somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রিয় ১০ টি বই এর মাঝে একটি ( ধারাবাহিক- ১ম পর্ব)

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কলকাতার কাছে- খুবই কাছে। শহরের এত কাছে যে এমন দেশ আছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত............
উপন্যাস বা গল্পটির শুরু এমনিভাবে, শহরের সেই অতি সন্নিকটে মনুষ্য বসতির স্থানটুকু সম্পর্কে সুক্ষাতিসুক্ষ অপূর্ব সব বর্ণনা দিয়ে। প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা বা মানুষের অনুভুতিগুলির এত সুক্ষ বর্ণনা যে এত অসাধারণ হতে পারে এই বই না পড়লে আমার জানা হত না। লেখাগুলো পড়তে পড়তে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, সেই গহীন অরন্যসম দুর্ভেদ্য এবড়ো খেবড়ো, খানা-খন্দপূর্ণ দূর্গম পথ। মশা মাছি ভাম ভোদড়ে পরিপূর্ণ বাঁশঝাঁড় বা বনাঞ্চলের মাঝে মনুষ্যবসতির অযোগ্য সেই স্থান। এই স্থানে তাহলে থাকে কারা?

হ্যাঁ সেই দুর্গম দূর্বিসহ স্থানে বসবাসকারী মানুষগুলি আর তাদের প্রস্তর কঠিন জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি বিষয়াবলী নিয়ে রচিত কথকতাই এই উপন্যাসের মূল বক্তব্য। আর উপন্যাসের নায়িকা এক অতিশীপর বৃদ্ধা "শ্যামা ঠাকরুন"।

" পথে যেতে যেতে দু চারখানা বাড়ি নজরে পড়বে। কিন্তু বন জঙ্গল তাতে এমন কিছু কমেনি। খানিকটা এগিয়ে খালের পুল পার হয়ে রাজার বাড়ি ডাইনে রেখে বাজারের পাশ কাটিয়ে আরও যদি চলতে থাকেন তো একসময় মনে হবে দুপুরেই বুঝি সূর্য্য অস্ত গেছে- ভ্যাপসা গন্ধ আপনার নিশ্বাস রোধ করে আনবে। বুঝবেন এইবার আপনি শ্যামা ঠাকরুনের বাড়ির কাছাকাছি এসেছেন।

অনেকখানি জমি নিয়ে ওর বাড়ি।ওঁরই নিজস্ব বাড়ি, স্বামীর নয় কিংবা ছেলেমেয়েদেরও নয় এখনও পর্যন্ত।পুকুর আছে, তেইশটা নারকেল গাছ, প্রায় শতখানেক ঝাঁড়কলা, আম জাম জামরুল আমড়া সুপুরি আরও কত যে গাছ তার ইয়ত্তা নেই। বাঁশঝাড়ও আছে এর মধ্যে। শ্যামা ঠাকরুন তার জমির এক বিঘৎ স্থানও বৃথা ফেলে রাখতে প্রস্তুত নন, ফলে গাছগুলি এত ঘন সন্নিবিষ্ট যে কোনো গাছেই আজ আর ভালো ফলন হয়না।

শ্যামাঠাকরুন প্রতিবেশীদের গাছে গাছে ফল দেখেন, লাউ মাচায় লাউ। মাটিতে কুমড়ো দেখেন আর নিজের অদৃস্টকে ধিক্কার দেন, "মরণ আমার, মরণ! পোড়া কপাল হলে কি গাছপালাও পেছনে লাগে রে! কেন কেন আমি কি করেছি তোদের?ঐ সব চোখ খাকী, শতেক খোয়ারীদের বাড়ী মরতে যেতে পারো আর আমার কাছে আসতে পারোনা না? .........."

