আজ ১৮ ই নভেম্বর ২০২০। আমি দিন তারিখ খুব হিসেবে করে চলি। একেকটা দিনের প্রস্থান মানে আরো একটা হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ। এই আক্ষেপ কে জড়ো করতে করতে , একেকটা দিন পার হয়ে যায়। বসন্তের পর বসন্ত , পূর্ণিমার পর পূর্ণিমা পেরিয়ে যায়। ছেলেবেলা থেকে হারিয়ে যায় - শেষ রমজানে চাঁদ দেখার উত্তেজনা ,ঈদের দিনের আগের রাতগুলোর উৎকণ্ঠা কিংবা ঈদের সকালে সবার আগে ঘুম থেকে ওঠা। সবচেয়ে মজার শৈশব নিমেষেই হারিয়ে গেলো।শৈশবের মাছ ধরা ছিপ আমার মতোই ছিপছিপে ছিল। ইমরান খান লেখা ক্রিকেট ব্যাটটা ঘুণে খেয়েও ঘুণ ধরাতে পারেনি স্মৃতিতে। শৈশবের বইয়ের ভান্ডারের কত বই উঁইয়ে কেটেছে , ইঁদুরে কেটেছে কিন্তু স্মৃতির নাগাল পাইনি। ইঁদুরের কি আর সাধ্যি ?
মনে আছে , জেনারেল এরশাদের আমলে শিক্ষক আন্দোলন চলছে। অনশন চলেছে।আব্বা আম্মার সাথে আমি প্রভাত ফেরিতে।খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন সাদা মানুষ গুলো।আমি ঘুরছি এই কোলে থেকে ওই কোলে , আমার আশে পাশে অনেক মানুষ। সাদা মানুষ। অস্পষ্ট স্মৃতি তবে বিভ্রম নয়। সেই ছোট্টবেলায় আমি আন্দোলনের সাথী হয়ে গেলাম। কি ভাগ্যবান আমি।
ইদানিং পাকা দাঁড়ির পরিমান বাড়ছে। কিছুদিন আগেও সংখ্যা দিয়ে নির্ণয় করা যেত , আজ পরিমানে পরিণত হয়েছে। চোখের নিচে স্পষ্ট দাগ আর কুঁচকানো কপালের ভাঁজে বয়স নামক ভয়ঙ্কর জিনিসটা প্রতিনিয়ত স্পষ্টতর হচ্ছে। বয়স বেড়ে যাওয়া খুব ভয়াবহ ব্যাপার। তীব্র আক্ষেপ টা খুব দ্রুত জমাট বাঁধে বুকে। তীক্ষ্ণ পেরেকের খোঁচা দেয়। সেই রকমারি শৈশব সেই তীক্ষ্ণ পেরেকে আরো বেশি শান দেয়।
শৈশবে একটা রাশিয়ান বই পড়েছিলাম। সাতরঙা ফুল।সাতটা পাঁপড়ি সাত রঙের। সেই ফুল কোন সাধারণ ফুল নয়। যেনতেন ফুল নয়। এইফুল ইচ্ছে পূরণ ফুল , সাতটি পাঁপড়িতে সাতটা ইচ্ছে। শুধু মন্ত্র পড়ে উড়িয়ে দিলেই হল , পাঁপড়ি মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবে। আমার একটা সাতরঙা ফুল চাই! মন্ত্র আমার জানাই আছে , ইচ্ছেটাও ঠিক করা আছে। শুধু , শুধু আমার একটা সাতরঙা ফুল চাই। আমি সেই ফুলের একটা পাঁপড়ি উড়িয়ে দেব ----
১৮ই নভেম্বরে শুরু করেছিলাম। আবার ফিরে আসি। নাহ , ভুল বললাম -- ফিরে যায়। বেশ কয়েকবছর আগে - ১৮ই নভেম্বরে। ভেড়ামারা হাইস্কুলের হেডস্যার চেয়ারে বসে আছেন , তার সামনে পরীক্ষার খাতা। তিনি খাতা দেখছেন। টেবিলের রাখা এককাপ চা। তার মন নেই। তার মন পড়ে আছে - ভেড়ামারা ফেরি ঘাট পেরিয়ে , পাকশী ঘাট হয়ে সাহাপুরের বিশাল আম গাছেরটার পাশের বাড়িতে। তিনি ছটফট করছেন। ভেড়ামারা জংশন থেকে ট্রেন ধরলে কিন্তু খুব সহজেই পাকশী চলে যাওয়া যায়। পরমুহূর্তেই তিনি একটা সুসংবাদ পেলেন। খবর এলো ওই বিশাল আম গাছওয়ালা বাড়ি থেকে। ঐ বাড়িতে এক শিশু জন্ম নিয়েছে । তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তার তামাক আর হাতে সিগারেট বানানোর সরঞ্জাম তুলে রাখলেন টিনের সুটকেসে। ঠিক করলেন , তিনি আর কোনদিন সিগারেট খাবেন না।
তার সিগারেট ছেড়ে দেয়ার বয়স অনেক হয়ে গেছে। ঠিক আমার বয়সের সমান!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ১২:৩১