শান্তি আসুক বিশ্ব জুড়ে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তির জন্য নভেম্বরের এগার তারিখ এগারটায় সমবেত বিশ্ব নেতারা এক হয়ে শান্তি চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করলেও । শান্তি রক্ষা হলো না। বর্ণ ধর্মের গর্ব বড় হয়ে দেখা দিল। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ বেঁধে গেলো। ইহুদিদের দমন করার জন্য। কিন্তু শুধু কী ইহুদি সে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে ইসরাইলে গেছে। বা কন্সেস্ট্রেশন ক্যাম্পে মরেছে । বহু খৃস্টানও সে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হয়েছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বিশ্ব জুড়ে মানুষের জীবন হলো উল্টাপাল্টা।
কিছুদিন আগে গিয়ে ছিলাম দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে হিটলার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়া ফ্রান্সের নরমেনডিতে কানাডার মিত্রবাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র জুনো বীচে। উত্তর সাগরের পাড়ে নৌবহর থেকে নেমে ব্যাঙ্কারে আত্মগোপন করে থেকে। জার্মান সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দূর দেশ থেকে যাওয়া কানাডার সৈন্যদল মুক্ত করে ফ্রান্সের ঐ অঞ্চল। তাই কানাডার মিত্রবাহিনীর সম্মানে ওখানে ম্যামরিয়াল, স্মৃতিস্তম্ভ যাদুঘর করে রাখা হয়েছে। সাধারন মানুষরা যখন অত্যাচারে জর্জরিত প্যারিসে, তারা এই মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তি পায়। ফ্রান্সের আজকের দর্শক পদচারণায় মুখর জায়গাটি সে সময় ছিল পলায়ন পর মানুষের ভয় বিহব্বল অর্তনাদে ভরা। সেখানে শুধুই ইহুদি ছিল না ছিল সে দেশগুলোতে বসবাসরত সব বর্ণ ধর্মের মানুষ।
সে সময়ও অনেক বন্ধু, পরিচিত মানবিক মানুষ আড়াল করে বাঁচিয়েছে হিটলার বাহিনীর কোপের মুখ থেকে ইহুদি ধর্মবলম্বীদের। কিন্তু কেন এই উচ্ছেদ হানাহানী শেষ পর্যন্ত তো নিজের জীবনটাও অকালে আত্মহননে হারাতে হলো এডলফ হিটলারকে।
১৮০০ সালে আইকন হিসাবে গড়া আইফেল টাওয়ারটিও গুড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ছিল হিটলারের বাহিনী।
যুদ্ধের ভয়াবহতার স্মৃতি ধারন করে প্রতিষ্ঠিত শান্তি যাদুঘর দেখলাম ঘুরে ঘুরে। বিশাল ব্যাঙ্কারের ভিতর ঢুকলে অদ্ভুত অনুভূতি হয় মনে। উপরে হালকা শব্দ অনেক জুড়ে বাজে নীচে। সে সময়ও ছিল খবর পাওয়ার জন্য নানা রকম যন্ত্রপাতি। আর বোমা গুলি, বন্দুক, গ্রেনেড, ট্যাঙ্ক । সাথে নিজের ভালোভাবে থাকার সকল ব্যবস্থা করে রেখেছিল। টাইপ রাইটার দেখে ভাবছিলাম কত ভয়ানক সব নির্দেশনা এই যন্ত্রে টাইপ করা হয়ে ছিল। এবং যুদ্ধ বন্দীদের চিঠি ছবি যা দেখে মন ভেঙ্গে যায়।
"অসংখ্য বীর তারুন্যের রক্তের বন্যায় প্লাবিত আমাদের মাতৃভূমি যাদের জীবনের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা পাওয়া । তাদের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা। "এই মেমরীয়ালে লেখা আছে।
বর্ণ বা ধর্মের যুদ্ধ উতখ্যাত করে চলেছে পৃথিবী ব্যাপী মানুষদের তাদের সাধারন জীবন যাপন থেকে। অথচ এই নাটের গুরু নির্দেশদাতা অল্প কিছু মানুষ। নিজেদের বৈভব স্বার্থ এবং স্বার্থপর ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে বিস্তার দিতে উসকে দিচ্ছে কিছু লোলুপ মানুষকে।
আমার মাকে তার ভীটে বাড়ি ছেড়ে উচ্ছেদ হয়ে চলে আসতে হয়েছিল অন্য দেশে, ব্রিটিশের আরোপিত ধর্ম ভিত্তিক দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার ফলে। আজীবন মায়ের বুক থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরছে, সেই সাজানো ঘরবাড়ি বন্ধুদের কথা মনে করে। সাথে অন্য দেশে রিফিউজি অপবাদ মাথা পেতে নেয়ার দারুণ অসহায় একটা মনক্ষুন্নতা অবলোকন করে গেছি। অথচ পাশের বাড়ির মানুষের বদলে যাওয়া চোখ দেখে যে ভীতি ছিল মনে। রায়টের ভয়াবহতা নারীদের দু পা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা; সে ভয় যেন আমার মাঝে বিস্তার করে যায়, এক দমবন্ধ কঠিন গ্যাস চ্যাম্বার হয়ে। কেনো এই ভয়বহতা পেতে হয় কিছু না করেও!!