রাগে দাঁত কিড়মিড় করেন উনআশি বছরের এই বৃ্দ্ধা। দাঁত তার ঐ বয়সেও ছিলো অনেকগুলোই কিন্তু কোমর ভেঙ্গে গিয়েছিলো । মাটির উপর উবু হয়ে হাঁটতেন। তাই বলে তার কর্ম বিরতি ছিলো না। হেঁটে হেঁটে সুদ আদায় থেকে শুরু করে দিনমান এক মিনিটও বসে থাকতেন না তিনি শুকনো লতাপাতা, কলার বাসনা, নারকেল সুপুরী বেলদো এইসব সংগ্রহ করে বেড়াতেন সারাদিন অবিশ্রান্ত। বাড়ির একখানা ঘর, রক দালান বোঝাই করে ফেলেছিলেন, তবুও তার সংগ্রহের বিরাম ছিলোনা।

"যদি কেউ প্রশ্ন করে" ও বামুন মা, তোমার গত বছরের পাতাই যে রয়েছে-" তিনি বেশ একটু ঝেঁজেই জবাব দিতেন," থাক না বাছা, পাতায় নজর দাও কেনো? এক বছর যদি বর্ষা বেশিই হয়, তখন কার কাছে ধার করতে ছুটবো বলো? "

শুকনো পাতা আর টাকার সুদ এই নিয়েই ছিলো তার শেষ বয়সের জীবন। কতবার সুদের লোভে আসল ডুবেছিলো তার। বন্ধকী ঘটি বাটি বাসনে স্তুুপীকৃত পাহাড় জন্মেছিলো তার খাটের তলা। কোনটা কার কোনও হিসাবও আর ছিলোনা তবুও অক্লান্ত পরিশ্রমে সারাজীবনের কষ্টার্জিত টাকায় খেলা করতে ভালোবাসতেন তিনি তবে মোটেও উপভোগ করতে পারতেন না তার কষ্টার্জিত অর্থ বরং আরও কষ্টকে বরণ করে বেঁচে থাকাতেই বুঝি ছিলো তার সকল সুখ।

সেই ছিলো তার আত্মতৃপ্তি হয়ত। আরাম করতে বুঝি ভয় পেতেন ।সারাজীবনের দুঃখ কষ্টের সাথে চলতে চলতে এই দুঃখের সাথে কখন যে সখ্যতা হয়ে গিয়েছিলো তার জানতেও পারেননি বুঝি তিনি আর। জগৎ সংসার সব কিছু ছিলো তার কাছে তুচ্ছ । তিনি নিজের মনে আপনমনে নিজের গড়া সম্পদ নিয়ে নিজের গড়া খেলাঘরে বসে বসে খেলতেন একাকী। নিঃসন্তান ছিলেন না তিনি। তিন ছেলে, তিন মেয়ে, অসংখ্য নাতি নাতনী ছিলো তার। নাতীদেরও ছিলো ছেলেমেয়ে। চাঁদের হাট বসবার কথা ছিলো বাড়িতে। তবু তার কেউ ছিলোনা । এত বড় বাড়িটায় তিনি ছিলেন একা।

অসংখ্য লতা পাতা, গাছ গাছালি ঢাকা বাড়িতে ছিলোনা একটুকরো আলো বা হাওয়া। সেই অন্ধকার ঝুপসি ভয়াবহ বাড়িতে শ্যামাঠাকরুন ঘুরে বেড়াতেন একা একা। দিন যাও কেটে যেত, রাত্রী ছিলো দুঃসহ তার। ঘুম হত না আর শেষ বয়সে ভালো মত। তেল খরচের ভয়ে আলোও জ্বালতেন না তিনি। দিনের খাবার বেলা করে খেতেন তাই খাবারের ঝামেলাও করতেন না রাতে। খুব বেশি ক্ষিধে লাগলে অন্ধকার হাতড়ে টিনের কৌটোর ঢাকনী খুলে বের করতেন চাল ভাজা।অন্ধকারেই একটু তেল হাত বুলিয়ে নিয়ে দীর্ঘ রাতভর কুড়কুড় করে খেতেন তিনি।সেই গাঢ় অন্ধকারে নক্ষত্রের আলোও প্রবেশ করতো না তার ঘরে।সেই চাপা দুঃসহ অন্ধকারে প্রেতিনীর মত বসে থাকতেন শ্যামাঠাকরুন। মনকে বুঝাতেন চোখেই ভালো দেখতে পাননা আলো জ্বালিয়ে লাভ কি? শুধু শুধু পয়সা নষ্ট।

এইসব কার জন্যে করছেন জানতেন না তিনি। প্রাণে ধরে কাউকে কিছুই দিতেও পারতেন না। তবুও তিনি করেই চলেছিলেন। আপন মনে নিজের খেলাঘরে। বাগান গাছপালার যত্নের ত্রুটি ছিলো না।সারাটাক্ষন পয়সা বাঁচিয়েই ছিলো তার শান্তি। নিজেেকে কষ্ট দিয়েও দুই পয়সা বাঁচলে বুঝি তার শান্তি হবে। কিন্তু তাতেও তার শান্তি ছিলোনা। যেন এক জলন্ত হুতাশন!


