somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার লাজুক স্বামী

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৪:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



খুব ছোটবেলায় আমি নাকি খুবই লাজুক ছিলাম। বাড়িতে কেউ আসলে আমাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। লুকিয়ে যেতাম আমি। এমনকি স্কুলে ভর্তির পাক্কা দু বছর আমি একটা কথাও বলিনি কারো সাথে। এমন অবাক বিস্ময় মনে হয় আমার স্কুলের টিচারেরা কখনও দেখেননি বা শোনেননি। প্রতি প্যারেন্টস মিটিংএ অথবা প্রমোশনের সময় তাদেরকে শুনতে হতো শিরি খুব ভালো মেয়ে। এত শান্ত শিষ্ঠ বাচ্চা আমাদের আর দুটি নেই। সব কাজ সে মন দিয়ে করে কিন্তু একটাই সমস্যা মানে বিশাল সমস্যা তা হলো সে একটা কথাও বলেনা। বন্ধুরা জানতে চায় "আচ্ছা তুমি কি কথা বলতে পারো? " আমি সেটার জবাব দেবার ইচ্ছেটুকুও কখনও প্রকাশ করিনা।

এইভাবে কাটলো বেশ কয়েক বছর। মা রিতীমত ফেড আপ। তাকে বাসায় আমার কথা বলা দৃশ্য রেকর্ড করে নিয়ে গিয়ে স্কুলে দেখিয়ে প্রমান দিতে হলো যে আমি কথা বলতে পারি। মা তখন এতই বিরক্ত আমাকে নিয়ে যে কখনও কোনো আত্মীয়ের সামনে বা অনুষ্ঠানে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে জবাব না পেলে মাথায় গাট্টা লাাগাতেও দ্বিধা করতেন না। এরপর ধীরে ধীরে আমার জড়তা কাটতে থাকে কিন্তু খুব কম কথায় যা কিছু প্রকাশ সম্ভব সেটাই করেছি আমি আজীবন। এ কারণে আমার তেমন কোনো বন্ধু হয়নি কখনও।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো আমার ডায়েরী। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে ক্লাস সিক্স থেকে আজ পর্যন্ত মোটমাট ১৩ টা ডায়েরী আছে। প্রতি বছর নতুন ডায়েরী উপহার পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। আর কেউ না জানুক আমার বাবা জানেন ডায়েরীই আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু যার সাথে আমি মনের সব কথা বলি।

যাকগে, লিখতে বসেছি আমার লাজুক স্বামীকে নিয়ে, আমাকে নিয়ে নয়। মা বাবা দাদী নানীরা খুব সংশয়ে ছিলেন আমার এই কম কথা বলা স্বভাব নিয়ে, না জানি বিয়ের পর আমার শ্বসুরবাড়িতে কি সমস্যা হয়। তারা বলতেন আমার বর নাকি হবেন বিশ্ববাঁচাল। তার কথা শুনতে শুনতে নাকি আমার কান কালা হয়ে যাবে। এখন আছি বোবা তখন হবো কালা।

সে যাই হোক যেদিন আমাদের পাকা দেখা। কনেপক্ষ ও বরপক্ষ অনুষ্ঠানের একটা পর্যায়ে আমাদেরকে একা রেখে উঠে গেলেন ড্রইংরুম থেকে। আমার স্বামীদেবতাই কথা শুরু করবেন মানে এই ব্যাপারে তার দায়িত্ব যে একশতভাগ তা তার উপরেই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে রইলাম আমি। ওমা দশ মিনিট, পনেরো মিনিট এমনকি ২০/৩০ মিনিটও হতে পারে হয়ত তারপরেও সে কথা শুরু করার কোনো উদ্যোগ নিলোনা। আমি শুধু দেখলাম এক জোড়া চকচকে স্যু আর সেও নাকি দেখেছিলো এক জোড়া গোলাপী স্যান্ডেল পরা পা (অবশ্য সেটাও তার মুখে শোনা না, সেটা আমার বাঁচাল ছোট দেবরজীর মুখে পরে শুনেছি।)

এরপর বিয়ে ঠিকঠাক। খুব তড়িঘড়ির বিয়ে। এক সপ্তাহের মাঝে কেনাকাটা দাওয়াৎপত্র সব শেষ। আমি রাজশাহী আর সে ঢাকা। একদিন সে ফোন করলো। আমার ছোটবোন ধরেছিলো ফোনটা। আমার কানে ফোনটা দেওয়া হলো সে বললো হ্যালো, আমি নিরুত্তর। সে আবারও বললো হ্যালো হ্যালো, আমি আবারও নিরুত্তর। বেশ খানিকটা সময় এইভাবে কাটার পর সে বললো ওকে খোদা হাফেজ।

এরপর তার সাথে দেখা সোজা বিয়ের স্টেজে। সেখানে বরকণে দুজনাকেই নির্বাক থাকারই নিয়ম কাজেই আমাদের কোনো সমস্যা হলো না। তারপর বাসর রাত। আমরা দুজন বোবা মানব মানবী জানবার পরেও ঠিকই দরজার ওপাশে আড়ি পাতলো কিছু অতি উৎসাহী মানুষেরা। আমার লাজুক স্বামী বাসর ঘরে ঢুকলেন মানে বাধ্য হলেন ঢুকতে । ফুলপাতা সজ্জিত ফুলশয্যার এক কোনায় অতি আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে গিয়ে বসলেন ও যথারিতী নির্বাক রইলেন। সাউন্ডবক্সে মৃদু শব্দে গান বাজছিলো। আমার দুষ্টু দেবর ননদেরা গান ছাড়লো " প্রাণ চায় চক্ষু না চায়, মরি একি তোর দুস্তর লজ্জা।"
পাকনুগুলা ইনটেনশন্যালীই কাজটা করেছিলো। বেশ কিছু সময় কাটবার পর দরজার ওপ্রান্ত থেকে একজন বেশ জোরে বলে উঠলো। আরে তোমরা কি কানে কানে কথা বলতেছো ? কিছু শুনতে পাইনা কেন? আমার স্বামীদেবতা এইবার উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন আর সব কটা দৌড়ে পালালো।

স্বামীদেবতার হঠাৎ কি হলো তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন পূর্নিমা দর্শণ সেরে টেবিলে রাখা এক গ্লাস পানি এনে আমাকে বললেন, পানি খাবে? খাবেন বলেছিলো হয়তো আমি শুনেছিলাম খাবে কারণ যে রকম লাজুক মানুষ আমাকে প্রথম কথপোকথনে আপনি না বলে যাবেই না। বাসর শয্যা আর প্রথম বাক্য কতইনা গল্প কথা সেসব নিয়ে, হিন্দী, বাংলা এমনকি ইলিংশ ম্যুভিগুলোতেও এই রাতটি নিয়ে কত রোমান্টিকতা। আর আমার লাজুক স্বামী কিনা আমাকে দেয় এক গ্লাস পানি! নিশ্চিৎ সে বুঝেছিলো তার মত আমারও গলা শুকিয়ে গেছে। কথা শুরু করা বা বলাটা যে আমাদের দুজনের কাছেই যমের চাইতেও ভীতিকর কিছু।

এতদিনে আরও একটা জিনিষ বুঝলাম আমার মত বোবাকে নিয়ে সারাটাজীবন যে ধকল পুইয়েছেন আমার কাছের মানুষেরা সেই ধকলের শাস্তি বিধাতা আমার কপালেই লিখে রেখেছিলেন।
৪৮টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×