যারা বাংলাদেশের মাটিতে এখন নির্যাতিত হচ্ছে সংখ্যালঘু নামে, কিছু বর্বর লোলুপের লোভের কারণে, তাদের জন্য মন কাঁদে একই অনুভবে। প্রশাসন আমার হাতে নেই। আমি এক নিমিশে এদের বন্দী করতে পারি না শাস্তি দিতে পারি না । বন্ধ করতে পারি না এই সব বর্বর অত্যাচার। অসহায় দেখে যাওয়া ছাড়া। পারলে এদের মূল উৎপাটন করতাম।
আমার বন্ধুটিকে দেখলাম যাদুঘরে, কি আগ্রহে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে তার পূর্ব পুরুষদের উপর নির্যাতনের আতংকগ্রস্ত স্মৃতিগুলো। অথচ তারা কেউ ইহুদি ছিল না। আমি যখন যুদ্ধের উপর নির্মিত ছবিগুলি দেখি, বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। পৃথিবীর মানুষের কষ্টটা আমার বুকে বাজে। সব বর্ণ, ধর্ম, গোত্রের উপরে একই মানবিক কষ্টে। ”সোফিস চয়েস ” ছবিটি দেখে একটি মেয়ের কষ্ট আমার মনে মিশে যায়। ভাবতে থাকি আমাকে যদি বলা হয় দুটো বাচ্চা থেকে একটাকে দিয়ে দাও আমি কি একটাকেও ছাড়তে পারব। অথবা যখন ঋত্বিক ঘটকের ”কোমল গান্ধার” দেখি। ওপার পদ্মা এপার পদ্মার ভাগ। ওপারে দিকে তাকিয়ে বাড়ির গন্ধ বুকে নেয়া মানুষদের গল্প আমার মায়ের কষ্ট জেগে উঠে আমার মনে।
সিরিয়ার উদবাস্তু মানুষ ছুটছে বাঁচার আশায়। ডুবে মরছে জলে। কেউ কেউ তাদের জন্য খুলে দিচ্ছে গীর্জার দরজা। মুসলিম বলে দূরে সরিয়ে না রেখে মানবতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ইউরোপে দেখলাম মোটামুটি সারা জীবন নিজের মতন থাকা বয়স্ক মানুষ, সেচ্ছায় সিরিয়ান রিফিউজিদের সাহায্যর জন্য ভলান্টিয়ারি কাজ করছেন। যা না করলেও তাদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু মানবতার জন্য তারা কেউ পড়াচ্ছেন, কেউ জামা কাপড় সেলাই করছেন। কেউ চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। অন্য বর্ণ অন্য ধর্মের মানুষদের মানুষ হিসাবে দেখছেন। তাদের দূর্দশায় এগিয়ে এসেছেন মানুষ হয়ে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পাঁচিশ হাজার সিরিয়ান রিফিউজিকে কানাডায় অভিভাসি হিসাবে নেয়ার ঘোষনা দিয়েছেন। মনবতার এই অনুভবকে অনুভব না করে রিফিউজি আসলে নিজের টান পরে যাবে অনেক কিছুতে ভাবাটোয়ারা করতে হবে এই ভয়ে অনেকে বিরোধীতাও করছেন। মনে হয় এরা হিটলারেরই বংশধর। অথচ নৌকা বোঝাই মানুষের উদবাস্ত হয়ে ভেষে যাওয়া নৌকা থেকে পরে মরে যাওয়া। বোমে সাজানো শহর ধ্বংস হওয়া নিযে কেবল ভার্চুয়াল মাতামাতি।
পৃথিবী ব্যাপী আবার এক যুদ্ধ যুদ্ধ উত্তেজনা চলছে যেন। সুযোগ পেলেই হিংস্রতায় ছিঁড়ে খেতে চায় অসহায়দের লোটপাট, ধর্ষন, রক্তাক্ত করতে বড়ই আনন্দ, স্বার্থপর লোভীদের।