তবে শ্যামাসুন্দরীর এই বৃদ্ধা বয়সের চেহারা দেখে তার এককালের সৌন্দর্য্য কল্পনা করা কঠিন। শুধু সুন্দরী না বেশ অসাধারণ রকমের সুন্দরীই ছিলেন তিনি। এই ধনুকের মত বাঁকা দেহ একদিন ছিলো কালাগাছের চারার মতই সতেজ ও পুষ্ট। মাথাজোড়া টাকের জায়গায় ছিলো মাথাভর্তি এক ঢাল মেঘের মত কালো চুল।ঐ ছানি পড়া স্তিমিত চোখে একদিন খেলতো বিদ্যুৎ। শ্যামা তার নাম মিথ্যে করে গোলাপের মত গাত্রবর্ন নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এক অসাধারণ সুন্দরী।

দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো তার উনিশ বছর বয়সী আরেক অসাধারণ সুশ্রী চেহারার বালক নরেন্দ্র কুমারের সাথে। বাবা যজমানী করতেন, নিজেদের বাড়ি আছে, ছোট সংসার, শ্বাসুড়ী ও দু ভাই এর সংসারে এই ছেলে এখন বেকার হলেও ভবিষ্যতে কিছু জুটিয়ে নিতে পারবে বড় ভাই এর মত এই ভরসায় বেশ পছন্দ করেই বিয়ে দিয়েছিলেন শ্যামার মা। শ্যামার মা রাসমনি দেবী নিজেও বিধবা ছিলেন ও ঘটনাচক্রে বিশেষ বিষয় সম্পত্তিও ছিলো না তার। কাজেই এত কিছু ভাববার মত সুযোগও ছিলোনা তেমন। তবে তিনি বিশেষ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন যার পরিচয় পরে পাওয়া যায়।

শ্যামারও সেদিন বিয়ের ব্যাপারটা মন্দ লাগেনি। এক গা গয়নাঘাটি, বেনারসী শাড়ি, সাজগোজ, পায়ে মল বাজিয়ে শ্বসুরবাড়ি যাওয়া। আলো বাজনা লোকজন, শ্বাসুড়ির সদয় ব্যাবহার সব মিলিয়ে যেন এক মজার নেশায় ছিলো সে। ঘোর কাটলো ফুলশয্যার রাতে।


সবাই বর কণেকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে, শ্যামা অপেক্ষা করছে দুরু দুরু বুকে।ফুলশয্যার রাতে স্বামীরা অনেক রকম আদর করে।অনেক রকম মিষ্টি কথা বলে- এ তার শোনা আছে আবছা আবছা ............

যাইহোক, আশা যেমন আছে, লজ্জাও বড় কম নেই। কোথা থেকে যেন রাজ্যের লজ্জা এসে আছন্ন করে ফেলেছে। সে বসে বসে ঘামছে। কিন্তু নরেন বেশ সপ্রতিভ, সবাই চলে যেতেই সে লাফ দিয়ে উঠে দরজাটা বন্ধ করে আবার খাটে এসে বসলো। তারপর মিনিটখানেক একটু ইতস্তত করে চাপা গলায় ডাকলো, "এই শোনো।"
শ্যামা হয়তো এই আহ্বানেরই অপেক্ষা করছিলো কিন্তু সুরটা যেন ঠিক কানে বাজলো না।ডাকলেই কি সাড়া দেওয়া যায়?
" এই শোনোনা কি ইয়ার্কী হচ্ছে?" নরেন ওর এক খানা হাত ধরে হ্যাচকা টানে কাছে নিয়ে এলো। সে টানের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা শ্যামা। একেবারে নরেনের গায়ের ওপর এসে পড়লো। অস্ফুট কি একটা বিস্ময়েরে স্বরও ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
: আহা ঢঙ দেখোনা। লজ্জা দেখে মরে যাই একেবারে। দেখি সোজা হয়ে বসো।।মুখখানা দেখি ভালো করে। সবাই বলছে সুন্দর সুন্দর- আমার ছাই ভালো করে দেখাই হলোনা একবার।

