পর্কে খুব একটা তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদদের মতে নাবাতিয়ানরা ছিলেন অসম্ভব সৃষ্টিশীল , প্রতিভাধর , কল্পনাশক্তির অধিকারী সেইসাথে পরিশ্রমী এক জাতি। তাদের হাতের কাজ ছিল অসামান্য এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তারা বিশাল পাথর খোদাই করে অনবদ্য স্থাপনা তৈরি করতে পারতো । তারা যাযাবরের মত ঘুরতে ঘুরতে তৎকালীন পেত্রা স্থানে বসবাস শুরু করে। বিশাল বিশলা পাথরে তাদের অনবদ্য শিল্প শৈলীর মাধ্যমে স্থাপনা তৈরী করতে থাকে। ধীরে ধীরে বিশাল বিশাল বেলে পাথরের পাহাড় কেটে বাড়িঘর বা প্রাসাদ তৈরি করতে থাকল তারা। এভাবে চলতে থাকলো তাদের সৃষ্টিশীল নির্মাণ শৈলী এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে পেত্রা হয়ে উঠল নাবাতিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী ।



অসম্ভব সুন্দর নির্মাণশৈলী এবং অবস্থানগত যোগাযোগ সুবিধা জন্য পেত্রা খুব অল্প সময়ের মধ্যে অন্যতম বাণিজ্যিক নগরী হয়ে ওঠে।
ইতিহাস বলে সেই পেত্রা নামক স্থানটি পরবর্তীতে পেত্রা নগরীতে রূপ নেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে জন্ম নেয় এক শৈল্পিক সৃষ্টিশীল সভ্যতা।
নাবাতিয়ান এর মধ্যে ছিল শিল্প শৈলী , শিক্ষা , সাহিত্য , প্রকৌশল এমন কি জ্যোতির্বিজ্ঞানে দক্ষতা। এইসবের সমন্বয়ে তারা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ , দক্ষ এবং উন্নত করতে লাগলো। আর কোন দেশ বা জাতি যখন উন্নতির দিকে ধাবমান হতে থাকবে তখন অন্য জাতির রোষানলে পড়তে হবে। নাবাতিয়ান সভ্যতা এর ব্যতিক্রম নয়।

ধীরে ধীরে নিজেদের আরো উন্নত করতে থাকে নাবাতিয়ানরা। পেত্রা নগরী কে রেখেছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পেত্রার চারধারে ছিল উঁচু পাহাড় আর একটি অফুরন্ত ঝরণাধারা। আধুনিক নাগরিক সুবিধা ।ছিল নগর রক্ষক আর সেনবাহিনীর জন্য ব্যারাক।মরুভূমির উপর দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান সব বাণিজ্যিক পথগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করত পেত্রা।



কি ছিল না পেত্রা নগরীতে ? তাদের সর্বোচ্চ স্থাপত্য মেধা কাজে লাগিয়ে ছিল তারা।
প্রাচীন এ নগর রাজ্যে ছয়তলা ভবন ছিল, যার ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান।বড় বড় মূর্তি স্থাপিত মন্দির, লাইব্রেরি , বাড়িঘর, ১০ থেকে ১৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ষ্টেডিয়াম , ৩০০০ দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন থিয়েটার ! পেত্রার বাইরের স্থাপত্য যেমন সুন্দর তেমনি অন্দরমহল ও ছিল নজরকাড়া।
একটি জিনিস স্পষ্ট যে , অন্য সভ্যতায় যখন ধর্মীয় স্থাপনা কে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় সেখানে নাবাতিয়ান প্রাধান্য দিয়েছে শিক্ষা , সাহিত্য , বিনোদন কে।

আরো ছিল প্রায় ১০,০০০ স্কয়ার ফিট আয়তনের একটি বিচারালয়। এ বিচারালয়ে ছিল বিচারকের বসার স্থান, যুক্তিতর্ক উপস্থানের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের জন্য নির্ধারিত স্থান। তারমানে আজকের দিনের বিচারালয়ের মত। বাদী/বিবাদীর জন্য আলাদা আলাদা স্থান , বিচার দর্শনার্থীদের জন্য বসার স্থান ।



তারা গুহার মধ্যে স্মৃতিস্তম্ভগুলো স্থাপন করে ছিল।গুহার পাশেই সবচেয়ে বিখ্যাত ‘খাজনেত ফিরাউন’ নামের মন্দির। মন্দিরটি ফারাওদের ধনভাণ্ডার নামেও পরিচিত । সর্বোপরি বিশালতা , স্থাপত্য-ভাস্কর্য এবং শিল্পশৈলীর ছোঁয়ায় বিখ্যাত এই নগরী তথা নাবাতিয়ান সভ্যতা । পেত্রার মসলা ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। পেত্রা থেকে গ্রীস , চীন ও ইজিপ্টে মসলা রপ্তানি করা হত।এতে নাবাতিয়ানরা অর্থনৈতিকভাবে আরো সমৃদ্ধ হতে থাকে। ধনী হয়ে উঠা নাবাতিয়ানরা নগরীকে গড়ে তুলতো সৃষ্টিশীলতায়। অর্থ কাজে লাগানোর শৈল্পিক ব্যবহার তারা জানতো। তারা উপভোগ করতো সাহিত্য , ক্রীড়া , বিনোদন। ভালোবাসত প্রফুল্লতা। কথার ছিল সুরক্ষায়। আস্থা ছিল বিচার ব্যবস্থায়।