নাইন ইলেভেনের ধ্বংসাত্বক আক্রমনের পর উল্টো আক্রমণে শেষ হলো ইরাক, আফগানিস্থান। অভিভাসনের দেশ আমেরিকায় নিরীহ জীবন যাপন করা বহু মানুষকে উচ্ছেদ করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দেশে, ধর্ম বিদ্বেশে আক্রান্ত হলো মানুষ। অনেক পরিচিতদের দেখলাম আঠার, বিশ বছরের আমেরিকার জীবন ছেড়ে ফিরে যেতে দেশে। অথচ এসব মানুষ নিজের বেঁচে থাকার বাইরে সাতে পাঁচে নাই।
এবার আমেরিকার ভোটটি হলো সেই বর্ণ ধর্মকে কেন্দ্র করে আবার। এইবার বুঝি অনেক বছর পর ভোটের পরদিন থেকে চলছে নানা রকম প্রতিবাদ আর আক্রমনের ভয়াবহতা গোটা আমেরিকা জুড়ে। যাদের মনে এক ধরনের বিদ্বেশ ছিল শাসনের জন্য প্রকাশ পাচ্ছিল না। তারা সুযোগ পেয়েই তা প্রকাশ করছে কার্পন্যহীন ভাবে। যে শাসক হবে সে যখন উসেকে দেয় তখন লাগম টেনে ধরবে কে। এক ধরনের ভয় ভীতি আশংকার ভিতরে বাস করছে আমেরিকার অধিবাসি নিরীহ মানুষ এই মূহুর্তে।
মুসলিম মেয়েটি টুইটারে লিখেছে, তার ধর্ম ভীরু মা বলেছে, "তুমি এখন হিজাব পরো না।" কারণ আছে অনেকে নানা রকম হুমকি দিচ্ছে। হিজাবীরা আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ম্যাক্সিকানদের ভিসা ফ্রি আসার সুযোগ দিয়ে দিয়েছেন।
গত বছর যখন কানাডায় ভোট হলো উইড ফ্রি হওয়ার একটা ঘোষনা ছিল নেতার। ভোটে জেতার পরপরই পথে ঘাটে উইড টানতে বসে গেলো মানুষ মনের সুখে। নিজের সুখের জন্য ম্যারিওনা সেবন তবু ভালো মানুষের প্রতি আক্রমণ করার ভয়ংকর বর্ণ ধর্ম বিদ্বেসি মনভাব থেকে।
শাসকরা যতটা বলেন ততটা করেন না। কানাডায় সব মানুষ নেশা করতে ঝাঁপিয়ে পরেনি এবং অনেক কিছু আসলে তেমন খোলামেলা থাকেনি। মনে করি আমেরিকার নির্বাচিত নতুন প্রেসিডেন্টও অনেক কিছুই করবেন না যেমন বলেছেন। এ ছিল শুধুই নিজেকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা নির্বাচনে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। তবে মানুষের মনে যে হিংসা বসবাস করে তা বেশ প্রকাশিত হয়েছে এই সুযোগে। পৃথিবী বাসী দেখছে সভ্যতা বলে আসলে কিছু নেই জোড় করে শাসন দিয়ে শৃঙ্খলা ধরে রাখা।
আজ বিশ্ব শান্তির দিন এগারো নভেম্বর। আশা করি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। পৃথিবী ব্যাপী কিছু মানুষের তাণ্ডবের কারণে কিছু অশান্তি বিপ্লব এবং অশান্তি চলবে, তবু আশা করতে দোষ নেই। অপেক্ষায় থাকি সব মানুষের মানুষ হয়ে উঠার বৈষম্য ভেদাভেদ ভুলে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৫৭