সে জোর করে শ্যামার মুখখানা শেজ এর আলোয় যতবার তুলে ধরতে যায়। ততই ওর মুখ লজ্জায় গুঁজে পড়ে। সুগৌর,সুডৌল চন্দন চর্চিত একটি ললাট ও আবীর ছড়ানো দুটি গালের আভাস পায় নরেন অথচ ভালো করে দেখতে পায়না। কিছুতেই না। এমনি মিনিট খানেট চেষ্টা করার পর ওর মাথায় সজোরে এক গাট্টা মেরে বলে, "ও আবার কি ছেনালি হচ্ছে- সোজা হয়ে বসো বলছি নইলে মেরে একেবারে পস্তা উড়িয়ে দেবো। তেমন বর আমাকে পাওনি। হু হু- আমি বাবা পুরুষ বাচ্চা।মাগের ভেড়ো হবার বান্দা নয়। সোজাসুজি চলো বেশ আছি। ন্যাকামী করেছো কি আমি বাপের কুপুত্তুর।"


শ্যামা আড়স্ট হয়ে গেছে ততক্ষনেএই কি ফুলশয্যার তার? এই তার স্বামীর প্রথম প্রনয় সম্ভাষন! তাছাড়া তখকার হিসাবে তার মা ভালোই শিক্ষিতা ছিলেন। অনেক রকমের বাংলা সাহিত্যের বই আছে তাদের তোরঙ্গে।
এই শ্রেণীর ভাষা শুনতে তারা অভ্যস্ত নয়। ভদ্রসমাজে এমন কথাবার্তা অচল বলেই জানে।

কাজেই তার দুচোখ ছেপে কান্নার ঢল নামে। তাই দেখে লজ্জিত বা দুঃখিত হওয়া তো দূরের কথা। নরেন বলে ওঠে,
"উঃ অমনি পানসে চোখে পানি এসে গেলো। আলগোছ লতা। সে আবার জোরাজুরি শুরু করে। শ্যামা চোখ চাইতে না পারায় ওর বাহুমূলে সজোরে চিমটি কাটে নরেন। ফলে শ্যামার চোখে আরও বেশি জল ঝরতেই..........

:ধ্যেস- বদমাইশ অবাধ্য কোথাকার! বলে ওকে এক ঠেলা দিয়ে খাট থেকে নামিয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নরেন।

সেই শুরু। নির্দয় নির্মম ভালোবাসাহীন সংসারে শ্যামাঠাকরুনের বাস। শ্বাসুড়ী ছিলেন বেশ মায়াবতী আর বিবেচক আর তার ছেলেদের বদ স্বভাব রগচটা মূর্খামীর জন্য সদা ও সর্বদা বউদের কাছে বিব্রত থাকতেন তিনি। পরম মমতায় ভুলিয়ে দিতে চাইতেন তার সকল দুঃখ কষ্ট ও বেদনাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নরেনের অত্যাচার বাড়লো বই কমলো না।সে যেন নরেনের নিজস্ব সম্পত্তি আর শুধু যথেচ্ছ অত্যাচার করার জন্যই বুঝি ভগবান তাকে এই সম্পত্তি মিলিয়ে দিয়েছেন।

বউকে অত্যাচার করার সম্পত্তি মিলিয়ে দিলেও নরেন ও দেবেন দুইভাই তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষা করতে পারলোনা। বাড়ি বেঁচা টাকায় ফূর্তি করে বেড়ালো কদিন। মা ও স্ত্রী কি খাবে কি করবে সে ভাবনা ছিলোনা তার। বড় ভাই অন্যত্র হাতুড়ে ডাক্তারী করতেন। সেও একই গোয়ালের গরুই ছিলো। তবুও বুঝি নরেনের চাইতে কিছুটা ভদ্রতা জানা ছিলো তার।
যাইহোক যেদিন বাড়ি বেঁচা টাকায় খুব ফুলবাবুটি সেজে বাড়ি ফিরলো নরেন।
মা বললেন, এত সাজগোজ ! এলো কোথা থেকে?
নরেন রাগ করে বলে, তোমার এক কথা। আমি বুঝি রোজগার করতে পারিনা?
মা রেগে বললেন, "হ্যাঁ তুই করবি রোজগার! মুখখুর ডিম।"
নরেন নির্বিকার বললে, "কি বলবো অবোধ মেয়েমানুষ, তায় মা, নইলে এ কথা অন্য কেউ বললে এক চড়ে মুন্ডু ঘুরিয়ে দিতুম।"