নাবতিয়ানরা মরুভূমির মধ্যে কৃত্রিমভাবে জলের ব্যবস্থা করেছিল। জল সংরক্ষণ করার জন্য বাঁধ তৈরি করেছিল । পেত্রা নগরীর এমন অভূতপূর্ব উন্নতি রোমান সম্রাটদের চোখ এড়ায়নি। তৎকালীন মহাশক্তিধর রোমান সম্রাটদের প্রতিহত করার ক্ষমতা নাবতিয়ানদের ছিল না । সেই সুযোগে ১০৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ট্রোজান পেত্রা দখল করে ।



ধীরে ধীরে নাবতিয়ান এর সাথে মিশে যেতে থাকে রোমান শৈলী। নাবতিয়ানরা নিজস্বতা হারায়। নাবতিয়ানদের ধর্ম নিয়ে কোথাও খুব বেশি চর্চা পরিলক্ষিত হয় না। ধারণা করা হয় এরা ‘দুশরা’ নামক এক দেবতা / দেবী ‘আল উজা’র পূজা করত। পরবর্তীতে পেগান ধর্ম গ্রহণ করে।রোমান সম্রাটদের হাত ধরে পেত্রায় খ্রিস্টধর্মের প্রবেশ ঘটে। মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয় চার্চ।



রোমান অধীনস্থতায় কমতে থাকে উন্নতির ধারা। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে পেত্রার অবনতি ঘটতে থাকে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে রোমানদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য করাকে দায়ী করা হয়। কালের বিবর্তনে পেত্রার অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে থাকে।হুমকির মুখে পরে নাবতিয়ান সভ্যতার শৈল্পিকতা। ধ্বংসের ধাক্কাটা দেয় এক ভয়াবহ ভুমিকম্প। ভেঙে পড়ে শহরের ঘরবাড়ি, চার্চ, মন্দির। ভেঙে পড়ে জল সরবরাহ ব্যবস্থা। স্তব্ধ হয়ে পড়ে পেত্রা। নাবতিয়ান সভ্যতার শৈল্পিকতা , সৃষ্টিশীলতা , শিল্পশৈলী , অনন্য স্থাপত্যকলা , অনিন্দ্য পেত্রা নগরী অবশেষে ঠাঁয় নেয় ইতিহাসের পাতায়।

কালের গহবরে আর সভ্যতার বিবর্তনে চাপা পড়া এই অজানা সভ্যতাকে অনেক বছর পশ্চিমা বিশ্বের কাছে উম্মোচন করেন সুইস পরিব্রাজক জোহান লুইডইগ বুর্কহার্ট।



১৮১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পড়ি জমান জর্ডানের উদ্দেশ্যে। সেই বছরই ঘুরতে ঘুরতে একদিন মরুভূমির মধ্যে এক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষের সামনে এসে থমকে দাঁড়ান জোহান। শহরটির স্থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্পশৈলী দেখে মুগ্ধ হন জোহান।অভিজ্ঞ ঐতিহাসিক বুঝে গেলেন তিনি দাঁড়িয়ে আছেন আশ্চর্য অপুরূপ এক শহরের ধ্বংসাবশেষের সামন। যে শহরে ছিল শিক্ষা , সাহিত্য , শিল্প শৈলী , আর অনন্য সৃষ্টিশীলতা।


শহরটার নাম - পেত্রা। পেত্রা’ শব্দের অর্থ হল পাথর। নাবাতিয়ান সভ্যতার এক বিস্ময়কর সৃষ্টি লাল পাথরের শহর পেত্রা। লাল পাথর দিয়ে তৈরি বলেই হয়তো এই শহরটির নাম করা হয় পেত্রা। তবে পর্যটকরা ভালোবেসে এই শহরকে ‘রেড রোজ সিটি’ নামেও ডাকে। তবে যে নামেই ডাকুক না কেন , তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই অপরূপ মানব সভ্যতা আজও সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন লাল পাথর হয়ে। নাবাতিয়ান লাল পাথর।



১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে পেত্রাকে। এ ঘোষণায় পেত্রাকে বলা হয় “মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদগুলোর একটি”। এছাড়াও ২০০৭-এ পৃথিবীর নতুন সাতটি আশ্চর্যের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে পেত্রা।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তথ্য সূত্রঃ
The "Lost City"

Petra

unesco

The PETRA PROJECT

**রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে মাত্র দুইশত বছরের মাথায় পেত্রা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়।বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ইতিহাস পরে একদিন বলা যাবে। এইধরনের পোস্ট এটাই প্রথম। এর আগে কখনো লেখা হয়নি। বিশেষ ধন্যবাদ এবং অনুপ্রেরণায় -- প্রিয় ব্লগার শের শায়েরী ভাই।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৪:২৫
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×