এই সেই নরেন যার অদূরদর্শিতায় শ্যামাকে হতে হয় পথের ফকির। সহায় সম্পদ হারিয়ে নরেন শ্যামাকে এক সন্তান সহ এক সময় এনে তোলে এক বিজন বনে। সরকারবাড়ির মন্দিরের বামুনের পুজো করাবার চাকুরী নিয়ে। কিন্তু তাও কি সে ঠিকঠাক করে। দুদিন বাদে বাদে শ্যামার সঞ্চিত অর্থ চুরি করে পালিয়ে যাওয়াই ছিলো তার স্বভাব। বন্ধনহীন পাশবিক অমানবিক চরিত্রের নরেন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতো না আর শ্যামা একে এক ছয় ছয়টি সন্তান নিয়ে তাদের মুখে অন্ন যুগিয়েছেন কি নিদারুন দক্ষতায়, কি নিদারুন কষ্ট সয়ে তারই বর্ণনা এই বইটিতে চলচ্চিত্রের মত ফুটে উঠেছে।

শ্যামার ছোটবোন উমা। তার কপালেও সুখ জোটেনি। স্বর্গের অপ্সরীদের মত রুপ নিয়েও সে কোনোদিন পায়নি স্বামীর ভালোবাসা। বিয়ের পর পরই মায়ের জোরাজুরিতে বিয়ে করে ফেলা স্বামী রক্ষিতার প্রতি ভালোবাসা রক্ষার্থে চিরজীবন মাঝে পাশবালিশ রেখে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন উমার সাথে। সে অন্য এক গল্প ! অন্য এক ইতিহাস! শুধু উমার মুখ বুজে সকল কষ্ট সয়ে নেবার কাহিনী পড়ে বুক ফেটে যায়। অবাক হতে হয় কি করে লেখক এই রমনীদের হৃদয়মাঝে বসত করে লিখে গিয়েছিলেন সেই অভুতপূর্ব অনুভুতির কথাগুলি। শ্যামা- উমা কিংবা তাদের মা রাসমনি, শ্বাসুড়ী ক্ষমাসুন্দরী বা শ্যামা এর বড় জা রাধারাণী সকলের অনুভুতিগুলির সুক্ষ প্রকাশ কি করে সম্ভব, কি করে সম্ভব নরেণ, বড়ভাই দেবেন বা সরকার গিন্নী মঙ্গলার এত সুক্ষ চরিত্র বর্ণন, এই লেখকের লেখনীতে তা বুঝি একমাত্র জানা যায়। গজেন্দ্রকুমার মিত্রের এই বইটি তাই আমার হৃদয়ের কুঠুরীর অনেকটা জায়গা জুড়েই রয়ে গেছে। ।



বই এর নাম: কলকাতার কাছেই
লেখক: গজেন্দ্রকুমার মিত্র

কলকাতার কাছেই উপকণ্ঠে, পৌষ-ফাগুনের পালা - এই ট্রিলজি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কথাসাহিত্যিক গজেন্দ্র কুমার মিত্রের সর্বোত্তম সাহিত্যসৃষ্টি। উনবিংশ শতাবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরু -এই রকম সময়ের পটভূমিতে এই ট্রিলজি কাহিনীর সূত্রপাত। কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা পত্নী রাসমণি ও তার তিনি কন্যার জীবন নিয়ে এই উপন্যাস-ত্রয়ীর কাহিনী শুরু। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধ্যমা শ্যামাকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে, তবু রাসমণির তিন কন্যার ক্রমবর্ধমান পরিবারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার নরনারী বিভিন্ন ঘটনাসূত্রে কাহিনীতে অসাধারণ বৈচিত্রের সৃষ্টি করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কাহিনীর অখন্ডতা লাভ করেছে। সংস্কারে সংস্কৃতিতে উন্নত অথবা নিদারুণ দারিদ্রক্লিষ্ট মধ্যবিত্ত সমাজের এই সব মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ-সংকীর্ণতা, আশা-নিরাশা, ছোট বড়, সুখ দুঃখ. বিপদ আপদ সবকিছুর মধ্যদিয়েও তাদের অপরাজেয় জীবনাকাঙ্ক্ষার এবং জীবনযুদ্ধের এক নিটোল অনবদ্য কাহিনী শুনিয়েছেন লেখক যা আমরা আগে শুনিনি, আজকাল শোনা যায় না, অদূর আগামীকালে শুনব কিনা সন্দেহ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে এই টিলজি নিঃসন্দেহে একটি দিকচিহৃ।

এই বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকায় লিখেছেন-
যারা আমার সাঁঝ সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিয়ে আলো, আপন হিয়ার পরশ দিয়ে; এই জীবনের সকল সাদা কালো যাদের আলো-ছায়ার লীলা; সেই যে আমার আপন মানুষগুলি নিজের প্রাণের স্রোতের ‘ পরে আমার প্রাণের ঝরণা নিল তুলি; তাদের সাথে একটি ধারায় মিলিয়ে চলে, সেই তো আমার আয়ু, নাই সে কেবল দিন গণনার পাঁজির পাতায়, নয় সে নিশাস-বায়ু।
...................................................
এই ভালো আজ এ সঙ্গমে কান্নাহাসির গঙ্গা-যমুনায়
ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়।

বিভূতিভূষণষ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন-
বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নর-নারী; তাদের সুঃখ-দারিদ্র্যময় জীবন, তাদের আশা-নিরাশা, হাসি-কান্না-পুলক-বহির্জগতের সঙ্গে তাদের রচিত ক্ষুদ্রজগৎগুলির ঘাত-প্রতিঘাত,বাংলার ঋতুচক্র, বাংলার সকাল সন্ধ্যা-সকাল, আকাশ বাতাস, ফলফুল। বাঁশবনের,আমবাগানের নিভৃত ছায়ায় ঝরা সজনে ফুল বিছানো পথের ধারে যে সব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্নগোপন করে আছে-তাদের কথাই বলতে হবে, তাদের সে গোপন সুখ-দুঃখকে রূপ দিতে হবে।


গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ত্রয়ী উপন্যাস 'কলকাতার কাছে উপকণ্ঠে ও পৌষ ফাগুনের পালা' অবলম্বনে এ টি এন বাংলায় "পৌষ ফাগুনের পালা" ধারাবাহিক নাটক বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে।


লেখক পরিচিতি-
গজেন্দ্রকুমার মিত্র
জন্ম : ১১ই নভেম্বর, কলকাতা শহরেই | বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কাশীর অঙ্গলোবেঙ্গলী স্কুলে | কলকাতায় ফিরে এসে ঢাকুরিয়া অঞ্চলে গজেন্দ্রকুমার বসবাস শুরু করেন এবং বালিগঞ্জ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন | স্কুল জীবন অতিক্রম করে অতঃপর তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন | স্কুল শিক্ষা সমাপ্তির কিছুপরেই সুমথনাথের সঙ্গে মাসিক সাহিত্যিক পত্রিকায় 'কথাসাহিত্য' শুরু করেন | গজেন্দ্রকুমারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'মনে ছিল আশা', গল্পগ্রন্থ 'স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম' | ১৯৫৯ সালে তাঁর 'কলকাতার কাছেই' উপন্যাস আকাদেমি পুরুস্কারে সম্মানিত হয় | কলকাতার কাছেই, উপকন্ঠে, পৌষ-ফাগুনের পালা-এই ট্রিলজিকে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের Land-Mark বলে গণ্য করা হয় | পৌষ-ফাগুনের পালা ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্র পুরুস্কার পায় | গজেন্দ্রকুমারের লেখনীর বিচরনক্ষেত্র বিরাট ও ব্যাপক, সামাজিক উপন্যাস, পৌরানিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ছোট গল্প.কিশোর সাহিত্য-সর্বত্র তাঁর অবাধ গতি | সুদীর্ঘ ষাট বছরের অধিককাল ধরে তাঁর লেখনী সৃজনশীল | ১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর তাঁর তিরোধান হয় |

২য় পর্ব আগামী পোস্টে---
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:১৩
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×